বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

বর্তমান শিক্ষা কাঠামো - সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করছে কি?

বর্তমান শিক্ষা কাঠামো - সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করছে কি?

শেখ উল্লাস ॥ সাধকরা নিঃসন্দেহে কবি এবং এই সাধকদের বাণী শত শত বছর ধরে মানুষকে আলোর পথে চলার নির্দেশনা দেয়। প্রায় চার শ’ বছর আগের এমনই এক কবি-সাধক আব্দুল হাকিম বলেছিলেন, ‘আরবী ফারসি শাস্ত্রে নাই কোনো রাগ/ দেশি ভাষা বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ/ আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত/ যদি বা লিখয়ে আল্লা নবির ছিফত/..যে জন বঙ্গে ত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি/ দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়/ নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।’ 
সময় ও পারিপার্শি¦কতা পাল্টে যাওয়ার কারণে মানুষ এখন বিদেশ যাচ্ছে অনেক কারণে-বেশির ভাগই জৈবিক চাহিদা পূরণে-ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণে, খেয়ে-পরে নিরাপদে একটু ভালো থাকবে, দেশে থেকে কোনো ধরনের ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হবে না-এই আশায়।
বিদেশে উন্নত জীবনের শিক্ষা-প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে দুঃখিনী বাংলা মায়ের সেবায় আত্মনিয়োগ করার ব্রতে জীবন উৎসর্গ করবে-এমন মানুষের সংখ্যা এখন নিতান্তই কম। দেশ ও মানবতার এই মহান ব্রতে উৎসর্গকৃত হতে পারেনও শুধুমাত্র সাধকরাই। সাধকরা ছাড়া মানবতার জয়গান গাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ, জীবন চলার পথে তাদের ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই, নাম - যশ -আর্থিক প্রতিপত্তি-অর্জনের জন্য তাদের কোনো মোহ নেই। কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, নাম-যশ-আর্থিক প্রতিপত্তি অর্জন - নারী - পুরুষের বিষয়গুলোর প্রতি যাদের কোনো মোহ আছে, তাদের মুখে মানবতার কথা শোভা পায় না। অথচ তারাই শিক্ষার নামে, ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে  মুখে বড় বড় কথা বলে, ত্যাগের চাইতে ভোগের প্রতিই তাদের আকর্ষণ বেশি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্যসব জীব-জন্তুর মতই তাদের চাওয়া-পাওয়া, স্বার্থের একটু ব্যাঘাত ঘটলেই কেবল তাদের আসল চেহারা দেখা যায়। হীনমণ্যতা, অপরের সঙ্গে তুলনা ও সংশয়-সন্দেহ নামের যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতে তারা অন্য প্রাণীদের মতোই বিচরণ করে এই পৃথিবীতে এবং এক সময় অন্য প্রাণীর মতোই তারা যখন পৃথিবী থেকে চলে যায়, কোনো রকমের আবেদন তারা পৃথিবীতে সৃষ্টি করে যেতে পারে না এবং মানুষও তাদের কথা স্মরণ রাখে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এই তারাই আবার পার্থিব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাদের কাছে সাধারণ মানুষকে ধর্ণা দিতে হয়। সমাজ-সংসারে যাবতীয় অনাচার সৃষ্টির কারণ তারাই।
বাঙালির ভাষা আন্দোলন, শহীদ দিবসের ৬৪, বিজয় দিবসের ৪৫ বছর  বছর পার হচ্ছে, বাঙালির মুক্তির-মন্দির সোপানতলে কত লাখো প্রাণের বলিদান হয়েছে, কিন্তু মাতৃভাষার মর্যাদা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি ওই সব হীনমণ্য তথা সংকীর্ণ লোকদের জন্য।  ধর্মের নামে আরবী, শিক্ষার নামে ইংরেজি, বিনোদনের নামে হিন্দীর দাপটে বাংলা ভাষাকেও আজও চরম লাঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে।
বর্তমানে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে - সরকারি প্রাথমিক, কিন্ডার গার্টেন বা ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসা শিক্ষা-এই  প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করলে দেখা যায় সরকারি প্রাথমিক স্কুলে আসে দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরা। এইসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে শিক্ষাদানের চাইতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে অন্য সব কাজে, যেমন-বিভিন্ন জরিপ, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, বিভিন্ন নির্বাচন, সপ্তাহে অন্যাবশ্যক থানা শিক্ষা অফিসারের কক্ষে হাজিরা দেয়া, অফিসারদের বা নেতাদের অভ্যর্থনার নামে শিক্ষক -শিক্ষার্থীদের ঘন্টার পর ঘন্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা ইত্যাদি। মোটামুটিভাবে স্বচ্ছল ও অবস্থাসম্পন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরা যায় কিন্ডার গার্টেনে ও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে।  ইংরেজি শিখলে ভালো চাকুরি পাওয়া যাবে, বিদেশে যাওয়া যাবে-এই আশায়। ‘যে জন বঙ্গে ত জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’- এই জাতীয় মানুষদের সংখ্যাই যেখানে বেশি সেখানে সুশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে না। একদিকে ইংরেজির প্রতি মোহ ও ভুল ইংরেজি শিক্ষা, অপরদিকে বাংলা ভাষার প্রতি অনীহা ও অনাগ্রহের কারণে একটি বিরাট প্রজন্ম শেকড়চ্যুত হয়ে পড়ছে। আর সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বেশি সুবিধাভোগী মানুষদের সন্তানেরা শুদ্ধ ইংরেজি শিখছে শুধুমাত্র বিদেশে পাড়ি জমানোর লক্ষ্যে। এদেশে চাকুরি করে, পেনশনসহ রাষ্ট্রীয় যা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে তা বিনিয়োগ করা হচ্ছে বিদেশে।  নিজের দেশ ও গ্রাম-মফস্বলের প্রতি দায়বদ্ধতা যেন নেই কারো।
অথচ এদের অধিকাংশেরই শেকড় এই গ্রাম-মফস্বলে। দেশের সর্বোচ্চ ও সর্ববৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত দশকে অনেক নতুন বিভাগ চালু হওয়ায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিপুল হারে বেড়েছে। কিন্তু ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন না হওয়া এবং ইংরেজির প্রতি মোহাচ্ছন্নতা দেশ ও সমাজের প্রতি প্রতিষ্ঠানটির ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের একটি বিভাগের চেয়ারম্যানের কাছে একটি দাওয়াতপত্র দিতে গিয়ে দেখা যায়, বাংলায় এর নাম-ঠিকানা পরিচয় কিছুই লেখা নেই।  বাংলা ভাষা ওই বিভাগ থেকে উধাও। অনেক খোঁজাখুজি করেও যখন বাংলায় বিভাগটির নাম পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন দু’ছাত্রের কাছে এর কারণ চাইলে তারা বলে, এখানে বিশ্বের সকল ধর্ম সম্পর্কে পড়ানো হয় বলে বাংলা না লিখে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। যেন বাংলা ভাষাভাষী কোনো ধর্ম তাদের আর পড়ার দরকার নেই। সব পড়া হয়ে গেছে। পরে বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কে রোজারিওকে বিষয়টি জানালে বলেন, এটা ভুল হয়েছে। লালন সাঁইজী সেই কবে কেন যে বলেছিলেন, ‘ভেদ, বিধি, পথ, শাস্ত্র কানা, আর এক কানা মন আমার, এসব দেখি কানার হাঁটবাজার!’       
সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা মাদ্রাসাগুলোকে কেন্দ্র করে। অর্থনৈতিকভাবে এবং ধর্মচিন্তায় সবচেয়ে দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরা আসে মাদ্রাসায়। গ্রামের দরিদ্র ও কোমলমতি শিশুদেরকে তাদের মা-বাবারা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিচ্ছে নানা প্রলোভনে। সেখানে শুধুমাত্র আরবী  শেখানো হচ্ছে, বাংলা ও ইংরেজি শেখানোর কোনো উদ্যোগ ও পরিবেশ নেই। এমনকি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের কাছেই মাদ্রাসা বানিয়ে মাদ্রাসাগুলোতে ছাত্র সংখ্যা বাড়ানোর ঘটনা ঘটছে। ধর্মজীবীদের ব্যবসা খুব চাঙ্গা হচ্ছে। কিন্তু এই কোমলমতি ছেলেময়েরা বড় হয়ে কী করবে, পৃথিবীতে কোন্ কাজটিকে তারা  জীবিকার উপায় হিসেবে বেছে নেবে, মানবতা তথা আল্লাহর জন্য কাজ করা তো আরও দূরের ব্যাপার! এই সব প্রশ্নের কোনো উত্তর এই ধর্মজীবীদেরকে জিজ্ঞাসা করেও পাওয়া যাচ্ছে না। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও পরবর্তীতে ব্রিটিশরাজ এদেশের সরল-সহজ মুসলমানদেরকে কর্মবিমুখ করার দূরভিসন্ধি নিয়ে খ্রীষ্টান পাদ্রীদের দিয়ে এদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রবর্তন করেছিলেন তার বড় প্রমাণ কোলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার বর্তমান অধ্যক্ষ-এর কক্ষে আজও সেই পাদ্রীদের নাম শোভা পাচ্ছে-অনুসন্ধিৎসুদের জন্য যা এক নিদর্শনস্বরূপ! অবশ্য কওমী মাদ্রাসাওয়ালারা বলে থাকেন, আলিয়া মাদ্রাসাগুলো খ্রিষ্টান প্রভাবিত এবং কওমী মাদ্রাসাই আসল মাদ্রাসা। কিন্তু এই উপমহাদেশে মাদ্রাসা শব্দটি চালুই করেছে ইংরেজরা-প্রথমে আলিয়া এবং পরবর্তীতে কওমী মাদ্রাসাগুলোর পেছনেও ছিল ইংরেজ সরকার। আরব দেশের নজদের ওহাবী মতবাদ প্রচার ও প্রতিষ্ঠাই এসবের মূল লক্ষ্য যে নজদের আব্দুল ওহাব ছিলেন নবী মুহাম্মদ (দঃ)-এর প্রকাশ্য শত্রু। আধুনিক যুক্তরাষ্ট্র (আমেরিকা), যুক্তরাজ্য, ইসরাইল রাষ্ট্র এবং তাদের বশংবদ সৌদি রাজতন্ত্র-এসব কিছুই ওহাবী ইসলাম তথা এজিদী ইসলামের ধারক-বাহক-এ সত্যটুকু সাধারণ মুসলমানরা উপলব্ধি কবে করবেন-সেটাই আজ বড় প্রশ্ন।
শিক্ষাক্ষেত্রে এইসব জগাখিচুড়ি সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করছে, সৃষ্টি করছে বৈষম্য। সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাপনা অকার্যকর করে তুলেছে সরকারেরই এক শ্রেণীর নেতা ও আমলারা। সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা কাঠামোকে সত্য ও সঠিক পথে নিয়ে এসে দেশে বৈষম্যহীন ও আত্মমর্যাদাশীল সমাজ গঠনের অপার সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে কি?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন