বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৭

দর্শন আর উপলব্ধিতে বেরিয়ে আসছে জাতীয় সত্য

দর্শন আর উপলব্ধিতে

বেরিয়ে আসছে জাতীয় সত্য

সংলাপ ॥ ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’। অসহনীয়হলেও রাজনৈতিক মিথ্যাচারের সাথে বসবাসরত এদেশের মানুষ পেল একটি সত্য। দেরিতে হলেও পাওয়া এ সত্যকে পরমসত্যে পরিণত করার দায় বাঙালি জাতির। এখনও অনেকসত্যবের হয়েআসেনি জাতির সামনে। আশা করা যায়এভাবেই অদূর ভবিষ্যতে এক এক করে সত্য বের হয়েআসবে।
যখন-তখন রাজনীতিকদের কাছ থেকে অনেক বিবৃতি আসে দেশবাসীর সামনে।অতি চেনা বিবৃতিটি হলো ‘জনগণকে অভিনন্দন’ আর সরকারি দল তার পাল্টা বিবৃতি দিয়ে ‘অভিনন্দন’ জানায় একই জনগণকে। সবকিছুতেই রাজনীতিকরা দাবী করে থাকেন যে জনগণ রয়েছে তাদের সাথে।পরস্পর বিরোধীসব রাজনৈতিক দলই তাদের সবকিছু করে থাকে ‘জনগণের’ নামে।‘জনগণ চাচ্ছে’, ‘জনগণবলছে’, ‘জনগণ প্রত্যাখ্যান করছে’, ‘জনগণ সাথেআছে’ অর্থাৎ সবকিছুতেই ‘জনগণ’। কিন্তু সত্যটি বের হয়ে আসে না।
বছরের পর বছর, দশকের পর দশক এদেশে এভাবেই রাজনীতিকরা ‘জনগণে’র নাম করে নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, নিজেদের পছন্দ-অপছন্দকে জায়েজ করে আসছেন।নিজেদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর নিজেদের দলীয় গোষ্ঠীস্বার্থের সংঘাত সবকিছুই চালিয়েযাচ্ছেন ‘জনগণে’র নামে এবংপরিশেষেতা চাপিয়েও দিচ্ছেন ‘জনগণে’রই উপর। এর মধ্যদিয়েপালা করে ক্ষমতায়যাচ্ছেন রাজনীতিকরা, ক্ষমতাকে ব্যবহার করে আখের গুছিয়ে নেন নিজেদের। আর জনগণপড়ে থাকে সেই একই তিমিরেই।
প্রশ্ন হচ্ছে,জনগণ কি স্বার্থের হানাহানির এই রাজনীতিতে, রাজনীতিকদের সঙ্গে কখনও ছিলো? বিবাদমান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আজও কি জনগণ আছে? এ নিয়ে কোনো সামাজিক গবেষণা নেই।ফলে গবেষণালব্ধ কোন উদ্ধৃতি দেয়া সম্ভব নয়।কিন্তু সাধারণপর্যবেক্ষণ ও বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায়রাজনীতিকদের সঙ্গে আছে ক্ষমতার হালুয়ালোভী অথবা ক্ষমতার হালুয়া প্রত্যাশী কিছু সহকর্মী - কর্মীছাড়া সাধারণ জনগণকেবাইনোকুলার দিয়েওখুঁজে পাওয়া যাবে না।
এদেশের রাজনীতিকরা দলীয় নেতা, জননেতা নয়।এদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য ক্ষমতা, জনতা নয়।রাজনৈতিক দলে তাই জনগণ নেই।রাজনৈতিক দলের কর্মসূচীতে জনস্বার্থ নেই। তাই জনসম্পৃক্ততাও নেই। রাজনীতিকদের দলীয়কর্মী পুষতে হয়অর্থ আর নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে।রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশকরতে হয় ট্রাক আর লোক ভাড়া করে। সমাবেশ হয়েউঠে দলীয়সমাবেশ।জনগণতাদের কোন সমাবেশ বহুকাল দেখেনি। জন দাবী নিয়ে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন ডাক দিলেন জনগণকে, লাখলাখ জনতা তখনই সমবেত হলো সেখানে। গণআকাক্সক্ষা অর্থাৎ সত্যটি যখন উচ্চারিত হলো ময়দানে, দেশের কোটি কোটি জন সমর্থনের ঢেউ উঠলো সারাদেশে প্রজন্ম যোদ্ধাদের সমর্থনে। জনসমুদ্রের গর্জনে হয়ে উঠলো স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ।
প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে নতুন শতাব্দীতে। মহাকালের অতল গর্ভে হারিয়ে গেছে বিংশ শতাব্দী। বিদায়ী শতাব্দীতে অর্জিত বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সব সাফল্যের পথ বেয়ে পৃথিবী উপনীত হয়েছে এক নতুন যুগে-নতুন সভ্যতায়, যাকে বলা হচ্ছে ডিজিটাল সভ্যতা।
বাঙালি জাতির জীবনে সবচাইতে বড় সত্য একাত্তরের বিজয়। কেবল চলমান শতকেই নয়, হাজার হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসে বোধকরি শ্রেষ্ঠ বিজয়। শ্রেষ্ঠ সাফল্য। এক অবিশ্বাস্য রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ, লাখ-লাখ মানুষের জীবন ক্ষয় আর কোটি বাঙালির অতুলনীয় ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল সেই বিজয়। শুধু বাঙালির ইতিহাসে নয়, বিশ্ব ইতিহাসের পাতায়ও বাঙালির এই মুক্তিযুদ্ধ এক বিস্ময়কর সংযোজন। গোটা পৃথিবী সেদিন তাকিয়ে দেখেছিল সবিস্ময়ে - কেমন করে সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত একটি শক্তিশালী ধর্মান্ধ সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়িয়েছিল সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র মানুষের সহযোগিতায় তৎকালীন প্রজন্ম। মৃত্যু দিয়ে মৃত্যুকে ঠেকানোর পণ নিয়ে মরণ খেলায় মেতে উঠেছিল আবালবৃদ্ধ জনতা। অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিল অবশেষে। স্বাধীনতার বিজয় তিলক এঁটে বিশ্ব মানচিত্রে করে নিয়েছিল আপন ঠাঁই।
২০১৭ সনে উপনীত বিশ্ব যখন তথ্যপ্রযুক্তির সভ্যতার সাফল্য আরো বিস্তৃতির প্রচেষ্টায় রত তখন স্বাধীনতার এত বছরের পর স্বদেশের স্বভূমির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে জাতিকে! ফেলে আসা অতীতের চিত্রে একে একে ফুটে উঠে চোখের সামনে প্রিয় স্বদেশের পীড়াদায়ক বর্তমানে। স্বাধীনতা দিবসে উড্ডীয়মান বহু ব্যবহৃত অযত্নে রক্ষিত ফ্যাকাশে জাতীয় পতাকায় ভেসে ওঠে স্বদেশের ছবি। সাধক নজরুলের ভাষায় -
‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলে আমরা তখন বসে/
স্ত্রী তালাকের ফতোয়া খুঁজি ফেকাহ্ হাদিস চষে।’
বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে সাধক নজরুল যা বলেছিলেন দুঃখ করে, আজ এতো বছর পেরিয়ে ’৭১ এর বিজয়ের পরও তা কত প্রাসঙ্গিক! কত বাস্তব! বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে ধর্মান্ধদের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব। সাথে রয়েছে সন্ত্রাস, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ। সীমাহীন লজ্জা আর দুঃসহ গ্লানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছে জাতির বিবেক।

গন্তব্য কোথায়? সাধারণ মানুষতো দূরের কথা বোধকরি রাজীতিকরাও জানেন না! ক্ষমতার মন্ত্রে সমর্পিত জাতীয় নেতৃত্ব পারছে না দেশকে আদর্শিক পথে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে। কেবল আনুষ্ঠানিকতার সাজানো ছকে কি পালিত হবে জাতীয় দিবসগুলো! নেই আত্মোপলব্ধি, আত্মসমালোচনা, অর্থপূর্ণ অকপট মূল্যায়ন। ‘এদেশে অন্ধ অন্ধকে পথ দেখাচ্ছে, ভ্রান্ত ভ্রান্তকে উপদেশ দিচ্ছে’ এ সত্যই ক্রমশ ফুটে উঠছে প্রতিনিয়ত আরো বেশি করে। পরিকল্পিত অসত্যের ধুম্রজালে ঢেকে যাচ্ছে সামনে চলার পথ। বিভ্রান্ত হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে চলার পথ। জাতির অস্তিত্ব হয়ে উঠছে হুমকির সম্মুখীন। সাধক নজরুলের ভাষায় যাকে বলা যায়, ‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ। ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত।’ সঙ্গত কারণেই ষোল কোটি মানুষের সামনে উপস্থিত যুগের নতুন চ্যালেঞ্জ। ‘হয় টিকে থাক - নয় শেষ হয়ে যাও’ এই বার্তা ধ্বনিত হচ্ছে চারদিকে। বলার অপেক্ষা রাখে না এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার কোনই বিকল্প নেই জাতির সম্মুখে। উপায় নেই সত্যকে মেনে নেয়া এবং সর্বস্তরে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন