বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৭

দায়ীদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচার হোক দেশের হাওর অঞ্চল এখনও পানিতে তলিয়ে আছে

দায়ীদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচার হোক
দেশের হাওর অঞ্চল এখনও পানিতে তলিয়ে আছে

সংলাপ ॥ প্রকৃতির ওপর আঘাত করলে প্রকৃতিও আঘাত করে, প্রতিশোধ নেয়। এই প্রতিশোধের ধরণ ও প্রকৃতি হয়তো ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন হয়। তথ্য প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার এই সময়ে অধিকাংশ মানুষের চাওয়া-পাওয়া, লোভ-লিপ্সা, কামনা-বাসনা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, সে নিজেও জানে না তার আর কী প্রয়োজন। এই অতিরিক্ত চাওয়ার কারণেই প্রকৃতির ওপর হাত দিচ্ছে মানুষ। পাহাড় কাটছে, বাঁধ দিচ্ছে নদীতে, পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদির ব্যবহার মানুষকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মানুষকে নিয়ে গেছে এক জগতে, যার সাথে অনেক সময়ই প্রকৃতির বিস্তর ফারাক। একদিকে প্রকৃতির সাথে মানুষের সংযোগ-সম্পর্ক কমে গেছে, অপরদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। এর সাথে বড় সমস্যাটি হচ্ছে দুর্নীতি, কর্তব্যে অবহেলা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা প্রাকৃতিক অবস্থাকে আরও জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে।          
দেশের হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যায় ৯০ ভাগ ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়া, লাখ লাখ কৃষক পরিবারের  সর্বনাশ এবং এর কারণ হিসেবে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির খবর জেনে-শুনে আতঙ্কিত হতে হচ্ছে। কিন্তু এই অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে কে কে জড়িত সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো স্পষ্ট করে কিছু প্রকাশ করা হয়নি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, ‘আমি ভিক্ষা করে নিয়ে আসি, আর চাটার দল খেয়ে ফেলে’। বঙ্গবন্ধু ওই কথাগুলো এখন আরও বেশি স্মরণ হচ্ছে সচেতন ও বিবেকবান মহলে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হাওর অধ্যুষিত এই সাতটি জেলায় সংঘটিত এই বিপর্যয়ের জন্য শুধুমাত্র প্রকৃতি যে দায়ী নয় সে-কথা সংশ্লিষ্ট কারো কাছেই আজ অজানা নয়। খোঁজ নিলেই জানা যায়, হাওরাঞ্চলীয় এই জেলাগুলোর ফসল রক্ষায় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গতি নেই। প্রকল্প পাস হয়, অর্থ বরাদ্ধ ও উত্তোলন হয়। প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হয়। কিন্তু কাজে অগ্রগতি হয় না। মাঠ পর্যায়ের অনিয়ম, দুর্নীতি, রাজনৈতিক বিবেচনায় কাজ দেয়া ও তদারকী না থাকায় মূলত চলমান প্রকল্পগুলো ঝুলে আছে বছরের পর পর। ফলে উজানে সামান্য বৃষ্টিতে বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে যায় কৃষকের ফসল।
সাম্প্রতিক সময়ে হাওরাঞ্চলে বিভিন্ন বাঁধ ভেঙ্গে বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেদিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, কোন কোন পত্রিকায় দুই হাজার কোটি টাকার শস্য বিনষ্ট হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। আবার কোন কোন পত্রিকায় ৪ হাজার কোটি টাকার ধান নষ্ট হওয়ার খবর বেরিয়েছে। গত ৯ই এপ্রিল রাজধানীর ডিআরইউতে হাওর অ্যাডভোকেসি ফোরাম আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা-এই তিন জেলায় বিপুল পরিমাণ শস্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে হাওরের বাঁধ নির্মাণের সময় পর্যবেক্ষণের জন্য গত ১১-১৩ই মার্চ সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওর পরিদর্শন করা হয়। এ সময় দেখা যায়, বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর অর্ধেক কাজ অসম্পূর্ণ দেখা গেছে। বাঁধ নির্মাণের শেষ সময় ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহেও অনেক বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরুই হয়নি। বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার পর প্রাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গেছে-অনেক জেলায় দেরিতে কাজ শুরু হয়েছে। সময় মতো কাজ শেষ না হওয়ার ফলে অনেক বাঁধই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। 
হাওর অ্যাডভোকেসির সংবাদ সম্মেলনে এই ফসলহানির জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে অবিলম্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, হাওরের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো সঠিক সময়ে এবং টেকসই কায়দায় ফসল রক্ষা বাঁধ তৈরি এবং মেরামত না করা। এ কাজটি না করায় ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় আটবার হাওরের কৃষক তার ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। অথচ এই এক ফসলি বোরো ধানের ওপর হাওরবাসী নির্ভরশীল। অন্যদিকে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই বোরো ফসল পালন করে বিরাট ভূমিকা।
দেশের রাজধানী আর বিভিন্ন শহরে-বন্দরে, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে, ক্ষমতাসীন এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের কয়জন হাওরের এই বিপর্যয় ও তার প্রতিকার নিয়ে চিন্তা করেছেন, সময় দিয়েছেন? বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের রাজনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দুই ছিল দেশের সাধারণ মানুষের উন্নয়ন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দল যেহেতু ক্ষমতায়, সে কারণেই এই দলের নেতা-নেত্রীদের দায়ই সবচেয়ে বেশি। ক্ষমতার অংশীদার তো এরশাদের জাতীয় পার্টিও। আর একটি বড় দল বিএনপি, যারা ক্ষমতায় ছিলেন, আবারও যাওয়ার চেষ্টায় আছেন, তাদের কাউকেও হাওরাঞ্চলের এই বিপর্যয় নিয়ে কথা বলতে, দুর্গত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখা গেল না। এমনকি বর্তমানে হাওর অঞ্চল থেকে নির্বাচিত প্রায় ২৫ জন সংসদ সদস্যের কাউকেও কোন রা-শব্দ করতে শোনা গেল না। দেশের মানুষের প্রতি, জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য তারা কতটুকু পালন করছেন এ অবস্থা থেকে তা সহজেই বোঝা যায়।
রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ হেলিকপ্টারে করে কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। হাওরাঞ্চলের বর্তমান কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, সেখানকার প্রায় দুই কোটি মানুষ সামনের ধান কাটার আগেই নিরন্ন থেকে যাবে। মহাজনের ঋণ, কামলার বেতন পরিশোধ তো দূরের কথা পরিবারের মানুষের খাবারও তারা যোগাড় করতে পারবে না। অন্য দিকে তাদের ঘরের গরুবাছুর লালন-পালনও তারা করতে পারবে না। পশুখাদ্য বা খড় না থাকায় তারা এসব প্রাণীকে বাঁচাতে পারবে না। এখন তারা জমি গরু বাছুর বা জমিও বেঁচতে পারবে না। কেনার মানুষ পাবে না। দূরে নিয়ে গবাদি পশু বেঁচা গেলেও জমি বেঁচা অসম্ভব হয়ে পড়বে। (হাওরের কান্না শুনুন, মোস্তাফা জব্বার, দৈনিক সংবাদ, ১১ই এপ্রিল, ২০১৭)
এই পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী? খবরে প্রকাশ, ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন অতিরিক্ত প্রকৌশলীসহ (যিনি ২০১০-১১ সালে সুনামগঞ্জে বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন) তিনজন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে হাওরের ২৮টি ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ২৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলীকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গত ৯ এপ্রিল সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এক সভায় জেলার সুধীজন পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী, বিভাগীয় প্রকৌশলী ও সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলীকে তুলাধুনা করে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রকাশ্যে এই সব প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে।  দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন, দুর্নীতি হয়েছে কি-না তদন্ত করে দেখছেন। পানিসম্পদ মন্ত্রী পানি উন্নয়ন বোর্ডের কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে  বলে সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন।     

হাওরাঞ্চলের এই বিপর্যয়ের জন্য প্রকৃত দায়ী যে বা যারাই হোক তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচারের আওতায় আনা এবং ভবিষ্যতে যেন মানুষ-সৃষ্ট এই বিপর্যয় আর না ঘটে সে ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ আশা করে জাতির বিবেকবান মহল। এই জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে অবশ্যই অত্যন্ত সতর্ক হয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে, দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী, আমলা বা রাজনৈতিক নেতাকর্মী দেশের সরকার বা দলের সকলের জন্যই অকল্যাণ বয়ে আনে। অসৎ ও মিথ্যাবাদী দুষ্টচক্র দেশ ও সমাজের জন্য সব সময়ই ক্ষতিকারক। এ প্রসঙ্গে মহান সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর একটি বাণী স্মরণ করা যেতে পারে-‘বিশ্বাসঘাতকেরা নিজ নিজ কামনায় ধরা পড়ে’। রাজনীতিকদের কারও কারও মুখে আর ঠোঁটে আদর্শের কথা, সরকারের কর্মচারি হিসেবে সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পরেও কারও কারও  সীমাহীন অর্থ-বিত্ত উপার্জন ও ভোগ-বিলাসে আসক্ত থাকার কারণে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন যারা না করে থাকেন তারাও নিশ্চয়ই বিশ্বাসঘাতক, নিজের সাথে এবং দেশের সাথে, প্রকৃতির সাথে। এদেরকে ছাড় দিলে দেশ ও সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা আরও ভয়াবহ হয়ে দেখা দিতে পারে। তাই হাওরাঞ্চলের এই বিপর্যয়ের সঠিক কারণ বের করে জাতির সামনে সঠিক তথ্য তুলে ধরা আজ সময়ের দাবি। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন