বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৩

নিজেকে না জানলে আল্লাহ্‌কে জানা যায় কি?


নিজেকে না জানলে আল্লাহ্‌কে জানা যায় কি?

 

শেখ উল্লাস ॥

 

আজ বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে লাখ লাখ প্রবাসী যাদের অধিকাংশই শ্রমিক, এদেশের পোশাক-শিল্পে নিয়োজিত লাখ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক, যাদের অধিকাংশই নারী। বিদেশের মাটিতে দিন-রাত পরিশ্রম করে প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছে, আর গার্মেন্টস শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের খাটুনীর বিনিময়ে পোশাক-রপ্তানীর মাধ্যমে কাড়িকাড়ি টাকা আসছে এবং দেশের অর্থনীতিকে সচল করে রাখছে। আর সে কারণে, বলতে গেলে এরাই দেশের শান্তি (ইসলাম) রক্ষায় (হিফাজত) ভূমিকা রাখছে। কারণ, কর্মবিমুখ হলে জীবনে কী দুর্র্ভোগ পোহাতে হয় সে কথা কারো অজানা নয়। কর্মবিমুখদের স্থান ইসলাম ধর্মে নেই বলে বার বার কুরআন-হাদিসে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের মাদ্রাসাগুলো থেকে পাশ করে আসা অধিকাংশ লোকই শেষ পর্যন্ত কর্মবিমূখ হয়ে জীবনযাপন করতে হয়। কারণ, বর্তমান সময়ের বিশ্বে বসবাস করতে হলে যে ধরনের বিদ্যা অর্জন করতে হয় সেসব বিদ্যা মাদ্রাসাগুলোতে দেয়া হয় না বললেই চলে।

আমাদের মতো দেশে বিশ্বায়নের নানারকম ক্ষতিকর দিক থাকলেও এর সবচেয়ে বড়ো ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে এর মাধ্যমে এদেশের পরিশ্রমী মানুষগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। তারা নিজের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশের উপকারে আসছে। এই দেশে পোশাক-শ্রমিকরা যদি কাজ না করতো, এই দেশের শ্রমজীবী মানুষেরা বিদেশে গিয়ে শ্রমিকের কাজ করার সুযোগ না পেত তাহলে দেশের অর্থনীতির আজ কী অবস্থা দাঁড়াতো? পবিত্র কুরআনে স্বয়ং আল্লাহপাক বলে দিয়েছেন, ‘লাইসালিন সানা ইল্লা মা সাআঅর্থাৎ, মানুষ যা করে তা ব্যতীত মানুষের জন্য কিছুই নেই। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকোনোর আগেই তার মজুরি দিয়ে দাও। ইসলামের নবী নিজ হাতে খেজুর বাগানে কাজ করেছেন, কুয়ো থেকে পানি তুলেছেন। এমনকি সেবা-শুশ্রুষা করার জন্য দুশমন (শত্রু)র বাড়িতে ছুটে গিয়েছেন। এদেশে আজ যে হাজার হাজার মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ নির্মিত হয়েছে সেখানে লাখ-লাখ ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করছে, হাজার হাজার মানুষ শিক্ষকতা করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন সেসবের পেছনেও অনেক মানুষের শ্রম-ঘাম-মেধা-মনন ও অর্থ-প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটাতে হয়েছে। প্রকৃত অর্থে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার মধ্যে তো কোনো পার্থক্য নেই। ইংরেজিতে যাকে বলে স্কুল, আরবীতে তাকেই বলে মাদ্রাসা আর বাংলায় বলে বিদ্যালয় বা পাঠশালা। এসব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে একজন কোমলমতি ছাত্র বা ছাত্রীকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে বড় করে তোলা। যে প্রকৃত মানুষ হতে পারে না তার পক্ষে আল্লাহ-রাসুলকে চেনা আদৌ কখনো সম্ভব কি?। পবিত্র-কুরআন হাদীস নিয়ে গবেষণা করলে স্পষ্টতই দেখা যায় যে, আল্লাহ-রাসুলের সকল বাণীর মর্মকথা-যে নিজেকে চিনতে পারিয়াছে, সেই তার রব অর্থাৎ, সৃষ্টিকর্তাকে চিনিতে পারিয়াছে। নিজেকে চিনতে হলে যেখানে বর্তমান সময় ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কিত জ্ঞান-বিদ্যা অর্জন অতি আবশ্যকীয় কাজ, সেখানে কোনো মাদ্রাসায় এইসব বিদ্যা অর্জনের কোনো বিষয় পাঠ দান করা হয় না সে কথা সকলেরই জানা। বর্তমানে আমাদের দেশে যেসব মাদ্রাসা রয়েছে, সেখানে বর্তমান সময়ের জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের কোনো শিক্ষা যে দেয়া হয় না সে কথা কারো অজানা নয়। তাই যে নিজেকেই চিনল না, নিজের দেশকে চিনল না, পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা চিনল না, তার পক্ষে আল্লাহ-রাসুলকে চেনা কখনো সম্ভব কি-না সে প্রশ্নটি আজ ধর্মান্ধ, ধর্মবেত্তা ও ধর্মব্যবসায়ীদের জিজ্ঞাসা করা সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। ওরা নিজেকে চিনতে পারেনি বলেই মানুষ হত্যা করে, অন্যদেরকে কাফির-নাস্তিক আখ্যা দিয়ে, পুলিশ হত্যা করে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অরাজকতা তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে কত দুর্নীতিবাজ, সুদখোর, ঘুসখোর, মুনাফাখোর, জুলুমবাজ, শোষক, নিপীড়ক নির্যাতক বিশেষ করে ৭১-এ নারী নির্যাতনকারী রাজাকার-আলবদর ও নব্য রাজাকার রয়েছে, যুদ্ধাপরাধী রয়েছে যারা  সাধারণ মানুষের জীবনকে অশান্তিময় (অনৈসলামিক) করে তুলছে তাদের বিরুদ্ধে তো এইসব মাদ্রাসা ছাত্রদেরকে কোনো কর্মসূচি নিতে দেখা যায় না।

মহানবী (সাঃ)-এর জীবনী আলোচনা করলে দেখা যায়, আরব দেশের তায়েফ নগরীতে ইসলাম (শান্তি) ধর্মের কথা প্রচার করতে গিয়ে শত্রুরা তাঁকে তাঁর দাঁত পর্যন্ত ভেঙ্গে দিয়েছেন তবু তিনি শত্রুদেরকে অভিশাপ দেননি, প্রতিশোধ নেয়া তো দূরের কথা। অথচ স্বার্থপরতা ও ভোগ-বিলাসের রাজনীতিচর্চার সময়ে যখন দেশপ্রেম, মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ে এদেশের সচেতন যুবকরা যখন জেগে উঠল, ৭১-এর যুদ্ধাপরাধের বিচার চাইল তখন তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে যারা উঠে-পড়ে লেগেছে তারা যে আল্লাহ-রাসুলের প্রেমিক নন, বরং তায়েফের মাঠে নবীজীর দাঁত-ভাঙ্গনকারীদের উত্তরসূরি সে কথা কোন ঈমাণদার ব্যক্তির পক্ষে বুঝতে কষ্ট হয় না।   

বর্তমান সময়ে যেখানে মোবাইল ফোন, টিভি চ্যানেল ছাড়া একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথা ভাবাও যায় না, বিমান ভ্রমণে মক্কায় গিয়ে হজ্জ্বের কথা কেউ কল্পনাও করেনা সেই মোবাইল ফোন, বিমান এগুলো কিছুই কিন্তু কথিত ইসলাম হেফাজতকারীদেরকর্মের ফসল নয়। ওদের পূর্বসূরীরা এক সময় বলতো, টিভি দেখা, রেডিওর খবর শোনা, মানুষ চাঁদের দেশে পৌঁছেছে-এ কথা বিশ্বাস করা হারাম, জমিতে সার ব্যবহার করা হারাম, এখনো অনেক মসজিদে বলা হয়, অনেক কথিত শিক্ষিতরাও বিশ্বাস করেন ছবি তোলা বা ঘরে মানুষের ছবি রাখা হারাম বা ঘরে মানুষের ছবি থাকলে নামাজ হয় না, আল্লাহর ফেরেস্তা বা আল্লাহর রহমত আসে না। অন্ধকারযুগের চিন্তাজগতের এইসব মানুষকে তাই যখন মোবাইল ফোনে বা টিভি-চ্যানেলে কথা বলতে দেখা যায় তখন অত্যন্ত বেমাননই লাগে। কারণ, এইসব টিভি-চ্যানেল, মোবাইল ফোন যাঁদের পূণ্য কর্মের বদৌলতে আজ মানুষ ব্যবহার করতে পারছে তাঁদেরকেও এক সময় ওই কথিত হেফাজতকারীরা কাফের’, ‘নাস্তিকবলেছে। নিজের সম্পর্কে, নিজের যোগ্যতা ও জ্ঞান-দক্ষতা সম্পর্কে না জানতে পারলে বুঝি এমনটিই হয়। মরমী শিল্পীর ভাষায় বলতে হয়, ও যার আপন খবর আপনার হয় না, আপনারে চিনতে পারলে রে যায় অচেনারে চেনা। আর সে কারণে কাফের শব্দের অর্থ যে সত্য গোপণকারী, সে কথাটিও তারা আজও বুঝে উঠতে পারেনি।     
আজকে যারা ইসলামকে হেফাজতের নামে মহাসমাবেশ, লংমার্চ-এর মতো দুনিয়াদারি কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, সরকারকে ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য চাপ দিচ্ছে, নানা হুমকি-ধামকি দিচ্ছে  বস্তুতপক্ষে বিভ্রান্তির পথে আছে। শুধুই যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর লক্ষ্যে এবং যুদ্ধাপরাধীদের দেশি-বিদেশি মিত্রদের কোটি কোটি টাকার ভাগ নিয়ে যারা সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়, তাদের পূর্বসূরীরা যুগে যুগে  এ কাজটি করে  আসছে। কিন্তু সত্যেরই জয় হয়েছে আর মিথ্যাবাদীদের পরাজয় হয়েছে সব সময়। তাই বলতে হয়, আল্লাহ্‌ ও রাসুলকে পেতে হলে তাদেরকে অবশ্যই সত্যের পথে আসতে হবে। স্মরণ করতে হবে কুরআনের সেই বাণীটি-তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত করো না, আর জেনে শুনে সত্য গোপন করো না। আজকের বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের গৌঁরবগাঁথা ও ৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বা তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ও বিকাশকে যারা অস্বীকার করে, তারা প্রকৃত পক্ষে নিজেকেই অস্বীকার করে। এই দেশ ও সমাজে তাদের বাস না করাই ভালো। আর এখানে বাস করতে হলে নিজের দোষ-ত্রুটি স্বীকার করে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তারা এগিয়ে আসুক-এটাই চায় দেশবাসী। নিজেকে চিনতে না পারলে নিজের হেফাজত (রক্ষা), ইসলামের (শান্তি) হেফাজত কখনোই সম্ভব নয়। বরং সমাজে শান্তি (ইসলাম) বিনষ্টকারী হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন