বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৪

দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ সম্প্রচার কমিশন গঠন জরুরি



দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ
সম্প্রচার কমিশন গঠন জরুরি

শেখ উল্লাস ॥ সাংবাদিকরা জাতির বিবেক-এটি শুধু কথার কথা নয়, বাংলাদেশের এমন বহু সাংবাদিকের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয় যাঁরা ছিলেন জাতির বিবেক। এদেশের বর্তমান সম্প্রচার জগৎ সেই ঐতিহ্যবাহী সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র জগতের (প্রিন্ট মিডিয়া বা মুদ্রণ মাধ্যম)-ই উত্তরাধিকার। সম্প্রতি জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারি এবং এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন যখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে তখন দেশ ও জাতির প্রতি সাংবাদিকতার ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার কথাগুলো জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন তুলছে। সাংবাদিকতার ইতিহাস বলছে, ঔপনিবেশিক শাসক ও শোষক শ্রেণী এবং তাদের তল্পিবাহকদের মুখোশ উন্মোচনে সমগ্র বাংলা তথা ভারতবর্ষে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ ও লেখালেখির কারণে ১৭৮০ সালে জেমস অগাষ্টাস হিকি নামের ভবঘুরে এক ইংরেজকে তৎকালীন ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর কোপানলে পড়ে ভারত ছাড়তে হয়েছিলো। সেই থেকে শুরু এদেশের মুদ্রিত সংবাদপত্রের পথচলা। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের সমর্থক কোনো কোনো গোষ্ঠীর উদ্যোগেও বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্র প্রকাশিত হলেও এসব পত্রিকা এদেশের সাংবাদিকতার মূলধারা হিসেবে কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং এর কারণ দেশ ও জনগণের প্রতি এদের কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না। দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে এদেশে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা উন্মেষিত ও বিকশিত হয়েছিল - গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য, রাজা রামমোহন রায়, জন ক্লার্ক মার্শম্যান, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, হরিশ চন্দ্র মুখার্জী, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র ঘোষ, বিপীন চন্দ্র পাল, শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কমরেড মুজাফফর আহমদ, সাধক কাজী নজরুল ইসলাম, আকরাম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রমুখ মনীষীদের প্রচেষ্টায়।
আজকের দিনে মুদ্রণ ও বৈদ্যুতিন (ইলেকট্রনিক) মাধ্যমের সম্মিলনে গড়ে উঠেছে বিশাল পরিসরের সম্প্রচার জগত। এই জগতের অধিকাংশই যখন অনিয়ন্ত্রিত পুঁজি ও ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেখানে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হলে একটি যথাযথ নীতিমালা অবশ্যই দরকার- যে নীতিমালা অবশ্য এদেশের সাংবাদিকতা জগতের বিবেকবান অংশ ঐতিহ্যগতভাবেই ধারণ, পালন ও লালন করে আসছে। এই অর্থে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নতুন কিছু নয়।
এদেশের সাংবাদিকদের জন্য বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল প্রণীত আচরণবিধি ইতোমধ্যে কার্যকর রয়েছে।  সময়ের বিবর্তনে আজকের দিনের বৈদ্যুতিন  মাধ্যম - বেতার ও টেলিভিশন অর্থাৎ সম্প্রচার জগতের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় গত ৬ আগষ্ট গেজেট আকারে জারি করেছে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা। গেজেট আকারে তা প্রকাশিত হয়েছে ৭ আগষ্ট। এর আগে গত ৪ আগষ্ট  বেতার ও টেলিভিশনের সংবাদ ও অনুষ্ঠান সম্প্রচারে বিভিন্ন ধরনের পরিচালনাবিধি আরোপ করে মন্ত্রিসভা এ নীতিমালার অনুমোদন দেয়। এ নীতিমালা অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কোনো বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ বা অবমাননাকর দৃশ্য বা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। অপরাধীদের দ- দিতে পারেন, এমন সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার মতো দৃশ্য বা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। আলোচনামূলক অনুষ্ঠানে (টক শো) বিভ্রান্তিমূলক ও অসত্য তথ্য পরিহার করতে হবে। জনস্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে এমন কোনো বিদ্রোহ, নৈরাজ্য ও হিংসাত্মক ঘটনা প্রদর্শন করা যাবে না। বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন নিয়ম বা বিধি মেনে চলতে হবে। জনস্বার্থের জন্য হানিকর, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট  করে জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, এমন কোনো খবরও সম্প্রচার করা যাবে না।
এই নীতিতে একটি স্বাধীন ও সংবিধিবদ্ধ কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে, যারা এসব বাস্তবায়ন করবে। প্রচার মাধ্যমগুলোর জন্য 'পরিচালনাবিধি' প্রণয়ন করবে এই কমিশন, একই সঙ্গে এই নীতিমালা ভঙ্গ করলে কী শাস্তি প্রযোজ্য হবে তাও নির্ধারণ করবে এই কমিশন। প্রযোজ্য হলে কমিশন সুপারিশও করতে পারবে। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ এবং সেদেশের সমাজের সার্বিক ক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যেখানে সেদেশের সরকারের দায়িত্বটাই সবচেয়ে বেশি, সেখানে সম্প্রচার মাধ্যমগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি-না তার নজরদারির জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকার কোনো কারণ নেই। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে এই সম্প্রচার নীতিমালাকে গণতান্ত্রিক দেশের সুষ্ঠু বিকাশের পথে একটি প্রক্রিয়ার শুরু বলা যায়। এই প্রস্তাবিত কমিশন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এমন এক দিন আসতে পারে যখন গণমাধ্যমের সাথে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্কচ্ছেদ হবে। কমিশনই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দেখভাল করবে।
এদেশের জনগণ ও সমাজের প্রতি বর্তমান সময়ের  সাংবাদিকতা ও সম্প্রচার জগতের দায়বদ্ধতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন মাঝে মধ্যেই  উঠে। সংবাদপত্রের জগৎ নিয়ে এই জাতীয় প্রশ্ন ও সংশয় সবচেয়ে বেশি। আজ থেকে এক দশকের ও বেশি সময় আগে এদেশে নতুন পুঁজি ও জঙ্গীবাদের উত্থানের সময়ে নতুন পত্র-পত্রিকা প্রকাশনা ও অনেকগুলো সম্প্রচার মাধ্যমের আত্মপ্রকাশ ঘটে তখন কবি-সাংবাদিক আবু হাসান শাহরিয়ার লিখেছিলেন, 'সম্পদ-পাহারায় বড়লোকরা আগে কুকুর পুষত; এখন পোষে দৈনিক। একুশ শতকের দৈনিক হচ্ছে বড়লোকের বাড়ির পোষা কুকুর। মাঝে-মধ্যে সেই কুকুরকে তার প্রভু এদিক-সেদিক লেলিয়েও দেয়। জমিদখল-ব্যবসাদখলে দৈনিককে ব্যবহার করে (অর্ধসত্য, সাহিত্য বিকাশ, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০৪)। প্রখ্যাত সাংবাদিক-কলামিষ্ট ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হক লিখেছিলেন, 'বাংলার প্রেস আজ পৃথিবীর নিকৃষ্টতম ম্যানেজ্‌ড প্রেসের একটি। এটি এখন কোনক্রমে রাষ্ট্রীক ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে পরিমাণ ও গুণগতভাবে বৃদ্ধি করার কোন প্রতিষ্ঠান নয়। আবদ্ধ প্রেস অন্ধকারে ও শৃঙ্খলে আবদ্ধ প্রাণীর মতোই বিকাশহীন ও পচনশীল হতে বাধ্য। এতসব বাধাবন্ধের পরেও বাংলাদেশের প্রেসের মূলধারা এবং প্রবণতাটি দালালির বিপরীতে। বীরত্বের প্রবণতা তার। (-স্বাধীনতা ও সংবাদপত্র,  দৈনিক সংবাদ এর বর্ষপূর্তি সংখ্যা, ২৬মে, ২০০৫, ১২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪১২)।  বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে ঘটে যাওয়া ব্যাপক পরিবর্তন বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের একটি মন্তব্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেছেন- 'সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় বিগত দুই দশকে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার জগতে বাহ্যিক দৃষ্টিতে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে এ ক্ষেত্রে। গণমাধ্যমকে দেশ, জাতি ও সমাজের সার্বিক কল্যাণে নিয়োজিত করতে হলে প্রয়োজন নির্মোহ, বস্তুনিষ্ঠ তথা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, বিচার-বিশ্লেষণ ও গবেষণা” (সাপ্তাহিক বর্তমান সংলাপ-এর বর্ষপূর্তি সংখ্যা, ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০১১)।
তাই বলা যায়, বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা ঐতিহাসিকভাবে মাটি, মানুষ তথা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ বলেই বর্তমান সময়ের সম্প্রচার জগৎকে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে হলে এগুলোর নজরদারির জন্য একটি সম্প্রচার কমিশন গঠন অত্যন্ত জরুরি। এই ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক জারি করা জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার গেজেট প্রকাশ একটি সূচনা মাত্র। এই সূচনাকে দেশ ও জাতির জন্য আশীর্বাদ হিসেবে চলমান রাখতে হলে এমন সব অভিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে দিয়ে সম্প্রচার কমিশন গঠন করতে হবে যারা দায়বদ্ধ থাকবেন শুধুই দেশ ও সমাজের প্রতি। ব্যক্তি ও কায়েমী স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে কাজ করবেন সমাজের সার্বিক ক্ষেত্রে সত্য প্রতিষ্ঠায়, তারা ধারণ, পালন ও লালন করবেন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আদর্শিক সেই সব সাংবাদিককে যারা এদেশের সমাজ ও  মানুষের কল্যাণে সাংবাদিকতার মহান ব্রতে একদিন নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছিলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন