নারী
অধিকার পূর্ণ বাস্তবায়নে
ঐক্যবদ্ধ
সামাজিক আন্দোলন সময়ের দাবি
শাহ সূফী এমদাদুল হক
॥
বাংলার মা-বোনেদের
ঘরে বসে থাকার দিন আর নেই। বিশ্বজুড়ে নারী এখন অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। অনেক সংগ্রাম
ও বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বাংলার নারী জেগে উঠেছে নিজেদের কর্মস্পৃহা ও যোগ্যতায়।
পর্দার কারাগার থেকে বের হয়ে সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারী তার মেধা ও প্রতিভার পরিচয় দিচ্ছেন।
বাংলাদেশে নারীশিক্ষার উন্নতিও হয়েছে ব্যাপক। তবে নারীর জীবন চলার পথ কখনও মসৃন ছিল
না। বারবার তাদের চলার পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। পুরুষের স্বার্থে যুগে যুগে
নারী অধিকার হরণ করা হয়েছে ধর্মকে ব্যবহার করে। নারী যখন এগিয়ে যায় তখন দেশ এগিয়ে যায়, এগিয়ে যায় দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক সমিপ্রতী। কিন্তু কিছু ধর্মান্ধ মানুষ মনে
করে নারী এগিয়ে গেলে ধর্ম পিছিয়ে যায়, ধর্মনাশ হয়।
ভারতবর্ষে নারী অধিকার
প্রতিষ্ঠায় সমাজ সংস্কারকদের দীর্ঘ লড়াই করতে হয়েছে পুরোহিতদের সাথে। হিন্দুধর্র্মের
নামে ধর্মান্ধগোষ্ঠী সতীদাহ প্রথা চালু করেছিল, নিষিদ্ধ করেছিল বিধবাবিবাহ।
ধর্মের নামে এদেশে প্রচলিত ছিল বহুবিবাহ ও
বাল্যবিবাহ। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে এসব ধর্মান্ধতা এখন দূর হয়েছে। সম্প্রতি
ইসলামের নামে নারীকে দমিত ও অবগুন্ঠিত রাখার ষড়যন্ত্র শুরু করেছে তথাকথিত হেফাজতে ইসলাম
নামে একটি উগ্র ধর্মান্ধগোষ্ঠী। তথাকথিত হেফাজতে ইসলাম দাবি তুলেছে - নারী-পুরুষের
অবাধ বিচরণ নিষিদ্ধ করতে হবে। নারী ঘরের বাইরে বের হতে পারবে না, নারী সংসারধর্ম ছাড়া অন্য কোন কর্ম করলে বে’দাত হবে! ইত্যাদি দাবি
তুলে তারা নারীর পায়ে ধর্মের শিকল পরাতে চায়।
তথাকথিত হেফাজতে ইসলামের
এইসব দাবির কোন কুরআনিক ভিত্তি নেই। কুরআনের আদেশ - ‘তোমরা নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন করো।’ (সুরা নিসা : ১৯)। ইসলাম প্রত্যেক নর-নারীর জন্য জ্ঞান অর্জন করাকে ফরজ বলে ঘোষণা করেছে। সম্পত্তির
মালিকানায়,
অর্থোপার্জন, এবং অন্যান্য সকল নাগরিক
অধিকার সমূহে নারী-পুরুষের সমান অধিকার দিয়েছে। অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে নারীর অধিকার
সম্পর্কে কুরআনের নির্দেশ - ‘পুরুষ যা উপার্জন করেছে, তাতে তাদের অধিকার
রয়েছে এবং নারীরা যা উপার্জন করেছে তাতে তাদের অধিকার রয়েছে।’ (সুরা নিসা : ৩২)। কুরআন নারীদের যুদ্ধে যাবার অধিকার দিয়েছে। কুরআন বলছেন - “তারাই বিশ্বাসী যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার পর সন্দেহ
রাখে না এবং ধনপ্রাণ দিয়ে আল্লাহ্র পথে সংগ্রাম করে, তারাই সত্যনিষ্ঠ।” (সুরা হুজুরাত : ১৫)।
কুরআন শুধুমাত্র নারীকে
পর্দা পালনের নির্দেশ দেয়নি। বরঞ্চ এ নির্দেশ প্রথম দেয়া হয়েছে পুরুষকে। (দ্রষ্টব্য
- সুরা আন নূর : ৩০)। ব্যভিচারের উৎস নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ নয়, পুরুষের ‘চোখ।’
পুরুষ যদি নিজেদের চোখ নিয়ন্ত্রণে না রেখে একক ভাবে তা নারীর
উপর চাপিয়ে দেয় এবং নারীকে অবরুদ্ধ রাখতে চায় তবে তা হবে জুলুম।
যুদ্ধের সময় মেয়েদের
মুখ ঢেকে রাখতে বলা হয়েছে শত্রুর নজর থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য (সুরা-৩৩ : ৫৯)।
কিন্তু তাই বলে সব সময় সব ক্ষেত্রে মুখ ঢেকে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়নি। হজব্রত পালনের
সময় মেয়েদের মুখন্ডল রাখতে হয় অনাবৃত। নারীকে পুরুষের সাথেই একত্র হয়ে কাবাগৃহ সাতবার
প্রদক্ষিণ করতে হয়। তিনবার দ্রুত পদক্ষেপে আর চারবার মৃদু পদক্ষেপে হজের সময় নারী-পুরুষ
একত্রেই কাবাগৃহ প্রদক্ষিণ করেন।
ইসলাম নারী স্বাধীনতার
পরিপন্থী কোনো ধর্ম নয়। কিন্তু ইসলাম চায় না সমাজে যৌন বিশৃঙ্খলা নেমে আসুক। ইসলাম
চায় এমন একটা সভ্য সমাজ, যে সমাজে নারী একাকী নির্জন রাস্তায় দিবালোকে কিংবা রাতের অন্ধকারে
নির্ভয়ে বিচরণ করতে পারবে। ইসলাম এমন একটা সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যে সমাজে মোহাম্মদ (সা.)-এঁর ভাষায় - “যদি একজন সুন্দরী রমনী অলংকারে সজ্জিত হয়ে
সানয়া থেকে হাজরামাওত পর্যন্ত একাকি পথ চলে তাহলে একমাত্র আল্লাহ্র ভয় ছাড়া আর কোন
ভয় তাঁর মনে থাকবে না।”
নারীর স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন
রেখে সমাজ থেকে ব্যভিচার, ধর্ষণ, নারী-নির্যাতন রোধ করতে হবে। নারীকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে নিজের
পায়ে দাঁড়াতে হবে। মাথা উঁচু করে বলতে হবে - আমি মানুষ! আমি নারী! এবং আমি মুসলিম!
আমার ধর্ম আমাকে আমার উপার্জনে জীবিকা নির্বাহের নিশ্চয়তা দিয়েছে।
আজ তথাকথিত হেফাজতে ইসলাম ধর্মের নামে নারীর অধিকার সংকুচিত
করার যে দাবি তুলছে তা প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নারী অধিকার
পূর্ণ বাস্তবায়ন না করে ইসলাম বা শান্তি প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, নির্বিশেষে
নারীর অধিকার পূর্ণ বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ হবার সময় এসেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন