মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৪

ইয়াবা কারখানা!

ইয়াবা কারখানা!

সংলাপ ॥ মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সাগর সীমান্তে ইয়াবা তৈরির জন্য গড়ে উঠেছে ৪০টি কারখানা। আর চট্টগ্রামের নৌপথে আসছে কোটি-কোটি টাকার এসব ইয়াবা। পার হয়ে যাচ্ছে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে। পাচারকারীরা অত্যন্ত সুকৌশলে এ মাদক নিয়ে আসছে রাতের আঁধারে। এ সব চালানের কিছু ধরা পড়লেও বেশির ভাগই চলে যাচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ইয়াবা পাচারের ঘটনায় কোস্টগার্ডের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। গত রোববার কোস্টগার্ড উদ্ধার করেছে ১০ কোটি টাকার ইয়াবা। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীতে। সূত্র জানায়, পাচারকারীরা ইয়াবা পাচারের রুট বদল করেছে। তারা এখন সড়কপথের চেয়ে নৌপথ বেশি বেছে নিচ্ছে। বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে সাগর পথে টেকনাফ দিয়ে ইয়াবা প্রবেশ করছে লাখ লাখ। বিশাল একটি অংশ চলে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের চট্টগ্রাম চ্যানেল দিয়ে দেশের বিভিন্ন নৌরুটে। কিছু আসছে কর্ণফুলী, সাঙ্গু, নাফ নদ দিয়ে পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এসব ইয়াবার চালান পাচারের কাজে জড়িত রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারা নৌকায় পণ্য পরিবহনের নামে এসব ইয়াবা নিয়ে আসছে গভীর রাতে।
আটক হওয়া ইয়াবার একাধিক চালানের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, বেশির ভাগ মাদক উদ্ধার করা হয়েছে ট্রলার ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা থেকে। গত শনিবার রাত দুইটায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে হানা দেন কোস্টগার্ডের সদস্যরা। এসময় তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খবর পান একটি চক্র প্রচুর পরিমাণ ইয়াবা সাগর থেকে কর্ণফুলী নদীতে নিয়ে আসছে। এগুলো আনোয়ারা হয়ে পাচার করা হবে বিভিন্ন অঞ্চলে।
কোস্টগার্ডের সদস্যরা স্থানীয় কাফকো এলাকায় অভিযান চালান। এ সময় তারা একটি নৌকা থেকে দুই লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। তবে কাউকে ঘটনার সময় আটক কিংবা গ্রেপ্তার করা যায়নি। পাচারকারীরা কোস্ট গার্ড সদস্যদের দেখে নৌকা থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়ে। পরে নৌকায় খালি থাকা একটি তেলের কন্টেইনারের ভেতরে ইয়াবা ট্যাবলেটগুলো দেখা যায়। এ সময় কন্টেইনারে মোট ২০টি প্যাকেট পাওয়া যায়। যার প্রতিটিতে ১০ হাজার করে ইয়াবা ছিল। এর বর্তমান বাজারমূল্য ১০ কোটি টাকা।
চলতি বছরের গত ২০শে জুন গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ে আরও ৩০ হাজার পিস ইয়াবা। এগুলো পাওয়া যায় শহরের পাথরঘাটা ফিশারিঘাট এলাকা থেকে। এ ঘটনায় অবশ্য আক্তার ও আজম নামে দুই হোতাকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে প্রচুর পরিমানে ইয়াবা মাদক পাচার হচ্ছে। যার বেশির ভাগই আসছে মিয়ানমার থেকে। এসব ইয়াবার রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে টেকনাফের নাফ নদীকে।
পাশাপাশি কর্ণফুলী নদী হয়ে সাগর দিয়ে বিশাল চালান চলে যাচ্ছে নোয়াখালীর দিকে। পুলিশ কর্মকর্তারাও বিষয়টি স্বীকার করে জানিয়েছেন, আগের মতো সড়কপথে আর ইয়াবার চালান ধরা পড়ছে না। যেমনটি আটক করা হচ্ছে সাগর কিংবা নদী থেকে। আটক হওয়া আক্তার ও আজম এ বিষয়ে পুলিশকে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এসব চালান বড় বড় ট্রলার থেকে খালাস হচ্ছে। উপরের গ্রিন সিগন্যাল থাকায় সাধারণ নৌকাতেও নিয়ে আসা হচ্ছে কমপেক্ষে ৫০ থেকে ৮০ হাজার পিস ইয়াবা। সেগুলো আনা হচ্ছে মাছ ধরার বড় বড় ট্রলারে। এসব ইয়াবা তৈরি করছে মিয়ানমারের একটি চক্র। সেখানে ওরা কারখানা গড়ে তুলেছে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার বলেন, 'নৌপথে আটক করা বেশ কিছু চালানের ঘটনায় আমরা শঙ্কিত। কেননা, সড়কপথে গোয়েন্দা পুলিশ ভীষণ তৎপর রয়েছে। কিন্তু এখন যেভাবে সাগর কিংবা নদী দিয়ে ইয়াবা নিয়ে আসা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে পাচারকারীরা রুট পরিবর্তন করেছে। তবে আমরা পুলিশ বিভাগ এসব ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছি। বিষয়টি আর বেশিদূর এগোতে দেয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, নৌপথে নিরাপত্তা ও তল্লাশি বাড়ানোর জন্য শিগগিরই উপরের মহলের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে জরুরিভাবে কথা বলা হবে। পাচারকারীরা কৌশলে মাছের চালান কিংবা নৌকার পাটাতনের নিচ দিয়ে এসব ইয়াবা পাচার করছে। ঘটনাটি ভাবিয়ে তুলেছে পুরো পুলিশ বিভাগকে।
সাগরের ওই পাড়ে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে ইয়াবা পাচারের জন্য গড়ে উঠেছে ৪০টি কারখানা। বিভিন্ন ঘটনায় আটক হওয়া পাচারকারীরা এমনি তথ্য দিয়েছে তাদের। কক্সবাজার ও টেকনাফের গডফাদাররা এসব ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত। কেবলমাত্র জুন ও জুলাই মাসেই তারা উদ্ধার করেছে তিন লাখ ৮০ হাজার পিস ইয়াবা।
এ সব ঘটনায় আটক করা হয়েছে মাত্র ৫ জনকে। কেননা পাচারকারীরা প্রতিবারই কোস্টগার্ডের উপস্থিতি টের পেয়ে এসব ইয়াবা ফেলে  রেখে পালিয়ে যাচ্ছে। ঈদের আগে চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেলের কাছাকাছি একটি ট্রলারে অভিযান চালিয়ে দেড় লাখ পিস ইয়াবাসহ একজনকে আটক করেন কোস্টগার্ড সদস্যরা। তার নাম রফিক আজিজ (৫৫)। সে একজন বড় ধরনের ইয়াবা পাচারকারী। এ সময় সে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে ইয়াবা তৈরির একাধিক কারখানার কথা জানায়।

কোস্টগার্ড পূর্ব জোনের জোনাল কমান্ডার শহীদুল ইসলাম বলেন, পাচারকারীদের ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বেশ কয়েকজন বড় গডফাদার ধরা পড়েছে। তাদের কাছ থেকে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছি। আশা করছি এ রুটে ইয়াবা পাচার অনেক কমে আসবে। তিনি আরও বলেন, এত ইয়াবা কোথা থেকে আসছে তা নিয়ে আমাদেরও প্রশ্ন রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে বসে এগুলো তৈরি করা অনেক দুরূহ। কক্সজার, টেকনাফ দিয়ে ইয়াবা নিয়ে আসছে পাচারকারীরা। পরে  রুট হিসেবে ব্যবহার করছে   সাগর ও নদীগুলোকে। পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারের সঙ্গে এদেশের একটি বড় ধরনের সিন্ডিকেট যৌথভাবে কাজ করছে। ধারণা করছি তারাই ইয়াবা তৈরি করে এদেশে বিক্রির জন্য পাঠাচ্ছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন