বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৭

নববর্ষে বাঙালি!

নববর্ষে বাঙালি!

সংলাপ ॥ পাঁচ হাজার বছরের বাঙালি জীবনে পাতা উল্টে আরো একটা বছর চলে গেল বাঙালি জীবন থেকে। যদিও গণনা ও সংখ্যার আবিষ্কার অনেক পরে এবং সেই সংখ্যায় আরো এক যুক্ত হয়ে বাংলা সন দাঁড়ালো ১৪২৪-তে। নতুন বছর এলো। নতুন বছরের কাছে আমরা নিবেদন করি। অনেক অনেক স্বপ্নের আবেদন জানাই। আশার জল তরঙ্গে আমাদের নিত্য ডুব সাঁতার। ১৪২৩ চলে গেছে যেভাবে যাওয়ার। আমাদের স্মৃতি প্রবাহে অনেকেরই এ সালের চূড়ান্ত হিসাবে কিছু গরমিল থেকে গেছে। থাকবেই। এ নিয়ম লঙ্ঘনের নয়। আশা থাকলে আশাহত হতে হবে। কর্মেও হতে পারে ভুল। ভুল তো কর্মীর জীবনে উত্তরণের সিঁড়ি।
নির্মাণে ১৪২৩ বাঙালির হতে পেরেছিল কি? হতে কি পারবে ১৪২৪? বাঙালির ঘরে জন্ম বলেই বাংলা নববর্ষ এলেই আমাদের উৎসব মুখরতা তীব্র হয়ে ওঠে। নিজে কতটা বাঙালি হতে পারলাম - এই শুভ চিন্তার স্থান দিই ক’জনা আমাদের মস্তিষ্কে? বাঙালির ঘরে জন্মালেই বাঙালি হওয়া যায় না। নিজেকে বাঙালি রূপে গড়ে তুলতে হয়। বাঙালি জাতীয়তাবোধ নিজের ভিতরে জাগ্রত রাখতে হবে সর্বক্ষণ। বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ থাকতে হবে। স্বদেশ ও স্বভাষার প্রতি মমত্ববোধ অটুট থাকতে হবে। তবেই নিজেকে বাঙালি বলে দাবি করবার অধিকার জন্মে। কার্যত আমরা কি তা পারছি?
বলতে দ্বিধা নেই, প্রবাসী জীবন- যাপন যারা করেন তাদের অনেকেই নিজেকে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিতে দ্বিধাবোধ করেন। তারা ভাবেন বাঙালি পরিচয় দিলেই তিনি চিহ্নিত হবেন একটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একজন এবং ধর্মান্ধ উগ্রবাদী হিসেবে। ভিখিরী জাত হিসেবে। যত দ্রুত সম্ভব তারা সম্পর্ক ছেদ করেন স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বভাষার সাথে। কেন এই সংকীর্ণতা? কোনোভাবেই কি তারা লুকাতে পারবে তাদের বাঙালি আকৃতি ও প্রকৃতি? পোষাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন, খাওয়া-দাওয়া, উৎসবে-আয়োজনে যতই তারা পাশ্চাত্যের অনুকরণ করুক না কেন, সে কোনোদিনই পাশ্চাত্যের একজন হতে পারবে না। এ দেশে বসবাস করেও অনেকে একই ভাবধারা পোষণ করেন। কথায় কথায় তারা অবজ্ঞার সুরে প্রায় বলে থাকেন - ‘দেখতে হবে না, এ তো বাঙালি জাত’। অথবা ‘বাঙালিরে হাইকোর্ট দেখান’ অথবা ‘এই দেশে কি মানুষ থাকে’? বাঙালি হয়ে জন্মানোটাই যেন তাদের কাছে আজন্মের পাপ বলে মনে হয়। অজ্ঞাতে ছুঁড়ে দেয়া থুথু তারা যে নিজেরাই নিজেদের মুখে লেপ্টে দিচ্ছে এই বোধ কি কোনো কালেই জাগবে না?
বোধ-এর ঘরে যতই তারা মরা থাকুক না কেন, তারা কিন্তু ঠিকই বিচরণ করছে ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতির অন্ধকার রাজত্বে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাদের হাতে বেজে উঠছে বিভেদের ঘন্টা ধ্বনি। অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্যে অথবা স্বার্থবাদী ধর্মের কলে অথবা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে বাঙালি বিরোধে জড়ায় বাঙালির সাথে। জাতীয়তাবোধে ফাটল ধরলে মানবিকতা সেখানে অনুপস্থিত থাকবেই। ভৌগলিকভাবে স্বাধীন দেশে বাস করে যেমন আমরা বলতে পারি না ‘আমরা মুক্ত’, তেমনি বাংলাদেশে বাস করে বলতে পারি না ‘আমরা বাঙালি’। ‘আমরা বাঙালি’ না ‘আমরা বাংলাদেশী’ না ‘আমরা মুসলমান’ না ‘বাঙালি মুসলমান’ - এই রাজনৈতিক বিতর্কে আমাদের অমিমাংসিত ঔদ্ধত্য দিন দিন সীমা অতিক্রম করে চলেছে। উত্তপ্ত রাজনীতির কেন্দ্রীয় লক্ষ্য যেহেতু ক্ষমতা দখল, সেহেতু দেশপ্রেমের প্রশ্নটা এখানে অবান্তর। ক্ষমতার গর্ত থেকে চোখ তুলে এরা সময় পায় না জাতির বৃহত্তর স্বার্থের দিকে তাকাবার। কর্তা ব্যক্তির পদলেহনে এরা ব্যস্ত। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের স্বীকৃতি পেতেও তাই আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। কিন্তু বাংলা সনের সরকারী ব্যবহার এখনো সর্বক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সরকার হয়ে যারা এসেছেন এবং যারা আছেন, তারা কি বাঙালি নন? কোন্ কারণে তবে বাংলা সনের ব্যবহার এতো উপেক্ষিত?

প্রতি বছরই ১লা বৈশাখকে বরণ করে নিচ্ছি বাহারী উৎসবে। এই একদিনে আমরা আপাদমস্তক বাঙালি হয়ে ওঠার দুর্নিবার সাধনায় মত্ত হয়ে উঠি। পোষাকে, খাবারে, গানে, বক্তৃতায় তথা আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় আমরা এদিন পুরোদস্তুর বাঙালি। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়, উপজেলায়, গ্রামে-গঞ্জে বর্ষবরণ উৎসব জমে ওঠে। বৈশাখী মেলায় মুখর হয়ে ওঠে বাংলার গ্রাম ও শহরগুলো। সামর্থ বিশেষে সকলেই অন্তরে লুকায়িত বাঙালিত্বে আলোড়িত হই। কিন্তু দিন ফুরোলেই আবার ফিরে যাই পুরাতন বৃত্তে। কোনো বৈশাখী ঝড় আমাদের ভিতর যদি জাতীয়তাবোধকে জাগাতে না পারে, তবে কতটুকু লাভ শুধু বর্ষবরণের উৎসবে মেতে থাকায় এবং কতটুকু লাভ এক দিনের কৃত্রিম বাঙালি সাজায় তা ভেবে দেখার সময় এসেছে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের জন্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন