সময়ের সাফ কথা....
ঐক্যের বার্তা মঙ্গল শোভাযাত্রা
‘বাংলা আমার দৃপ্ত স্লোগান, ক্ষিপ্ত তীর ধনুক
আমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ...।’
সংলাপ ॥ আরশিনগরের পড়শিরা ১৪২৪-এর প্রথম প্রভাত দুশ্চিন্তামুক্ত
রাখতে পারল। বাংলার আরও একটা নতুন বছর শুরু হয়ে গেল। ১৪২৪।
এখন অবশ্য পয়লা বৈশাখের মতো হাতে গোনা কয়েকটা দিন
ছাড়া বাংলা বছরকে বিশেষ কেউ মনে রাখেন না। রাখবেন কেন? আমাদের আজকের জীবনে বাংলা বছর
আর কোথায় লাগে? পারিবারিক, সামাজিক কিছু অনুষ্ঠান
ছাড়া বাঙালির আর কী-ই বা বাংলা সাল তারিখ মেনে হয়? ছেলে-মেয়েদের জন্মদিন তো সেই কোনকাল
থেকেই ইংরেজি সাল তারিখের জিম্মায় চলে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও পয়লা বৈশাখের এখনও একটা
আলাদা কদর আছে বাঙালি জীবনে। বাংলা বছর শুরুর ওই দিনটাতে বাঙালি একবারের জন্য হলেও
তাদের হারিয়ে যাওয়া সাজগোজ আচারবিচার খানাপিনার দিকে ফিরে তাকায়। আর তাই রাস্তাঘাটে
কি শপিংমলে রেস্তরাঁয় পয়লা বৈশাখের দিন বাঙালির স্বাভাবিক সাজে বহু মানুষকে শামিল হতে
দেখা যায়। বাঙালির আড্ডায় বাংলা গান, বাংলার সুর শোনা যায়। শাড়ি, পাজামা কুর্তা কি
ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বাঙালি-খানার স্পেশাল মেনুর স্বাদ নিতে ভিড় জমে মহানগর ও শহরতলির
রেস্তরাঁয়। হালখাতা মিষ্টিমুখ হয় দোকানে দোকানে।
পয়লা বৈশাখ পালনের এই চিরাচরিত প্রথায় এবারও উৎসাহের
অভাব ছিল না। গত শুক্রবার মোটামুটি সাড়ম্বরেই বাংলা বছর শুরুর দিনটা উদ্যাপন করেছে
বাঙালি। বৈশাখের প্রথম দিনটা কেটেছে একরকম নির্বিঘ্নেই। কিন্তু, পয়লা একটা দিন বই তো
নয়। বছরের বাকি দিনগুলোর কী হবে? পয়লা না হয় কাটল উৎসবের আমেজে। কিন্তু, তারপর? অশান্তির
বাড়বাড়ন্তে অস্থির এই বিশ্বে স্বস্তি সম্প্রীতি ফিরবে? নতুন বাংলা বছরে মানুষ কি একটু
শান্তি পাবে? একটু চাপমুক্ত হয়ে কাটাতে পারবে তাদের নিত্যদিনের জীবন? আজ এগুলোই সব
থেকে বড় প্রশ্ন।
আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সিরিয়া থেকে
প্রতিবেশী ভারত সর্বত্র যেভাবে জঙ্গি হিংসা বাড়ছে, নিরীহ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে তাতে
এই প্রশ্নগুলো ওঠাই তো স্বাভাবিক। আমাদের দেশেও তো সাম্প্রতিক জঙ্গিদের ক্রিয়াকলাপ
বেশ ভালোই নজরে পড়ছে। কবে যে থামবে, আদৌ কোনওদিন থামবে কি না কে জানে?
এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বিপদে কারা? সাধারণ মানুষ,
দেশের আমজনতা। কিছু একটা ঘটলে সবার আগে বলি হন তারাই। তাদের পরিবার প্রিয়জনেরাই ক্ষতিগ্রস্ত
হন সবচেয়ে বেশি। কেবল জঙ্গি সন্ত্রাস কেন কোথাও কোনও গ-গোল কি সমাজবিরোধী ক্রিয়াকলাপেরও
প্রথম বলি তো তারাই! ধর্ম পালনের অধিকার সকলের
আছে, হিন্দু-মুসলমান খ্রিস্টান বৌদ্ধ জৈন-সকলের। আর আমাদের দেশে সে ধর্ম পালনে কোনও
দিন কেউ বাধা দিয়েছে বলে শুনিনি। হিন্দু হিন্দুর ধর্ম পালন করবেন, মুসলমান মুসলমানের
ধর্ম পালন করবেন, খ্রিস্টান যিশুর ভজনা করবেন আপত্তির কোনও জায়গাই নেই।
এই বাংলায় অরাজক পরিস্থিতি তৈরির যে চেষ্টা, চক্রান্ত
চলছে তাতে বাড়তি ইন্ধন পাচ্ছে। সমাজবিরোধীরাও যে যার মতো করে পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে।
সব মিলিয়ে সাধারণের বিপদ বাড়ছে বই কমছে না। স্বস্তির মূল কথা হলো-মঙ্গলশোভাযাত্রাকে
কেন্দ্র করে দেশে কোথাও কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সাম্প্রদায়িক প্রীতিতে কোথাও কোনও
আঁচড় লাগেনি। মানুষ এমনটাই চান। যে যার ধর্ম যেমন খুশি পালন করুন কিন্তু সম্প্রীতির
পরিবেশটি অটুট থাক। তবেই না আমাদের দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, উন্নয়নে গতি বাড়বে,
আমাদের জীবনে শান্তি-স্থিতি আসবে। সেই উন্নয়নের ধারা, শান্তি চেষ্টার সাফল্য যাতে অব্যাহত
থাকে তার জন্য আমাদেরও কি দায় নেই? সব দায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর ফেলে দিয়ে হাত গুটিয়ে
বসে থাকলেই হবে!
গত শুক্রবার ঢাকায় জনস্রোতেই পথ হেঁটেছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা।
১৯৮৯’ থেকে প্রতিবারের মতো এবারও। ২৮ বছরের মাথায় সেই মঙ্গল শোভাযাত্রা এবার হাঁটল পশ্চিম বাংলায়।
বারেবারে সাম্প্রদায়িকতা, বিভেদের রাজনীতির মুখে সর্বস্ব বাজি রেখে রুখে দাঁড়ালো বাঙালি
গত শনিবার শহর কলকাতাতেই। বাংলা নববর্ষের প্রথম সকালে বাস্তবিকই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’
দেখলো পশ্চিম বাংলার মুখ, এই প্রথম। ‘বাংলার মুখ’ বাংলার নিজস্ব বহুমাত্রিক সংস্কৃতির
এক অপরাজেয় পরিচিতিপত্র। বাংলার মুখ আসলে বাংলার সেই চেতনা, যার ভরকেন্দ্র আক্ষরিক
অর্থেই এক অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ। গাঙ্গুলিবাগান থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
তিন কিলোমিটারেরও কম এক যাত্রাপথ-ই গত শনিবার সকালে হয়ে উঠলো যেন বাংলার চিরন্তন লোকজ
সংস্কৃতির এক জীবন্ত কর্মশালা। বিষ্ণুপরের ঘোড়া থেকে কালীঘাটের পট, রায়বেশে থেকে পীরের
গান, রণপা’র পাশেই চলমান গীতিনাট্য।
সেই আবেগের বিস্ফোরণই এদিন সকালে যাদবপুরে। ঢাকার
মঙ্গল শোভাযাত্রার আদলেই ওখানে ছিল নানা রঙের মুখোশ, হরেক রকমের কারুকাজ, হাতি, ঘোড়ার
রঙিন প্রতিকৃতি। বাংলা অক্ষর মালা দিয়ে সাজানো নানা কারুকাজ। বাংলার একেবারে নিজস্ব
সংস্কৃতির অনন্য সেই স্বাক্ষর, সঙ্গে চলমান নৃত্য, গান, রায়বেশে, পীরের গান। আর সব
কিছুকে ছাপিয়ে স্বতঃস্ফূর্ততা। রাজপথ থমকেছে,
নেহাতই দর্শকের তকমা ঘুচিয়ে পথচারীরাও বেমালুম মিশে গিয়েছেন শোভাযাত্রায়। ধর্ম-বর্ণ-রং-জাতের
যাবতীয় বিভেদ ভেঙে, ভাঙার বার্তা দিয়েই এগিয়েছে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা।
শোভাযাত্রার আগে গত শুক্রবার রাতভর গাঙ্গুলিবাগান
থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত রাস্তা আল্পপনায় সেজে ওঠার কথা ছিল। বাংলা নববর্ষ
উদযাপন পরিষদের তরফেই নেয়া হয়েছিল এই অভূতপূর্ব উদ্যোগ। তাতেও বাধার মুখেই পড়তে হয়েছে।
রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। ঢাকা থেকে যাওয়া শিল্পীরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীরাও
রঙ হাতে নেমে পড়েছেন রাস্তায়। আল্পনায় সাজানো হবে মঙ্গল শোভাযাত্রার যাত্রাপথ। কিছুক্ষণের
মধ্যেই সেখানে হাজির বাঙালির চিরন্তন সংস্কৃতির বিরোধী দলের বাহিনী। চলে হুমকি-রাস্তায়
আল্পনা দেয়া যাবে না। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই চলে হুমকির পালা। অবশ্য তা অতিক্রম করে গভীর
রাতে যাদবপুরের রাস্তা আল্পনায় সেজে ওঠে শিল্পীদের হাত ধরেই।
গত শনিবার সকাল আটটায় শুরু হওয়ার কথা ছিল এই শোভাযাত্রা,
গাঙ্গুলিবাগান থেকে। তার অনেক আগেই সকাল সাতটা থেকে গোটা চত্বর সেজে ওঠে বাংলার চিরন্তন
সংস্কৃতির রঙে। স্কুলের পোশাকেই ছাত্ররা হাজির, হাজির অভিভাবকরা। রাস্তার মাঝেই বিশালাকার
হাতি, ঘোড়ার প্রতিকৃতি। রঙবেরঙের মুখোশ-রামধনুর আভা। রামধনুর সাতটি রঙেই তখন সেজে উঠছে
ওই বাংলার বুকে সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার সংস্কৃতি। শোভাযাত্রার
একেবারে সামনে ব্যানারে লেখা ‘এই দেশ মানুষের ভালোবাসায় বাঁচুক’। ‘এমন মানব সমাজ কবে
গো সৃজন হবে/হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান জাতি-গোত্র নাহি রবে।’
ঘড়ির কাঁটা ধরেই এরপর শুরু হলো সেই শোভাযাত্রা। কয়েক
হাজার মানুষ পথ হেঁটেছেন। প্রত্যক্ষ করেছেন ওপার বাংলায় মঙ্গল শোভাযাত্রার এই উদ্বোধনকে।
গানের ছন্দে, নৃত্যের তালে। সম্প্রীতির বার্তা বারেবারে এসেছে ওই শোভাযাত্রা থেকে।
যাদবপুর পর্যন্ত তিন কিলোমিটারেরও কম রাস্তা পেরোতে সময় লেগেছে দু’ঘন্টার বেশি। একাধিক
সাংস্কৃতিক সংগঠন, সংস্থা শামিল হয়েছে তাতে। নিজেদের মতো করে গান গেয়েছে, চলমান নাটক
এগিয়েছে শোভাযাত্রার তালেই। যাদবপুর, রবীন্দ্রভারতী, বিশ্বভারতীর ছাত্র-ছাত্রীরাও যোগ
দেয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এসে শেষ হয়। মঙ্গল শুধুমাত্র সংগঠকরাই নয়,
এই শোভাযাত্রায় শামিল হওয়া মানুষজন, বিশিষ্টজনদের দাবি, মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়ে উঠুক
আগামী বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব, বিষমুক্ত হোক সমাজ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন