সংলাপ
॥ অস্থিরতা আর তার সাথে আছে অসহিষ্ণুতা। চারপাশে তাকালে মনে হয়, মানুষের মধ্যে ধৈর্য-সহ্য
সহানুভূতির মতো গুণগুলো যেন প্রায় হারিয়েই গেছে। সবসময় একটা উগ্রতা, একটা লড়াই-লড়াইভাব
সবার মধ্যে। রাজনীতিকরা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। অন্যের ভালো দেখলে যেন তাদের
বুক জ্বলে যাচ্ছে। সে জ্বালা মেটাতেই সংশ্লিষ্টের সর্বনাশের চিন্তা চড়বড় করে উঠছে তাদের
মাথায়! আর তার পরিণতিতেই ঘটে যাচ্ছে অপ্রীতিকর মর্মান্তিক ভয়াবহ সব ঘটনা। যে সহনশীলতা,
কোমলতা, মায়া-মমতা দেশে এবং দেশের বাইরে বাঙালিকে একটা আলাদা সুনাম ও স্বাতন্ত্র্য
দিয়েছিল তা আজ কোথায়? আজকের বাঙালির চেহারায়, চরিত্রে, সাজ-পোষাকে, কথায়, হাবেভাবে
তার কতটুকু অবশিষ্ট আছে? সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যেও কেমন যেন পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে।
বদমেজাজ, বেহিসেবীপনা খরচ আর স্বার্থপূরণের উচ্চাশা ঘরসংসার, আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে মানুষের
দূরত্ব যেন বাড়িয়েই চলেছে। সেই গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো জেগেছে ফেসবুক, ট্যুইটার হোয়াটস
আপের মতো হাজারো সামাজিক মাধ্যম! পাশাপাশি বসে ভাবের আদান-প্রদান এবং কথা বলার অভ্যাসটাই নষ্ট করে দিচ্ছে এইসব যান্ত্রিক
ব্যাপার-স্যাপার। এর সঙ্গে অতি প্রগতিশীল বিত্তবাদী হওয়ার ঝোঁক নারী-পুরুষের স্বাভাবিক
ও দায়কে অস্বীকার করার প্রবণতা আরও গুলিয়ে তুলছে গোটা সমাজ ব্যবস্থাটাকেই। সব মিলিয়ে
হয়তো আমাদের চিরাচরিত সম্পর্কের বাঁধনগুলোই আলগা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রয়োজনীয় ঠেকছে
মানুষের কাছে। নিজের স্বার্থ, নিজের সুখ, নিজের ইচ্ছে, নিজের সুবিধেটাই বড় হয়ে উঠছে।
বাবা-মা ভাই-বোন, স্ত্রী-স্বামীর মধ্যে সমাজ ছাড়িয়ে যে স্নেহ মায়া-মমতার বাঁধনটা ছিল
এতদিন, তা শিথিল হয়ে পড়ছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসার সম্পর্কগুলো বেসামাল হয়ে যাচ্ছে।
বাবা মায়ের মহিমা, সন্তানের ঐশ্বর্য, শিক্ষকের মান, গুণীর কদর, সহকর্মী, আত্মীয়-প্রিয়জনের
গুরুত্ব কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করছি না আমরা। আর তার পরিণতিতে কোথাও অপ্রীতিকর, মর্মান্তিক
কিছু একটা ঘটলে খানিক সন্দেহ, সমালোচনা আর পুলিশের ওপর দোষারোপ করে দায় সারছি। ব্যতিক্রম
নিশ্চয়ই আছে। স্বাভাবিক স্নেহপ্রবণ বাবা-মা আছেন, দায়িত্বশীল ছেলেমেয়েরা আছে, সহৃদয়
সজ্জন মানুষজনেরও অভাব নেই। কিন্তু, সেই ব্যতিক্রমের পর্দা দিয়ে আমাদের আজকের ক্রমবর্ধমান
উদভ্রান্তি-অস্থিরতা আর অসহিষ্ণুতাকে আর আড়াল করা যাচ্ছে কী? আমাদের স্নেহ-ভালবাসার
সম্পর্কগুলোর স্বাভাবিকতা যথাযথভাবে বজায় আছে জোর গলায় পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এমন
দাবিও কি করতে পারছি আমরা? নাকি আমাদের সম্পর্কগুলোর স্থায়িত্ব নিয়ে দিনের পর দিন সংশয়টাই
বাড়ছে, বেড়েই চলেছে? একটু ভেবে দেখার সময় এসেছে ।
তারুণ্য
বড় বেগবান। তারুণ্য বড়ই উদ্দাম। সেই তারুণ্য যখন ভ্রান্ত পথে ছুটে যায় কিংবা সেই তারুণ্যের
যখন অপব্যয় হয়ে যায় অথবা সেই তারুণ্য যখন মোমের মতো গলে যায়, তখন তা সত্যিই মর্মযন্ত্রণার
শামিল হয়। পরপর এই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে মনে
হয় এ কি শুধু তারুণ্যের দোষ? নাকি এই সমাজের কোনও অন্ধকার প্রশ্রয় তাদের ঠেলে দিচ্ছে
মৃত্যুর পথে! রাজনীতিকদের কোনও নিয়ন্ত্রণহীনতা বা নজরদারির অভাবই এইসব দুঃখজনক অবস্থার
উৎস নয়তো?
সাম্প্রতিক
অতীতের পরপর ঘটনাগুলোর দিকে তাকালেই তবে দেখা যাবে, তারুণ্যের ভ্রান্তি কিছু অমূল্য
প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। তাৎক্ষণিক অ্যাডভেঞ্চারিজমের নেশা তাদের বিপদ ডেকে আনছে। এইসব ঘটনা
অবশ্যই এড়ানো যেত। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকদের চোখ-কান খোলা থাকেনি। রাজনীতিকরা প্রকারান্তরে
এক ধরনের পশ্রয় দিয়েই তাদের এমন জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন, যেখান থেকে সন্তান এবং অভিভাবকদের
দূরত্ব অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। মাদকের প্রভাব আর যৌবনের হঠকারিতা তাদের জীবন থেকে সরিয়ে
দিচ্ছে অনেক দূরে। শুধু শোক এই বিপথগামিতাকে আটকাতে পারবে না। আমাদের আরও কিছু কর্তব্য,
আরও কিছু দায়বদ্ধতা থেকেই যায়। তারুণ্যের দীপ্তি তাদের সবকিছুকে উপেক্ষা করতে শিখিয়েছে।
শুধু দৌঁড়ালেই তো হয় না, থামতে শিখতে হয়। কোথাও কোথাও গতি কমাতে হয়। আমরা আমাদের সন্তানদের
উচ্চশিক্ষা দিতে চাই। আধুনিক জীবন দিতে চাই। ভালোভাবে বেঁচে থাকার আরাম দিতে চাই। কিন্তু
কখনও নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দিই না। প্রশমণের শিক্ষা দিই না। এটাই আমাদের জীবনের এক বিষাদরেখা।
বিগত
কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বেপরোয়া জীবন-যাপনের
ঝোঁক দিনদিন বাড়ছে। গতির জীবন তাদের টানছে। সেইসঙ্গে মাদক আসক্তি কিংবা মাদক গ্রহণের
একটা দুর্নিবার আকর্ষণ তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে নিয়ম না মানার প্রতি তীব্র
আকর্ষণ। হুল্লোড় জীবনের প্রতি টান। তারুণ্যের গতির শেষ ঠিকানা মৃত্যুই। তারুণ্যের জলতরঙ্গ
উন্মার্গগামী।
সেই
সঙ্গে বলতে হয়, সাধারণ মানুষের কিছু দায়-দায়িত্ব
থেকে যায়। ছোটদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বড়রা বহুক্ষেত্রে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
পড়েন। এই বিচ্ছিন্নতার অভিশাপ দূর হোক। তারুণ্যের গতি, তারুণ্যের বেগ শুভ কাজে লাগুক।
এই বয়সে যেভাবে বিরাট দুঃসাহসেরা উঁকি দেয়, তা তাদের জীবনকে বিপথে না টেনে রঞ্জিত করুক
মানবতার পথে এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
সর্বত্রই
একটা জাতি। তার মধ্যে ছোট-বড় ভেদের কোনও অর্থ হয় না। মানবজাতির ধর্ম কি? মানবধর্ম।
সকলেরই এক ধর্ম মানবধর্ম। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য ইত্যাদি কোন ভেদ এর শাস্ত্রীয় নাম
‘বর্ণ’। ইংরেজ, জার্মান, ফরাসী জাতি এ ঠিক নয়। এসব জাতির ধর্মও আলাদা নয়। মানবজাতির
একটাই ধর্ম মানবধর্ম। এ ধর্ম বাদ দিলে সর্বনাশ। আপনি আর মানুষই রইলেন না। একথা যদি
বলি শিক্ষা হবে ধর্মহীন, তাহলে বুঝব ঐ শিক্ষায় মানুষ গড়বে না। ছাত্র-ছাত্রীদের মনুষ্যত্ব্
হবে না। শিক্ষায় ধর্ম থাকবে না মানে, এ শিক্ষায় যারা শিক্ষিত হবেন তারা মনুষ্যত্ব লাভ
করবেন না। সাবধান হোন! মনুষ্যত্ব লোপ পেয়ে যাবে। স্টেট হবে ধর্মহীন, তার অর্থ হ’ল স্টেট
যে হবে অর্থাৎ যারা শাসন করবেন তাদের কোন ধর্ম থাকবে না। মানুষের মনুষ্যত্ব না থাকার
ফলে মানুষ চুরি করবে, মিথ্যা কথা বলবে, পরকে হিংসা করবে, পরের ক্ষতি করবে। অতএব তার
জন্য তৈরী হউন। মনুষ্যত্ব বাদ দিয়ে কোন প্রতিষ্ঠান তৈরী করাও যা, অ্যাটম বোমা দিয়ে
সব শেষ করে দেয়াও তাই। যারা এসব কথা বলেন তারা হয়ত ধর্ম কি তা বোঝেন না। কি করে বোঝাব
বলুন তো? বড় বড় লোক বলছে, তাদের কথাই বা অস্বীকার করি কী করে? বাংলা ধর্ম বলতে যা বোঝায়
ইংরেজি ‘রিলিজিয়ান’ তা বোঝায় না। শাস্ত্রের ভাষায় কিংবা মহাপুরুষদের ভাষায় মনুষ্যত্বের
দু-তিনটি সংজ্ঞা আছে। সবচেয়ে ছোট সংজ্ঞাটি: ‘অহিংসা সত্যমস্তেয়ং শৌচং সংযমমেব চ।/ এতৎ
সামাসিকং প্রোক্তং ধর্মস্য পঞ্চ লক্ষণম্।।’ মনুষ্যত্বের পাঁচটি লক্ষণ হলো চুরি না করা,
শুচি থাকা, হিংসা না করা, সংযমী হওয়া এবং সত্যাশ্রয়ী হওয়া। অহিংসার ব্যাখ্যা তো গত
৫০ বছর বিরাট ভাবে হয়েছে। অহিংসার মূর্ত আচার্য জীবন দিয়ে অহিংসার ব্যাখ্যা করেছেন।
মহাত্মা গান্ধীর কথা বলছি। অহিংসার অর্থ মানুষকে হিংসা না করা অর্থাৎ মানুষকে ভালবাসা,
মানুষকে শ্রদ্ধা করা, মানুষকে মানুষ হিসাবে সম্মান দেয়া এই তো অহিংসা। হিংসা তো পশুর
ধর্ম। রাস্তা দিয়ে একটা কুকুর যাচ্ছে, আপনার বাড়ির কুকুরটি তাকে দেখে ঘেউঘেউ করে উঠল,
আশ-পাশ থেকে আট-দশটা কুকুর এসে রাস্তার মধ্যে শুরু করে দিল কামড়া-কামড়ি রক্তারক্তি।
এ নিছক কুকুরের ধর্ম। আপনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, পাশের বাড়ির লোক বেরিয়ে এসে আপনাকে
মারতে আরম্ভ করল, ক্রমে বহু লোক লোক জমে বিরাট মারামারি হয়ে গেল। এখন যদি বলি, মানুষগুলো
কুকুরের ধর্ম ছাড়তে পারেনি তাহলে খুব অন্যায় হবে কি? মানুষ আজ সভ্যতার গর্ব করে। আকাশে
উড়ছি, চাঁদে যাচ্ছি, জলের তলায় মাছের রাজ্য দখল করেছি, কিন্তু রাস্তা দিয়ে মানুষের
মত হাঁটতে শিখিনি। মানুষকে মানুষের মর্যাদা, প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন