বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৩

বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি


বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি

 

আবু নাঈম ॥ 

 

বিগত বিএনপি-জামাত শাসনামলের বাংলাদেশে বোমা সন্ত্রাস ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করতেন এবং বলতেনও, বাঙালি জাতির বাংলাদেশ জাতিসত্তার লক্ষ্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যূত, তথাকথিত ধর্মীয় ও পরনির্ভর হয়ে উঠছে। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আজ দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায় এই ভূখন্ড পুরোপুরি স্বাধীন, সার্বভৌম ও গণপ্রজাতন্ত্রী এবং বাঙালি জাতিসত্তায় উন্নত শির নিয়ে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ।

রাষ্ট্রধর্ম ইসলামহলেও বাংলাদেশ তথাকথিত ধর্মরাষ্ট্রের পথে আদৌ পা বাড়ায়নি। বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামোর দূরাবস্থা ও রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্খার ভিতর-বাইরের নানা চাপের মধ্যে থেকেও দেশবাসী শান্তি (ইসলাম)-কে আঁকড়ে ধরে আছে এবং সুন্দরকে ছেড়ে দেয়নি। যতদিন বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে, অটুট থাকবে একুশের ভাবাদর্শ, যতদিন উৎসাহ যোগাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা, ততদিনই দেশবাসী ধর্মীয় উগ্রতা ও ধর্মান্ধতার কুৎসিতের বিরুদ্ধে লড়তে থাকবে। লড়াই ক্রমশ বাড়ছে এবং প্রবলও হচ্ছে। বাঙালিরা লড়ছে বলেই তথাকথিত ইসলামপন্থীরা নিজেদের তৈরি করা স্বার্থের ইসলাম কায়েম করার দাবিদারদের বর্বরোচিত হামলায় বাংলাদেশ বারবার আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের ধর্মভীরু মানুষই যারা সত্যিকার শান্তি (ইসলাম) প্রিয় তারাই এর বিরুদ্ধে লড়ছে। এ লড়াই সংশয়হীন এবং লক্ষ্যময়। সেই লক্ষ্য হচ্ছে জাতিসত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ এবং স্বনির্ভরতার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা। এই মহৎ ও মানবিক উদ্দেশ্য নস্যাৎ করবে বলেই একুশে ফেব্রুয়ারীর, ষাটের দশকের গণআন্দোলনের এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের পরাজিত অমানবিক তথাকথিত রাজনৈতিক ইসলামের মিথ্যাচারের শক্তি জোট একই দিনে ২০ মিনিটের মধ্যে এ দেশের ৬৪টি জেলার ৬৩টিতে প্রায় ৫১০টি বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পেশী প্রদর্শন করেছিল। তারা বলতে চেয়েছে তারা জাগ্রত, সম্মিলিত, শক্তিময় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একচ্ছত্র বিরুদ্ধশক্তি। তাদের এ হামলা ও আত্মপ্রকাশের চেষ্টা কেবল বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে নয়, বাঙালি জাতিসত্তা এবং উপমহাদেশের লোকায়ত ভাবাদর্শেরও বিরুদ্ধে।

উগ্র, ধর্মান্ধ ও কুৎসিত সন্ত্রাসীরা ধর্মযোদ্ধার দলবলে নিজেদের দাবি করেছে এবং প্রকাশ করতে চেয়েছে এ হামলার একমাত্র কারিগর হিসেবে। এ গোষ্ঠী অবশ্যই এখন বাঙালি জাতির সামনে, কিন্তু আড়ালে আছে আরো অনেক বড় বড় মাথা আর দেশী-বিদেশী সংগঠন। যেমন,  আল-কায়দা ও আফগান তালেবানদের সুগঠিত শক্তিও সরাসরি সাহস ও সশস্ত্র কৌশল যোগাচ্ছে  বলে ইসলামি চিন্তাবিদগণ মনে করছেন। সরকারকে ক্ষমতা থেকে ছুড়ে ফেলতে হবে। একমাত্র ধর্মান্ধরাই আল্লাহ্‌র বাহিনী। তাদের আহ্বান তথাকথিত তাদের গড়া (শরিয়া) ইসলামী অনুশাসনকে সামনে রেখে গড়তে হবে তৌহিদের রাজত্ব’ !

সুপরিকল্পিত এই প্রচারপত্র তাত্ত্বিক দিক থেকে ছিল অত্যন্ত সুগঠিত এবং আল-কায়দার ভাবাদর্শে লিখিত। স্মরণ করা যেতে পারে তিরিশ ও চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও গণতন্ত্রের আকাঙ্খাকে এই আদর্শের ভিত্তিতেই কুফরি ও আল্লাহ্‌ বিরোধী বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মৌদুদি। তারও লক্ষ্য ছিল হুকুমত-ই-এলাহীর (আল্লাহ্‌‌র শাসন ব্যবস্থা) পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা। সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন তিনিও। কিন্তু আল্লাহ্‌‌র রহমতে তা বাস্তবায়িত হয়নি। তবে তাদের ভাবাদর্শের মৃত্যু ঘটেনি। আফগানিস্তানের তালেবানদের সংহত করে লাদেনপুত্র ওসামা-ওহাবী ভাব ও আদর্শকে বিশ্বময় প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে চাইছে। বৃহৎ শক্তির মদদে তাদের সশস্ত্র কৌশল আজ সভ্যতার অন্যতম সংকট। তথাকথিত হুকুমত-ই-ইলাহী প্রতিষ্ঠার অছিলায় বাংলাদেশে তারা বহু বাংলা-আরবী-ফার্সি নামে সংগঠন গড়ে নিজেদের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে চলছে। এটা সন্দেহ নয়, এটা বাংলার আকাশে-বাতাসে-মাটিতে যে ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ধার্মিক শান্তিপ্রিয় বাঙালিদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের কারণ :

* সশস্ত্র বিপ্লবের হুমকি ও সন্ত্রাস,

* আফগানিস্তানের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের প্রবেশ ও অস্ত্রশিক্ষা,

* প্রকাশ্য স্লোগান - বাংলা হবে আফগান, আমরা হবো তালেবান। সংশয়হীন এই বিশ্বাসের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে, মোল্লা ওমর আর ওসামার মাথা থেকে নিজেদের মাথাকে, ওসামার ভাবাবেগ থেকে নিজেদের ভাবাবেগকে, আল-কায়দার কৌশল থেকে নিজেদের কৌশলকে, তালেবানদের সন্ত্রাস থেকে নিজেদের আগ্রাসী সন্ত্রাসকে এ সমস্ত ইসলাম ধর্মের নামে সংগঠনগুলো কখনো আলাদা করেনি এবং আলাদা করে দেখতে শেখেনি ধর্মান্ধতার কারণে। লড়াইকে বরাবর তাদেরই হাতিয়ার ভেবেছে - আজও ভাবছে।

এসব কারণেই ইসলামী চিন্তাবিদরা মনে করছেন, ধর্মান্ধরা যেমন যে কোনো জাতিরাষ্ট্রের, যে কোনো জাতিসত্তার এবং সভ্যতা ও মানবতার শত্রু, ঠিক তেমনি বর্বরতার ওজনে বাঙালির শান্তিপ্রিয় স্বচ্ছ জীবন, স্বপ্ন, ঐক্য ও ঐতিহ্যের জঘন্যতম শত্রুর নাম স্বাধীনতা ও যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠী। বাংলাদেশের সত্তার উপর ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য যে কোনো হামলা বাঙালি জাতিসত্তার উপর হামলা, তাদের যে কোনো হুমকি সমগ্র দেশের বিরুদ্ধে হুমকি, তাদের যে কোনো বর্বরতা ঘায়েল করতে পারে বাঙালির চোখকে, কানকে,  স্বপ্ন ও আকাঙ্খাকে, কিন্তু গোটা জাতিসত্তাকে নয়।

বাংলাদেশ যেমন আক্রান্ত হচ্ছে তেমনি পৃথিবীর সব দেশে যেখানে বাঙালি আছে সবাই মর্মাহত। বাংলাদেশে রক্ত ঝরছে সরাসরি আর বিশ্বজুড়ে বাঙালির রক্তক্ষরণ হয়েছে হৃদয়ে, ভাবাবেগে এবং গভীর উদ্বেগে। তাই বিশ্বব্যাপী বাঙালি আজ চুপ থাকতে পারে না, চুপ থাকা উচিতও নয়। উদ্বেগ ও ভাবাবেগকে ভাষায়, প্রতিবাদে, মিছিলে, সম্মিলিত প্রতিজ্ঞায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। দরকার প্রবল প্রস্তুতি ও এর বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসিকতা। শান্তি ও স্থিতিশীল বাংলাদেশ বাঙালিদের একমাত্র স্বপ্ন ও আকাঙ্খা। বাংলাদেশে বাঙালি লড়ছে। এটা অনস্বীকার্য বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে ৯০% মুসলমান। তাদের মধ্যে ৮৫%-ই ধর্মভীরু ও শান্তিপ্রিয়। দুর্ভাগ্য ৫% উগ্রধর্মান্ধরা মধ্যপ্রাচ্যের এক হাজার বছরের পুরানো সংস্কৃতিকে এখানে প্রতিষ্ঠিত করতে মত্ত কিন্তু ইসলামী মূল্যবোধগুলো যে বাঙালির মন ও মননে, কথা ও কথকতায়, চিরায়ত ঐতিহ্যের উত্তারাধিকারে তিন হাজার বছরের বাঙালির জীবন প্রবাহে অবিচ্ছেদ্য ও অভিন্ন রয়েছে তা জেনেও তারা না জানার ভান করছে।
বাংলাদেশের মাটির তলার সম্পদের লোভে আধিপত্যবাদী শক্তিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ৫% ধর্মান্ধদের মধ্যে একটি বিরাট অংশকে মদদ দিয়ে ক্ষমতাপ্সিু পদলেহী সেবাদাস? তৈরি করে ধর্মের নামে সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে যা সমগ্র জাতিসত্তার জমিন ও দেহের উপর হামলা। একে রুখতে হবে।  প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বজ্রকন্ঠে একই সুরে বলতে হবে - বাঙালির বাংলাদেশ, তিনহাজার বছরের বাঙালি শান্তির প্রতীক, শান্তিই ইসলাম। ধর্মান্ধরা সাবধান! আর এক পা বাড়ালে তোমরা হবে খান খান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন