বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই, ২০১৪

গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়



গ্রহণ করেছ যত 
ঋণী তত করেছ আমায়

দিগন্ত ॥ যখন আল্লাহ্‌ তায়ালা পৃথিবী সৃষ্টি করলেন, তখন তা দুলতে লাগল। তারপর তিনি পাহাড়সমূহ সৃষ্টি করলেন এবং তাদের জমিনের উপর স্থাপন করলেন, তারপর পৃথিবী স্থির হলো। তখন ফেরেশ্‌তাগণ পাহাড়ের সৃষ্টি দেখে আশ্চর্যান্বিত হলো এবং আরজ করল, ‘হে প্রভু! আপনার সৃষ্টির ভিতরে এই পাহাড়গুলোর চেয়ে বেশি শক্ত কোন বস্তু আছে কি?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, লোহা’। তখন তারা আবার বলল, ‘হে প্রভু! আপনার সৃষ্টির ভেতর লোহার চেয়ে শক্ত কোন বস্তু আছে কি?’  তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আগুন’। আবার তারা বলল, ‘হে প্রভু! আপনার সৃষ্টির ভেতর আগুনের চেয়ে শক্ত কোন বস্তু আছে কি?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, পানি’। তারা আবার বলল, ‘হে প্রিয় প্রভু! আপনার সৃষ্টির ভেতর পানি হতে বেশি শক্ত কোন বস্তু আছে কি?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, বাতাস’। তারা বলল, ‘হে প্রভু! আপনার সৃষ্টির ভেতর বাতাসের চেয়ে শক্ত কোন বস্তু আছে কি?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তা হলো আদম সন্তানের দান, যা সে ডান হাতে দান করে এবং বাম হাত হতে উহা গোপন রাখে। - এইভাবে প্রায় সকল ধর্মশাস্ত্রেই তুলে ধরা হয়েছে দানের মাহাত্ম্য।
দান ৪ প্রকার - প্রতিদান, স্বকাম দান, বাণিজ্যিক দান ও নিষ্কাম দান। কোন ব্যক্তির দ্বারা অতীতের উপকারের কথা মনে করে তাকে যা কিছু দান করা হয় তাকে বলে প্রতিদান। কোন ব্যক্তিকে কোন কিছু দান করে যদি ভবিষ্যতে তার দ্বারা উপকারের প্রত্যাশা করা হয় তবে তাকে বলে স্বকাম দান। প্রতিপত্তি, আয়কর সুবিধা, বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে যে দান করা হয় তা বাণিজ্যিক দান। অহংকার শূন্য ও প্রত্যাশাহীন দানকে বলে নিষ্কাম দান।
প্রতিদান দেয়া গ্রহীতার কর্তব্য। দান এবং প্রতিদানের মাধ্যমে মানুষের সাথে মানুষের সংযোগ ও সম্পর্ক স্থাপিত হয়। প্রতিদান না দেয়া অকৃতজ্ঞতা। অকৃতজ্ঞতা পারস্পরিক সম্পর্কে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি করে।
প্রতিদান পাওয়ার আশা করে দান করলে তা স্বকাম দান হয়। বেশির ভাগ মানুষ নিজের সব কিছু ঠিক রেখে দান করার কথা ভাবে এবং তার কিছু প্রতিদান গ্রহীতার কাছ থেকে আশা করে। এতে দোষের কিছু নেই কিন্তু এই প্রকারের দানকে মহান বলা যায় না। কারণ এই দানে, ‘আমি দাতা - তাই আমি বড় এবং তুমি গ্রহীতা তাই তুমি ছোট’ -এই অহমিকা বিদ্যমান থাকে। প্রত্যাশা বিভিন্ন প্রকারের হয়। প্রধান দুটি প্রত্যাশা হলো - দান করার পর গ্রহীতার কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা আশা করা এবং গ্রহীতার কাছ থেকে আশা করা যে সে সকলকে দাতার মাহাত্ম্য বলে বেড়াবে ।
বাণিজ্যিক দান প্রচার ও প্রদর্শন মূলক হয়। বন্যাপীড়িত, আর্ত, ক্ষুধার্ত মানুষকে সামান্য খাদ্য কিংবা বস্ত্র দিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকা নির্লজ্জতা। তাদের উদ্দেশ্য আর্তের সেবা নয়। উদ্দেশ্য - প্রচার, প্রদর্শন, খ্যাতি, ভোট, আধিপত্য ও প্রতিপত্তির বিস্তার। বাণিজ্যিক দানের কিছু ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য থাকে আয়করে ছাড় পাওয়া। দান করলে আয়কর হিসাবে সুবিধা পাওয়া যায়।  যে অর্থ দান করা হয়েছে তা আয়কর হিসেবে পরিশোধিত হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। কিছু বাণিজ্যিক দান আছে যা সরাসরি বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যেই করা হয়। এই প্রকারের বাণিজ্যিক দানে ব্যবসায়ীরা এতো ধূর্ততা করে যে কেউ তাদের ধূর্ততা ধরতে পারে না। যেমন এক ব্যবসায়ী শহর থেকে দূরে, যেখানে কোন মানুষের বাস নেই আর বাসের উপযুক্তও নয়, সেখানে প্রচুর জলা জমি নাম মাত্র দামে কিনে নেন। পরে সেই জমির সামান্য অংশ দান করেন - স্কুল, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, শপিং কমপ্লেক্স করার জন্যে। এই সব দানের ফলে সরকারের খরচে রাস্তা, পরিবহন ব্যবস্থা, পানি-বিদ্যুত ও গ্যাস সরবরাহের আন্তঃজাল গড়ে ওঠে। ফলে অল্প মূল্যে কেনা জমি হয়ে ওঠে বহু মূল্যবান। এবার চতুর ব্যবসায়ী নাম মাত্র দামে কেনা জমি বিক্রি করে সোনার দামে এবং হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা লুটে নেয়।
বাণিজ্যিক দানের আর এক প্রকার হলো গ্রহীতার জীবন পরিচালনার অধিকার। এই প্রকারের দাতাগোষ্ঠী কিছু দান করলে দুটো শর্ত অবশ্যই আরোপ করে।  প্রথম শর্ত - দানের টাকা দাতার নির্দেশ মত সাহায্যে ব্যয় করতে হবে; দ্বিতীয় শর্ত - শর্ত অনুযায়ী যে ব্যয় করা হয়েছে তার নির্ভরযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। এই শর্তের পশ্চাতে কি মানসিকতা আছে? শর্ত আরোপ করে দাতারা গ্রহীতাদের জীবন পরিচালনার অধিকার ভোগ করে। রাজনীতির ভাষায় এই দানকে বলা হয় - হেল্প এন্ড ম্যানেজ।
নিষ্কাম দানে কোন বিনিময়ের প্রত্যাশা থাকে না কিংবা যে বিনিময় প্রত্যাশা করা হয় তা পার্থিব নয়। ভারমুক্ত হওয়া নিষ্কাম দানের উদ্দেশ্য। তাই দাতা নিজেই গ্রহীতার কাছে কৃতজ্ঞ হয়। দাতার প্রসারিত মুক্ত কর হতে যার ইচ্ছা দান তুলে নেয় যেমনভাবে আমরা বৃক্ষ থেকে ফুল, ফল তুলে নেই। ফলভারে অবনত বৃক্ষ শুধু দেয় এবং দেয়ার মাঝে বেঁচে থাকে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এরূপ দাতার উপলব্ধি হলো - “গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।”

1 টি মন্তব্য: