বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই, ২০১৪

মানুষ যদি হতে চাও, মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করো



মানুষ যদি হতে চাও,
মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করো

সাদিকুল হক ॥ সূফী সাধক আনোয়ারুল হক বলে গেছেন - ‘মানুষ যদি হতে চাও, মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করো’। চলতি অর্থে মনুষ্যত্ব হচ্ছে - প্রেম, দয়া, বিনয়, ধৈর্য, করুণা, সততা, সত্যবাদিতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মবিশ্বাস, নির্ভরযোগ্যতা, ক্ষমাশীলতা, সাহস, বিচারশীলতা ইত্যাদি গুণের বিকাশ। মানুষ তৃষ্ণার্ত হলে পান করতে চায়, ক্ষুধা লাগলে খেতে চায়, ক্লান্ত হলে বিশ্রাম নিতে চায়  কিন্তু একই সাথে তৃষ্ণার্ত হলেও অন্যকে তৃষ্ণার্ত রেখে সে একাই তার তৃষ্ণা নিবারণ করতে চায় না, ক্ষুধা পেলেও সে প্রিয়জনকে অভুক্ত রেখে নিজে খেয়ে তৃপ্ত হয় না কিংবা অন্যের উপর কর্মের বোঝা চাপিয়ে নিজে বিশ্রাম নিতে অস্বস্তি বোধ করে। মানুষের মানবিক অনুভূতি অন্যের কষ্ট দেখলে কেঁদে উঠে। কোন শিশুকে পুকুরে পড়ে যেতে দেখলে আমরা ঝাঁপ দিয়ে তাকে রক্ষার তাগিদ অনুভব করি। এ তাগিদের পেছনে কোন স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে না। বিপদগ্রস্ত শিশুটিকে উদ্ধার করা আমাদের            মানবিক তাগিদ। অন্যকে রক্ষা করা, অন্যের সাথে খাদ্য, বিশ্রাম, কর্ম ভাগাভাগি করে গ্রহণ করা মনুষ্যত্বের দায়।
মানুষ যুক্তি কিংবা ধর্ম নিয়ে জন্মে না, জৈবিক সামর্থ্য কিংবা অন্তর্গত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তি ও ধর্ম মানুষকে অর্জন করতে হয়। মানুষকে মানুষ হতে হয় মনুষ্যত্ব অর্জন করে। আর মনুষ্যত্ব অর্জিত হয় মানবিক গুণাবলী চর্চার মাধ্যমে। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব এবং পশুত্ব দুটিই সুপ্ত থাকে। প্রচেষ্টার মাধ্যমে মনুষ্যত্বকে জাগ্রত না করলে পশুত্ব জাগ্রত হয়। বাগানে আগাছা বৃদ্বির জন্য যেমন কোন চেষ্টা করতে হয় না তেমনি পশুত্বকে জাগ্রত করতেও কোন চেষ্টার প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে, বাগানে ফুল ফোটাতে যেমন সচেতন প্রচেষ্টা করতে হয় তেমনি মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করতে হলে সচেতন প্রচেষ্টা করতে হয়।
মনুষ্যত্ব অর্জনে মানুষের অন্তর্গত ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি, শ্রমশক্তি ও পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মানুষ সামাজিক প্রথা ও রীতি নীতি কিংবা রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধানের শৃঙ্খলে আবদ্ধ দাস নয়, মানুষ তার নিজ প্রবৃত্তির দাসও নয়। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে নিহিত রয়েছে এমন এক শক্তি যার রূপান্তরের মাধ্যমে মানুষ নিজের প্রভু হয়ে উঠতে পারে, জাগ্রত করতে পারে তার মনুষ্যত্ব।
মনুষ্যত্ব বিকাশের প্রচেষ্টায় প্রতিযোগিতা ও সংঘর্ষের স্থলে সহযোগিতা ও সমপ্রীতির চর্যা করতে হয়। তাই মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করার জন্য এমন একটা পরিবেশে থাকতে হয় যেখানে মনুষ্যত্বের চর্যা হয়। মাটির ঢেলা গোলাপের সাথে থাকলে গোলাপের সুবাস প্রাপ্ত হয়, গোলাপও নর্দমায় থাকলে নর্দমার দুর্গন্ধ প্রাপ্ত হয়। রসহীন বালিতে উত্তম বীজ রোপন করলেও এ থেকে কোন উদ্ভিদ জন্মায় না। অন্যদিকে উপযুক্ত পরিবেশ ও যত্নে দুর্বল বীজ থেকেও ভালো উদ্ভিদের সৃষ্টি হয়। ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের হানাহানিতে দূষিত কোন পরিবেশে থাকলে মানুষ নিজের অজান্তেই  যুক্ত হয় স্বার্থের টানাটানিতে।
প্রচলিত রীতি-নীতির অনুসরণে মনুষ্যত্বের বিকাশ সম্ভব নয়। যদিও মনুষ্যত্ব বিকাশের উপায় খুঁজতে গিয়েই মানুষ উদ্ভাবন করেছে রীতি-নীতি, পদ্ধতি, আদর্শ ও দর্শন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এসব রীতি-নীতিতে যে সংস্কার প্রয়োজন তা মানুষকেই করতে হয়। রীতি-নীতি অলৌকিক উপায়ে প্রদত্ত নয়। মানুষের মনুষ্যত্ব বোধ থেকেই নীতি, নৈতিকতা ও ধর্মের উদ্ভব। মানব অস্তিত্বে মনুষ্যত্ব বিকাশের বাসনা কোন অলৌকিক ব্যাপার নয়, নিতান্তই মানবিক ব্যাপার, মানুষের মনোদৈহিক ও সামাজিক ব্যাপার। বিশেষ বিশেষ দেশ-কালে মানুষের জীবনযাপনের শ্রেষ্ঠ উপায় খুঁজে পাওয়ার আর মুক্তির তাগিদ থেকেই মানুষ নিজেকে বিকশিত করেছে মনুষ্যত্বের পথে।
একটি যুগে বহু মানুষের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে, খণ্ড খণ্ড রূপে উন্নত জীবন ও সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে যেসব ধারণা, আকাঙ্খা ও অভীপ্সা বিরাজ করে, সেগুলো সে যুগের শ্রেষ্ঠ মানবের চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে পরিমার্জিত ও সংশ্ল্লেষিত হয়ে সর্বজনীন, সর্বাঙ্গীণ রূপ নিয়ে শাস্ত্রে প্রকাশ পায়। প্রত্যেক ধর্মশাস্ত্রই মনুষ্যত্ব বিকাশের কিছু উপায় নির্দেশ করেছে দেশ ও কালের পরিপ্র্রেক্ষিতে। অন্যায় অবিচার, শোষণ, পীড়ন-প্রতারণা ইত্যাদির অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীতে আনন্দময়, সমপ্রীতিময়, সমৃদ্ধ ও সুন্দর জীবন প্রতিষ্ঠার তাগিদ রয়েছে প্রতিটি শাস্ত্রে। ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে স্বার্থের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে মানুষের, সমাজের, জাতির, রাষ্ট্রব্যবস্থার, সমাজব্যবস্থার দুঃসময়ে। তাই দুর্দিন অতিক্রম করে সুদিন প্রতিষ্ঠার, অন্ধকার যুগকে পেছনে ফেলে সমৃদ্ধ নবযুগ সৃষ্টির পথনির্দেশ ও অঙ্গীকার আছে প্রত্যেক ধর্মে। ধর্ম মানুষকে আকৃষ্ট করতে চেয়েছে মানবিক মূল্যবোধ চর্যার দিকে। দেশ ও কালের বিবেচনা বাদ দিয়ে কোন উপায়কে অনুসরণ করা তো দূরের কথা উপলব্ধি করাই সম্ভব নয়।
আগাছা পরিষ্কার করে বাগানে ফুল ফোটাতে যেমন মালী দরকার ঠিক তেমনি মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করতে হলে শাস্ত্রের চেয়ে অধিক প্রয়োজন শাস্ত্রবান পথপ্রদর্শক - যার মাধ্যমে শাস্ত্র স্থান ও কালের উপযোগি হয়ে ব্যাখ্যাত ও সমপ্রসারিত হয় এবং পরিবেশ পরিস্থিতি মোকাবিলার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। এমন একজন পথপ্রদর্শকের নির্দেশনায় নিজেকে রূপান্তরের প্রচেষ্টায় রত থাকলে মনুষ্যত্ব অবশ্যই জাগ্রত হবে। কোন ভারি বস্তুকে উপরে তুলতে হলে তাকে শুধু নিচের দিক থেকে ঠেললে চলে না। উপরের দিক থেকেও টানতে হয়। একইভাবে মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করতে হলে ব্যক্তি একা নিজের প্রচেষ্টায় তা করতে পারবে না। উপর থেকেও টান লাগবে।  অনেকে মিলে নিচ থেকে শক্তি প্রয়োগ করলেও যে কাজ হয় না উপর থেকে শক্তিশালী একজন টান দিলে সে কাজ হয়।
যে মহাশক্তি মনুষ্যত্বের জাগরণে ব্যক্তিকে উপরের দিকে টানেন তিনিই পথপ্রদর্শক, গুরু বা মুর্শিদ। মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করা মানে নিজের ভেতরের সুপ্ত বিধাতাকে জাগ্রত করা। যিনি মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করেছেন তিনিই পরিপূর্ণ মানব। জগতের মানুষ পদবাচ্য সকল প্রাণী বিধাতার প্রতিনিধি নয়। যার মধ্যে মনুষ্যত্ব  জাগ্রত হয়েছে তিনিই বিধাতার প্রতিনিধি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন