মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার যেভাবে হলো


কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার যেভাবে হলো

সংলাপ ॥ ঢাকা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণ কার্য শুরু করা হয় ১৯৫৬-৫৭ সালে। নকশা ও সামগ্রিক পরিকল্পনাকারী হামিদুর রহমান। নির্মাণ কার্য তদারকিতে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নাগরিক গণপূর্ত বিভাগ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের জটিল বৃত্তান্তটি ছড়িয়ে আছে সুদীর্ঘ, বিপদসঙ্কুল ছয়টি দশকে ব্যাপ্ত হয়ে।
স্থপতি হামিদুর রহমান বলেন, চিত্রশিল্পে ইংল্যান্ডে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে আমার স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই সে কাহিনীর সূচনা হয়। আমার জন্য ১৯৫৬ সালের হেমন্তকালের প্রারম্ভটি অত্যন্ত উত্তেজক হয়ে ওঠে। প্রয়াত শিল্পী জয়নুল আবেদিন আমাকে গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী জনাব এম এ জব্বারের সঙ্গে অবিলম্বে সাক্ষাত করার জন্য অনুরোধ করেন। সেটি ছিল ঢাকায় শীত সমাগমের এক ধোঁয়াটে কিন্তু উজ্জ্বল প্রাতঃকাল। আমি জনাব জব্বারের অফিস কক্ষে গিয়ে উপস্থিত হলে ১৯৫২ সালে বাংলা-ভাষা আন্দোলনে যেসব শহীদ মৃত্যুবরণ করেছিলেন তাদের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে একটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে যে জল্পনা-কল্পনা করা হচ্ছিল, আমাকে তা জানানো হলো।
১৯৫৭ সালে প্রধান প্রকৌশলীর অনুরোধ অনুসারে আমি একটি মডেল ও ৫২টি নকশার কাগজপত্র প্রস্থত করি, যার সাহায্যে ওই নির্মাণ কাজটি বুঝবার সুবিধা হতে পারে। অন্যান্য শিল্পী ও স্থপতিকেও তাদের ওই সম্পর্কে চিন্তাভাবনার সমর্থনে কাগজপত্র জমা দিতে অনুরোধ জানানো হয় এবং সে অনুসারে কাজও হয়। বিখ্যাত গ্রিস দেশীয় স্থপতি ডক্সিয়াডেস নির্বাচন কমিটির সভাপতি মনোনীত হন। জনাব জব্বার, শিল্পী জয়নুল আবেদিন এবং আরও কয়েকজন সরকারি আমলা ওই কমিটির সদস্য ছিলেন। আমার প্রস্থতকৃত নির্মাণ কল্পনাটিই ‘সবুজ সঙ্কেত’ লাভ করে এবং সেই মুহূর্ত থেকে মিনার সম্পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে সব কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে যায়। সে সময়ের নগরাঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী জনাব মঈনুল ইসলামের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তার অফিসে আমার ‘মডেল’ ও অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে যাওয়া হয় এবং নির্মাণ কাজটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার জন্য প্রায় সার্বক্ষণিক কাজকর্ম চলতে থাকে। কয়েকদিন পর গণপূর্ত বিভাগ আমাকে একজন সহায়ক কর্মী প্রদান করে, যিনি ছিলেন তাদের প্রধান ভ্রাম্যমাণ স্থপতি জাঁ ডুলুর্যান্ড নামের এক ড্যানিশ ভদ্রলোক। আমার পরিকল্পনাটি এবং মডেলগুলো নিয়ে আমি গণপূর্ত বিভাগের ইমারতের চতুর্থ তলায় চলে যাই। ডুলুর্যান্ড আমার জন্য বড় এক প্রস্থ নীল নকশা এবং কয়েকটি কার্যকরী মডেল প্রস্তুত করে দেন।
১৯৫৭ সালের শেষভাগে আমার এ সম্পর্কিত কার্যকলাপ বেশ দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। ১৯৫৭ সালের নভেম্বরে ঢাকা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের চত্বরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। ১৯৫৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনারের নির্মাণ কর্মটি শেষ করে ফেলার পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়। আর্থিক প্রসঙ্গ এবং অন্যান্য দফতর সম্পর্কিত কাগজপত্র আমার নির্মাণ কল্পনার সম্মানী (রয়্যালটি) বাবদ আমি মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা দাবি করেছিলাম। মিস নভেরা আহমেদের তিনটি ভাস্কর্য কর্ম সম্পাদন করার জন্য দশ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছিল। আমার যতদূর মনে পড়ে, আমার সমগ্র কর্মীদলটির জন্য পাঁচ হাজার টাকা মাত্র প্রদান করা হয়েছিল। শহীদ মিনারের নিম্ন তলের দেয়ালে আমি ১০০০ বর্গফুটের ম্যুরাল এঁকে দিয়েছিলাম। আর নভেরা তিনটি ভাস্কর্য কাজ নির্মাণ করেছিলেন। যেগুলো মিনারের স্টুডিও (কর্মশালা) কক্ষের অন্ধকারে চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে রইল। শেষ পর্যন্ত ২১শে ফেব্রুয়ারি মিনারের অসম্পূর্ণ স্তম্ভগুলোর ছায়াতলেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। সেই তারিখের পরেও আমরা কর্মরত রইলাম। কিন্তু পরিকল্পিত নির্মাণ কার্যটি সম্পূর্ণ করে আমার জন্য আমাদের সেখানে থাকতে দেয়া হলো না। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের প্রথম দিনেই আমাকে সে স্থান থেকে বের করে দেয়া হলো। এমনকি আমরা আমাদের শিল্পকর্মের সরঞ্জামাদি ও ব্যক্তিগত সামগ্রীও নিয়ে আসার সুযোগ পাইনি। স্টুডিওর দরজায় একটা বিশালায়তন তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল, আর তার পাশেই দাঁড়িয়েছিল এক সতর্ক ‘জওয়ান’। আমার ধারণা, এই প্রকল্প সম্পর্কিত কিছু কিছু দলিলপত্র এখনও নগর গণপূর্ত শাখার দফতরে ‘ইডেন’ ইমারতের স্থাপত্য বিভাগে পাওয়া যেতে পারে।
১৯৫৮ সালের শেষভাগ, ‘লিডার এক্সচেঞ্জ’ কর্মসূচির অধীনে ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আমি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই। ফিলাডেলফিয়ায় অবস্থিত ফাইন আর্টস একাডেমিতে আমি বিদেশি শিক্ষার্থী রূপে কাজ শুরু করি। কিন্তু আমার অন্তরে ফেলে আসা অসম্পূর্ণ মিনারটির চিন্তা এত বেশি ছিল যে, অল্প কিছু দিনের মধ্যে আমাকে স্বদেশে ফিরে আসতে হলো। তথাপি আমার অনুকূলে এক বিন্দু পরিবর্তনের আভাসও পাওয়া গেল না। সামরিক আইন তখন তার মহিমার শিখরে অবস্থান করছিল এবং কারও সাহস ছিল না যে, ‘পরিত্যক্ত’ মিনারটির বিষয়ে কোন কথা বলে। বহু বছর পার করে অবশেষে ১৯৬৩-৬৪ সালে এই নিস্তব্ধতা ভাঙে। মিনারের কাজ আবার আরম্ভ করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান সরকার সে বছর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটিতে ছিলেন ড. মাহমুদ হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলার ও আর্ট কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল শিল্পী জয়নুল আবেদিন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর মতো কিছু বিখ্যাত ব্যক্তি। আমার ধারণা ছিল যে, তারা আমাকে অচিরেই ডাকবেন, কিন্তু তা ঘটবার আগেই ওই কমিটি যেন রাতারাতি হাওয়ায় উবে গেল। পরবর্তীকালে ওই কমিটির একজন সদস্য আমাকে জানিয়েছিলেন যে, ওই কমিটি আমাকে অনুরোধ জানাতে উদ্যোগ নিয়েছিল যেন প্রত্যেকটি স্তম্ভের জন্য আমি আরব্য ‘টোগরা’ (শিরস্ত্রাণ?) নির্মাণ করে দেই। অতঃপর শহীদ মিনারের ওপর নিস্তব্ধতার প্রগাঢ় ও দীর্ঘ এক ছায়া নেমে আসল।
১৯৭২ সালের প্রারম্ভকাল, বাংলাদেশ সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করল। মিনারের কাজ এবারে একেবারে সম্পূর্ণ করে ফেলতে তারা উদ্যোগী হল। শহীদ মিনার নতুন ভাবে নির্মাণ পরিকল্পনার জন্য তারা নতুন প্রতিযোগিতা আহ্বান করল এবং বিচারের জন্য কিছু বিচক্ষণ বিচারক নিয়োগ করলেন। এবার দেশের সব শিল্পী ও স্থপতি গোষ্ঠী দলবব্ধ হয়ে তাদের কর্ম-পরিকল্পনা কমিটিতে উপস্থাপন করল। এই প্রতিযোগিতা স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে অগ্রিম প্রচারণা লাভ করল এবং সেসঙ্গে জনমতও কর্মকর্তারা লিপিবদ্ধ করলেন।
একদিন বঙ্গভবনের কেন্দ্রীয় বৃহত্তর কক্ষে সবক’টি উপস্থাপনা প্রদর্শিত হলো। ওই কমিটির, গণমাধ্যমের এবং জনগণের প্রতিক্রিয়ায় দেখা গেল আমার দলটির উপস্থাপিত নির্মাণ কল্পনাটি তাদের সুস্পষ্ট সমর্থন লাভ করেছে। সবারই মতামত ছিল মিনারটির সেই পূর্ব পরিচিত মূল পরিকল্পনাটির জন্যই- যা ছিল আমার সৃষ্টিকর্ম। সে সঙ্গে আশা করা হলো যে, আরও কিছু সংযোজন করা হবে। আগেই আমার দলটি ঠিক এই পরিকল্পনাটিই প্রকাশ করেছিল। অতঃপর খুব ভালো, কঠিন কিছু কার্য সম্পাদন করা হলো এবং আমাদের ক্রিয়াকর্ম দেখে তারা বেশ সন'ষ্ট হলেন। এরপর আবার সেই দীর্ঘসূত্রতা, কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না এবং অবিলম্বেই ১৯৭২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এসে গেল। কোনো অদৃশ্য হাত যেন শহীদ মিনারের নিম্নের দেয়াল থেকে আমার অঙ্কিত ১০০০ বর্গফুটের ম্যুরালটির ওপর সাদা চুনকাম করে দিল। এ ব্যাপার দেখে আমার ক্রোধের অন্ত রইল না। কিন্তু রহস্য উন্মোচনের সূত্র কেউ আমাকে দিতে পারল না, এমনকি নগর অঞ্চলের গণপূর্ত বিভাগটিও নয়, যদিও তারাই ছিল সমগ্র কাজটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন