বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৭

স্বদেশ ভূমির প্রতিটি কণায় বৈশাখ বুনো

স্বদেশ ভূমির প্রতিটি কণায় বৈশাখ বুনো

মঙ্গল শোভাযাত্রায় ঘাতক শক্তিকে রুখে দেবার প্রত্যয় ॥ গগণবিদারী আওয়াজে প্রকম্পিত গোটা দেশ ॥ প্রতিটি রেষ্টুরেন্টে, শপিংমলে, শিশু পার্কগুলোতে বিশেষ প্রণোদনার আহ্বান ॥
মাটির অনেক গভীরে থাকে স্বর্ণদানা
সেখানে যেতে কারোরই তো নেই কো মানা
পেতে চাও যদি স্বর্র্ণদানা তবে কপাট খোলো
স্বদেশ ভূমির প্রতিটি কণায় বৈশাখ বুনো ॥ 
নজরুল ইশতিয়াক ॥  বৈশাখ বাঙালি জীবনে সত্য হয়ে উঠেছে। বৈশাখের উদ্ভাসিত আলোয় পরিষ্কার হয়ে পড়েছে বাঙালির আত্মপরিচয়। দারুণ জাগরণ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়েছে গোটা জনপদ। চারুকলায় মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে ঘাতকের বিচার। হাজারো রঙের মিশেল দেখেছে গোটা বিশ্ব। ইউনেস্কোর তালিকায় আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। পশ্চিম বাংলায় মঙ্গল শোভাযাত্রা রঙ ছড়িয়েছে। ভারতের বুকে পশ্চিবঙ্গের এই নব আয়োজনের যোগান দিয়েছে আমাদের চারুকলার বন্ধুরা। একই দিনে কিভাবে উভয়স্থানে বৈশাখ উদ্যাপন করা যায় তা নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। বাঙালির নববর্ষ উৎসব চলতে শুরু করেছে সরল রেখা ধরে, ফলে বক্ররেখায় যারা রয়েছে তারা ছিটকে পড়ছে। ঘাতকচক্রের সমস্ত ভয়ভীতি হুমকি হালে পানি পাচ্ছে না। চরম অসহায় আর্তনাদে ঘাতকচক্রের আস্ফালন মুহুর্তেই বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায়-রাস্তায়, ঘরে-ঘরে শিশু, বৃদ্ধদেরবৈশাখী সাজ ছিল চোখে পড়ার মতো। লুপ্তপ্রায় মৃৎশিল্প, কুটিরশিল্প, লোকজ নিত্য ব্যবহার্য্যদ্রব্য, গ্রামে গ্রামে মেলা গান-বাজনায় ছিল বাধভাঙা উচ্ছ্বাস। রাজধানী ঢাকার লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে গেছে গ্রামে নিকট পরিজনের কাছে। ফেলে আসা পথে, চেনা নদীতে নৌকায় ঘুরেছে সন্তান সন্তুতিদের নিয়ে। ছায়ানট পালন করেছে ৫০ তম বর্ষবরণ। এই প্রথম তারা যুক্ত করেছে ফোক গান। বেড়েছে উৎপাদন, বেড়েছে কর্মযজ্ঞ। ১০ হাজার কোটি টাকার বৈশাখী বাজার সমৃদ্ধ করেছে জাতীয় অর্থনীতি। সৃজনশীলতার উৎসধারা প্রচন্ড গতিশীল। জাতি পরিচয়ের বিতর্কে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে ঘাতকচক্র। টেলিভিশনগুলোতে, পত্র পত্রিকায় ছিল নানা বর্ণিল আয়োজন। বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানীগুলো বৈশাখী আয়োজন করেছে। বিদেশের বহু বন্ধু ভীড় করেছে রমনায়, ছায়ানটে। তাদের সবার মুখে ছিল ঘাতক মুখোশধারীদের বিচারের দাবী। তাদের আহ্বান ছিল উগ্র-সাম্প্রদায়িকতামুক্ত দেশ। তাদের চোখেমুখে ষ্পষ্টতই তীব্র ঘৃনা, দেখা মিলেছে সব পশ্চাৎপদ অপশক্তির বিরুদ্ধে। পরস্পর দারুণ আস্থায় হাতে হাত রেখেছে। সব রাজনৈতিক দলও বৈশাখ উদ্যাপন করেছে। যারা বৈশাখ মানে না, বৈশাখ নিয়ে রাজনীতি করে তারাও বাধ্য হয়ে মিলেছে এ আয়োজনে। যারা গান গাইতে জানে সেই সব অনুৎপাদনশীল রাজনীতিজীবীদেরও দেখা গেছে তাল মেলাতে। দারুণ অবিশ্বাসমুখে অসহায় উদ্বিগ্নতায় মহল্লার ধর্মজীবীরা তাকিয়ে থেকেছে। মানুষের বিপুল বিস্ফোরণের কাছে পরাজিত হয়েছে ঘাতক আস্ফালন। 
নববর্ষ প্রকৃতপক্ষে নববর্ষা। বরিষণ বিনে চাতক বাঁচে না। মরুভূমিতে প্রাণ জন্মে না। সিঞ্চনে, রস সঞ্চারণে কর্ষণে, সেচে প্রাণের বেঁচে থাকা, টিকে থাকা, সমৃদ্ধ হওয়া। চেতনায়, জাগরণে, বিপুল বিস্ফোরণে মহাকরণীক সত্য হয়ে আসে নববর্ষ। যদি তুমি সিক্ত হও, তোমার ধমনীতে শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হয় চেতনার দোতনা। যদি তুমি নিজেকে  খুঁজে পাও, হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মেলাও পরম মমতায়, জড়িয়ে ধরো মানবতাকে তবে তুমি নববর্ষ। তুমি প্রতিভাত, উদ্ভাসিত, নবকল্লোলে অভিসিক্ত। স্থান-কাল-ভূগোল সত্য, মাটি সত্য , বায়ু সত্য, সত্য জল ধারা, পরম্পরা, আবহমানকালের ধারায় যোগ-সংযোগের বর্ণময়তা।  ফলে নববর্ষ কেবল একটি বর্ষ নয়। নানা রঙে রাঙানো সুশোভিত কারুকার্যমন্ডিত মহা-উপাখ্যানের বর্ণিল সম্ভার-সম্ভাবনা। কাল-মহাকাল যা-ই বলি না কেন, বর্ষের বুকে কত শত সৌরভ, সুন্দর, অনুভূতির হাজারো মিশেল। বর্ষ গণনার হিসেব-নিকেশের ইতিহাসের পাতায় যা-ই লেখা হোক না কেন, নববর্ষ সব তিথির মহা তিথি হয়ে চলমান, বহমান মহাস্রোতধারা। বর্ষ সঞ্জিবনী সুধা। শেকড়ে নবদ্যূতি নবায়ন। নববর্ষ আত্মপ্রকাশের সুতীব্র অহংকার মথিত দুর্বিনীত উদ্ধত অহংকার । এটি শত সহস্র বছরে লালিত এক মহাবিস্ফোরণের নাম। জাতি চেতনার বিপুল সৌন্দর্যের যোগসূত্র নববর্ষ। নিজেদেরকে শনাক্ত করে নিজেদের সত্যকে উর্দ্ধে তুলে ধরার এ এক দুর্বার, দুর্বিনীত, আপোষহীন আস্ফালন। পিছন ফিরে তাকানোর কোন অবকাশ দেয় না। হারানোর পালানোর কোন সুযোগ নেই। বারবার প্রকাশ্যে বলে যায় ‘এসো নতুনেরে করো আলিঙ্গন’। যা কিছু করতে চেয়েছো পারোনি - তা নিয়ে আফসোস কিসের? দেখ আবার জাগ্রতদ্বারে নিজেকে নির্মাণ করে প্রবল খরতাপে। আমাদের নববর্ষ -নওরোজ নয়, কোন হিমালয় থেকে ছুটে আসা জলধারামাত্র নয়, নয় কেবলই খই-মুড়কীর আবেগী আমেজ। বরং বাঙালির উৎস থেকে মোহনায় ছুটে চলার গভীর অনুসন্ধানী প্রকৃষ্ট গতিময়তা। দেখার অন্তহীন অণুবীক্ষণ। প্রচন্ড খরতাপে দহনের রুদ্র কাঁপন নিয়ে আসে। বাংলা নববর্ষ আমাদেরকে শক্ত হাতে বৈঠা মারার আহ্বান নিয়ে আসে। বাংলা নববর্ষ আসে প্রচন্ড খরাকে জাত্যাভিমানের শক্তি দিয়ে সহনীয় করার তাগিদ নিয়ে। আসে কঠিনকে স্বত:স্ফূর্ততা দিয়ে, সম্মিলন দিয়ে মোকাবেলা করার প্রেরণা নিয়ে।
বাঙালি জাতির চিরায়ত বিকাশে প্রাণ জাগানিয়া জাগরণ আমাদের বৈশাখ। মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেখিয়ে দেয় একে অপরের কত চেনা, কত বিপুলায়তন ঐশ্বর্যের আধার বাঙালির প্রাণ সম্পদ। যে বাঙালি জাতি ইতিহাস রচনা করেছে, অবিচল আস্থায় পাড়ি দিয়েছে শত সহস্র বছরের পথ, সেই বাঙালি বাধভাঙা উচ্ছ্বাস আর স্বতঃস্ফূর্ত শিহরণ নিয়ে আনন্দে মাতে। বর্ষার মাদলে মাছেরা যেমন খেলা করে। বর্ষাস্নাত নদীর বক্ষে স্রোতস্বিনী ঢেউ যেমন আছড়ে পড়ে। কি দারুণ সুখে ফুলেরা ঘোর ফাগুনে বাতাসে বাতাসে দোল খায়। ঝিঁঝিঁ পোকারাও বনে বাদাড়ে আলোর মশাল জ্বেলে আনন্দ করে। আর বৈশাখে প্রাণ মন ছুঁয়ে যায় । আহা কত সত্য, কত সুন্দর, কত বর্ণিল আমাদের বৈশাখ। এটি বাঙালির পরম্পরা স্মারক চিহ্ন। এটি সংকেতবাহী জাগ্রতযান। এটি বিচারিক পর্যালোচনার প্রয়োজনকে সামনে আনে। এটি সহজ সত্যকে সহজে প্রতিস্থাপন করে। এটি আবহমান কালের ধারা পরম্পরাকে পুনর্নির্মাণের  মাহেন্দ্রক্ষণে হাজির করে। একটি বুনন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করে। আত্মবিশ্লেষণ, দিন-দুনিয়া, জগৎ, বিশ্লেষণ, সংযোগ, সম্পর্কের বহুমাত্রিক পথরেখার মিলন মোহনা নববর্ষ। স্মরণ করিয়ে দেয় এই তো আমি, এই তো তুমি, আমি-তুমি আমরা সবাই একই ছাতার নিচে, একই বৃক্ষতলায় আত্মপরিচয়ের সুতীব্র অহংকারে মেলে ধরেছি নিজেদের। বাস্তবতা যাই হোক না কেন, তবু সবকিছু ছাপিয়ে সেই সুরই বেজে উঠে-আজ কোন বিভেদ নেই, নেই কোন জাতপাত, ভেদবুদ্ধির বাছবিচার। আজ কোন বর্ণবৈষম্য নেই, নেই কোন বৈরিতা। সবাই এক সুরে, এক ভাষায়, এক ছন্দে, কন্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে নিজেদেরকে তুলে ধরেছি বিশ্বসভার স্বর্ণ শিখরে।
বাঙালির বৈশাখ বরণ পথপরিক্রমা কতই না সমৃদ্ধ । শত-সহস্র বছরের সম্প্রীতি, ঔদার্যতা, প্রেম ও ভাব বন্দনার ধারাবাহিকতা বহন করছে আমাদের বৈশাখ। খুব চেনা, খুব জানা এই সম্প্রীতির উত্তরাধিকার আমরা। 
রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মের নামে যারা বৈশাখ উদ্যাপনের বিরোধিতা করে তারা জাতি হত্যার ঘাতক। কেবল মুখোশ মিছিলে ঘাতক বিকৃত হায়েনাদের প্রতিচ্ছবি দেখালেই হবে না। আজ সময় এসেছে সব অপশক্তির মূলোৎপাটন করার। সাহসী উচ্চারণে মুখোশধারীদের তালিকা ধরে ধরে ছুঁড়ে ফেলে দেবার। গগণবিদারী আওয়াজে প্রকম্পিত হোক শাহবাগ, রমনা থেকে পুরো বাংলা। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে চিকা পোষ্টারে ভরে যাক, উন্মোচিত ঘাতকদের কদর্য চেহারা। দেশের কর্তা ব্যক্তিদের ভবনে ভবনে বসুক নব জাগরণের মিলনমেলা। প্রতিবেশী শৈশবের বন্ধুরা নিমন্ত্রণ পাক। একসাথে বসে খাওয়া-দাওয়া সেরে  মিলেমিশে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো আওড়িয়ে ক্ষণিক সময়ের জন্য দেখে নিক একে-অপরকে। শিশু পার্কগুলোতে দেয়া হোক বিশেষ প্রণোদনা। প্রতিটি বাঙালি রেষ্টুরেন্টে বিশেষ ছাড় দেয়া হোক।
যারা পবিত্র ইসলাম ধর্মের নামে বৈশাখ উদ্যাপন নিয়ে টালবাহানা করে তাদের ঘাতক পরিচয়ের উৎসমূলে আঘাত হানতে হবে। দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষকে মনুষ্যত্ব বিনাশী এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে। ইতিহাস সাক্ষী পৃথিবীর মানুষ আজ যেখানে দাঁড়িয়ে সভ্যতার  স্তুতি গান করছে তা তো নানান পার্বণ, নানান মিলন মেলার হাজারো মেল বন্ধন থেকে উৎসরিত। বিশ্বের প্রতিটি জনপদের মানুষ যখন নিজেদেরকে একত্রিত করে দাঁড় করিয়েছে মুখোমুখি তখনই সম্প্রীতি, দায়বোধ, দেশপ্রেম, মানবতা জাগ্রত হয়েছে। আজকের যে ছোট পৃথিবী তাতো সংযোগ স্থাপনের পথপরিক্রমা মাত্র। দেশ-কাল-ধারণা সব উৎসব থেকেই সৃষ্ট। সাঁইজী বলেছেন - ‘এক চাঁদেতে জগত আলো, এক বীজে সব জন্ম হল’। নিত্যানন্দ পেতে হলে গৌড়ের সাথে করো সম্বন্ধ। বেঁচে থাকা ভালো থাকা, অনিশ্চয়তাকে দূর করার সম্মিলিত, পরিকল্পিত প্রচেষ্টার নামই তো সভ্যতা। এখানে যা হবে, যা করা হবে সবই দূরত্ব ঘুচিয়ে, বৈষম্য কমিয়ে পাশাপাশি থাকার প্রেম থেকে। মানুষকে দিয়েই স্রষ্টা সাজাতে চান এই মহাভূবন। নিরন্তর এই মহাযাত্রায় স্রষ্টা সব সময় মানবময় অস্তিত্বেই ধরা দেয়। তাইতো সাঁইজী বলেছেন - ‘এই মানুষ হবে মাধুর্য ভজন তাইতে মানুষ রূপ গঠলেন নিরঞ্জন’। সমৃদ্ধ বাঙালি জাতিকে তার জাতি সত্ত্বার গভীরে উৎসমূলে ডুব দিয়ে মণিমুক্তা সিঞ্চন করেই এগিয়ে যেতে হবে সম্মুখপানে। আউল, বাউল, ওলি গাউস কুতুবের এই দেশ, সত্য মানুষের এই দেশ, স্বশিক্ষিত মানুষের এই দেশ জগত সত্যের ধারক বাহক। এই বাংলা বিশ্ব জাগরণের নব অগ্রদূত। এখানে এসেই গোটা বিশ্ব জানবে জীবন ও জগতের সত্য, মানব জন্মের সত্য, স্রষ্টা ও সৃষ্টির সব সৌন্দর্যকে। এই বাংলায় শান্তির চাষ সমৃদ্ধ করবে নতুন বিশ্বের পীঠ। এখানে আসতেই হবে, বসতেই হবে বিশ্বের সব শান্তিপ্রিয় সৃষ্টিশীল অনুসন্ধিৎসু মানুষকে। কেবল মাত্র বাঙালির সামনেই ভবিষ্যৎ আর তাবৎ দুনিয়া পেরেশান হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে দারুণ খরায়। তবু এই বাংলার জল জমিনে থেকে যারা সেই সুর শোনে না তাদের প্রতি করুণা করা ছাড়া আর কি-ই বা থাকতে পারে। এই বাংলায় বসে বিশ্ব দেখা যায়। বিশ্বের যা কিছু সুন্দর, মহান, কল্যাণকর তা দেখি, মেনে নিই, সংযোগ স্থাপন করি এই বাংলার অন্তর্নিহিত উৎসে বসে- এটিই বাঙালির ধর্ম। বাঙালি মানুষ সহজ মানুষ, সত্য মানুষ। আমি যা দেখতে চাই, যা পেতে চাই, উর্দ্ধরণের মহা আসমানে বসে যে সৌন্দর্য অবলোকন করতে চাই তা বাঙালির বিশাল বক্ষে মহাভাবনায় পাখনা মেলে উড়ে আসে যত্রতত্র। এ এক অভূতপূর্ব দান পরম পিতার। এই বাংলায় ভাব সৌন্দর্য  চাইলেই নিজেকে মেলে ধরে। বৈশাখ আমাদের এক হতে বলে, প্রেম অনুভব করতে শেখায়, মানুষকে ভালবাসতে, প্রকৃতিকে চিনতে শেখায়। একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা সহযোগিতার আহবান জানায়। ফেলে আসা সব সত্য পথের, সব প্রাপ্তির সৌন্দর্য আস্বাদন করতে আহ্বান করে। ‘সবার উপরে সত্য মানুষ সত্য’ - সেই সত্য সামনে নিয়ে আসে। ক্ষুদ্রতা, অজ্ঞতা ব্যক্তিস্বার্থের উর্দ্ধে এসে এই সুন্দর পৃথিবীকে জানতে শেখায়। ফুল ফসল হিসেব নিকেশের মধ্যে বৈশাখের সৌন্দর্য সীমাবদ্ধ নয়।
আমাদের হাল আমলের ধর্মপ্রতারকরা বৈশাখ বরণ করতে ভয় পায় হারিয়ে যাবার ভয়ে। কারণ তাদের পুঁজি পাট্টা নাই। তারা মূর্খ, পরিবর্তন ও আনন্দকে ভয় পায়। রঙ বেরংয়ের পোষাক আর সাজগোছকে তারা ভয় পায়। তারা কোন সৌন্দর্য দেখতে অভ্যস্ত নয়। সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে সব সুন্দর সব আলো দেখার পরিবেশে রাখলেও তারা অন্ধ মুক বধির, কোন কিছুই দেখে না। পবিত্র কুরআন বর্ণিত এরাই তারা যাদেরকে মহান আল্লাহ্ মুক অন্ধ বধির করে রেখেছেন ফলে তারা চাইলেও দেখতে পাবে না। এরা অভিশপ্ত। এরা নিজেদের সাথে নিজেরাই প্রতারণা করে। এ জন্য এরা ধর্ম প্রতারক। স্রষ্টা আমাদেরকে পছন্দ করেন, ভালবাসেন, সিরাতুল মোস্তাকিমের পথে, সত্যের পথে রেখেছেন। এটি স্রষ্টার অপার করুণা। বৈশাখ এখন রীতিমতো শত্রুতে পরিণত হয়েছে উগ্র ভন্ড প্রতারক ধর্মজীবীদের কাছে। তারা এতটাই বেপোরোয়া যে গণমাধ্যমে, প্রকাশ্যে বৈশাখ বিরোধী ফতোয়া দেয়। তাদের ঔদ্ধত্য এতটাই ভয়ংকর যে বৈশাখ বরণ করতে যেয়ে সাধারণ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়। ওয়াজ নসিহতে, মসজিদে প্রকাশ্যে বাংলা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অরুচিকর কথা বলে। স্বাধীন বাংলায় বসে পরাধীনতার কিচ্ছা শোনায়। এরা বাঙালির শেকড় উপড়ে ফেলতে চায়। কতটা অকৃতজ্ঞতায় ভরা তাদের জীবন, চিন্তা। এরাই বিপথগামী, এরাই যুগে যুগে, কালে কালে সত্য অস্বীকারকারী। এরাই মানবতা, সভ্যতার ঘাতক। এরাই উদীচী ছায়ানটে হামলা করে। রমনার প্রতিটি কোনায়, প্রান্তিক জনপদের বাঁকে বাঁকে, সরকারি প্রশাসন যন্ত্রে বর্ণচোরা ঘাতক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরা পান্তা-ইলিশের দাওয়াত দেয়। বাজার থেকে ৫০০-১০০০ ইলিশ কিনে ডিপফ্রিজে ভরে রাখে। কি নিদারুণ কৌতুককর তাদের পান্তা ইলিশ, ভুরিভোজ। ইতিহাস সাক্ষী দূরের গ্রামে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সহজ- সরল, ধর্মপ্রাণ মানুষ বৈশাখে মিলিত হয়ে আনন্দ করতো এবং আজও করে। বৈশাখের আগমনের জন্য মুখিয়ে থাকতো গ্রামের প্রান্তজন ব্যবসায়ী। বাংলাদেশে প্রায় ১২ শ’র বেশি মেলা বসে; বৈশাখী মেলা সবচেয়ে প্রাচীণ। এটি মানুষে মানুষে ঐক্যের প্রতীক হয়ে রয়েছে।

সম্প্রীতির এই পরম্পরা থেকে যারা বিচ্ছিন্ন করতে চায় বাঙালিকে তাদের ইতিহাস জ্ঞান নেই । যদিও নষ্ট-ভ্রষ্ট ধর্মজীবি বেনিয়াদের সব আওয়াজ মিলিয়ে যায় বৈশাখের সকালের তারুণ্যের জোয়ারে। তারুণ্যের অদমিত শক্তির কাছে মিথ্যা বারবার পরাজিত হয়, এটিই বাঙালির ধর্ম। সেই প্রাণপ্রাচুর্যে বৈশাখের সত্যের সংযোগ ঘটিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের, যারা জাতিপ্রেম, দেশপ্রেম, মানবপ্রেমের কথা বলি। প্রতিটি ঘর থেকেই শুরু করতে হবে সেই অভিযাত্রা। আমাদের বৈশাখ বরণ হয়তো রাজনীতির মারপ্যাচে কিছুটা মলিন হয়। বাণিজ্যিক আস্ফালনে নান্দনিকতা, স্বতঃস্ফূর্ততা হারায়। ধর্মের নামে অধর্ম আর ধর্ম প্রতারকদের হুংকারে রুষ্ট হয় তবু প্রাণ হারায় না। প্রতিটি সকালের মতই নতুন আমাদের বৈশাখ। প্রতিটি রাতের মতই গভীর নিস্তব্ধতার সত্য হয়ে ছুঁয়ে যায় সবাইকে। এই নদী, এই মাটি, এই চাঁদ, সূর্য, এই পাহাড়, বন-বনানী, পাখ-পাখালি এই যে হাজার রঙের প্রজাপতি, সুগন্ধি রুমাল সবই তো নববর্ষের উৎস স্বাগত সারথী। যতদিন একতারা থাকবে, বাংলার পথে ঘাটে গান, কবিতা থাকবে ততদিন বৈশাখ থাকবে। যতদিন একজন বাঙালি থাকবে ততদিন বৈশাখের স্রোতধারা বহমান থাকবে।  যততত্র যত জুয়াড়ীর আগমন ঘটুক না কেন বৈশাখ থাকবে। বর্ণচোরা, লুটেরা ঘাতকেরা যতই বিকৃত করতে চাক না কেন বৈশাখ স্ব-মহিমায় বারবার ফিরে ফিরে আসবে। বাঙালির আচরণেই তো বৈশাখ মিশে আছে।  সহজ-সরল মানবিক প্রেমের রাজ্যে বৈশাখ কেবল একটি মাস নয় বরং গভীর পরম্পরা স্রোতস্বিনী নদী। সাগরের ঢেউ, বাতাসের মৃদুমন্দ শিহরণ, অনুভূতি, উপলব্ধির বুকে বৈশাখ বেঁচে থাকে, প্রবাহমান থাকে। প্রেম সত্য - সত্য এই বাংলা। যেমন সত্য বাংলার পরিশ্রমী সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ; তেমন সত্য বৈশাখ। ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো।’ স্বাগত হে বৈশাখ ১৪২৪। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন