শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

দল আছে নেতা নেই


দল আছে নেতা নেই

সংলাপ ॥ বাংলাদেশের রাজনীতিতে শাসক আসলে কোনও দল নয়। একজন ব্যক্তি। বিরোধীদের আক্রমণের, ঘৃণার লক্ষ্য কোনও শাসক দল নয়। নিছক একজন ইন্ডিভিজুয়াল। দলগুলোর লড়াই একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে। একজন ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা। অর্থাৎ তাঁকে ঘিরে একটি গোটা দেশের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে, একজন ব্যক্তির জয় পরাজয় চর্চায় পরিণত হওয়া এরকম নজির আর তৈরি হচ্ছে না কেন? শাসক দলকে যরা জেতাতে চান তারা কোনও দলকে ভোট দেন না। তারা আদতে হাসিনাকে জয়ী দেখতে চান। শাসক দলকে যারা হারাতে চান তারা আসলে হাসিনাকে পরাজিত দেখতে চান। দেশের রাজনীতির ভরকেন্দ্র হিসেবে এভাবে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে রাখা কীভাবে সম্ভব হয়ে উঠলো এটা প্রশ্ন নয়। সেই আলোচনা অনেক হয়েছে। প্রচুর চর্চাও হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে হাজারো যুক্তি সহ। হাসিনাকে সমর্থন করাই উচিত? নাকি বিরোধিতা করাই সঙ্গত? সেটাও এখানে আলোচ্য নয়। ওটা যার যার গণতান্ত্রিক অধিকার ও বুদ্ধিবিবেচনা দিয়েই বিচার করা কাম্য।
প্রশ্ন হলো, এরকম আর কোনও নেতা-নেত্রী, যে কোনও দলেরই হোক, উঠে আসছেন না কেন? চারদিকে এত আধুনিকতা, এত ঝকঝকে প্রচারের ব্যবস্থা, এত সুযোগ, এত সমস্যা। তাও বাংলাদেশ কোনও উজ্জ্বল একক শক্তিশালী চরিত্রকে দেখতে পাচ্ছে না আর! কেন? কেন বিরোধী সমর্থকদের কাছে বাংলাদেশের জন্য কোনও হাই প্রোফাইল নেতা নেই? কেন কোন দলের সমর্থকরা নিজ নিজ দলকে সমর্থন করছেন? কোনও প্রভাবশালী লিডারের জন্ম হচ্ছে না কেন? এমনকী হাসিনার পর আর নয়। যুক্তি দেয়া যেতে পারে এটা তো অন্য দলগুলোর শক্তি, যে তারা দল হিসেবেই লড়াই করছে, একক ব্যক্তির উপর নির্ভর করে নয়! কিন্তু তাহলে খালেদা বা এরশাদের দরকার হচ্ছে কেন? কেন যে কোনও নেতাকেই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হয় না? অন্য যে কোনও কাউকেই তো প্রজেক্ট করা যায়? তা তো হচ্ছে না! তার মানে সব দলই জানে একজন নায়ক অথবা নায়িকার দরকার দলের চালিকাশক্তি হিসেবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার আগে থেকেই বহু নায়ক-নায়িকার আবির্ভাব ঘটেছে। অথচ বর্তমানে বহু বছর হয়ে গেল কোনও একক ক্যারিশমার চরিত্র আসছে না। যাকে পছন্দ অথবা অপছন্দ যাই করি, প্রভাবটাকে অস্বীকার করতে পারি না। সেরকম কোনও উচ্চতার, মাপের লিডার কেন পাচ্ছি না? একক চরিত্র সেই একজনই। সেই ১৯৮৪ সাল থেকে শেখ হাসিনা। তিনি ষাটোর্ধ্ব। তাঁর প্রতিপক্ষে কোনও একইরকম অথবা অন্তত কিছুটা একক জনপ্রিয় এরকম নায়ক-নায়িকা নেই। আছে দল। বাংলাদেশের রাজনীতিকরা তেড়ে তাঁকে আক্রমণ করছেন, অথচ যে বয়সে তিনি যা হয়ে উঠেছিলেন, তার ধারেকাছেও তারা যেতে পারছেন না কেন? এই     বিশ্লে­ষণটা নিজেরা কিন্তু করছেন না। কেন একজনেরও একার ডাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় চলে আসছেন না? সামাজিক কারণটি কী? শুধু রাজনীতির আঙিনায় নয়। সাহিত্য, সঙ্গীত, সিনেমা কোথাও কোনও আইকনের জন্ম হচ্ছে না। যাঁকে নিয়ে গোটা সমাজ আলোচনা করতে পারে।
প্রধান কারণ হলো বাঙালি একক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আর কিছু করার সাহস পায় না। আমরা নিজেরাই বিশ্বাস করি না যে এককভাবে আমি অনেক কিছু করতে পারি। একটা চেষ্টা করে দেখি না! এভাবে আর ভাবি না। অন্তরের শক্তির নিরিখে সকলেই আদতে অ্যাভারেজ তথা মানসিক শক্তিতে ক্ষুদ্র হয়ে গিয়েছি। আগে মাঝেমধ্যেই সিজনে সিজনে বাঙালির হুজুগ পেত। এখন বাঙালির সারাবছর প্রতিবাদ পায়। কিছু না কিছু ইস্যুতে প্রতিবাদ প্রতিবাদ খেলায় আমরা মেতেই আছি। প্রতিবাদ থেকেই তো লিডারের জন্ম হয়। অথচ এখানে এত প্রতিবাদ হলেও কোনও সর্বজনগ্রাহ্য জনপ্রিয় নেতার উত্থান ঘটে না। আজকের ছাত্র রাজনীতি বলে আদতে কিছুই নেই। সেই একই কারণ। এই ছাত্রদের প্রতিবাদ পায় নন ইস্যুতে। ভিড় থাকলে একক শক্তির দরকার হয় না। ভিড়ই তখন আমার শক্তি। তাই দল বেঁধে তারা প্রতিবাদী সাজলেন এবং পেটালেন। দুর্ব্যবহার করলে পুলিশে দেয়াই স্বাভাবিক ছিল। সেই নিয়ন্ত্রণ দেখালেন না ওই আক্রমণকারীরা। আচরণের মধ্যে কী আধুনিকতা আছে? ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জয়গান আছে? না ওসব নেই। আসলে রয়েছে একটি প্রচ্ছন্ন মনোভাব। সেটি হলো কাউকে পাত্তা না দেয়া। অগ্রাহ্য করা। কে কী দেখছে, কে কী ভাবছে ওসবে গ্রাহ্য না করা। কিছু কিছু শব্দ সকলে জানে না। অথবা মানেও না। যেমন ডিসেন্সি, যেমন ডিগনিটি। কখনও পারিবারিক শিক্ষা, কখনও ব্যক্তিগত বোধ থেকে ওই শব্দগুলো অধিগত হয়। এই দুই পক্ষের আচরণেই কোনও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ছাপ নেই। অথচ এরকম একটা নন ইস্যু নিয়ে আমরা দুভাগ হয়ে গেলাম। অতিবাহিত করলাম দিনের পর দিন। আগুন জ্বললো আলাপ আলোচনায়। এই যে অগভীরতা এটা প্রমাণ করে আসলে আমাদের মধ্যে আর প্রকৃত আগুনই নেই।
যে আগুনটা ১৯৪৭ স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে এই সেদিন সত্তর দশক পর্যন্তও ছিল। ভুল হোক ঠিক হোক সেদিনের যুবক-যুবতী নিজেদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আদর্শ সমাজ গঠনের স্বপ্নে ঝাঁপিয়েছিলেন। আজকের ছাত্রসমাজ শেষ কবে কৃষকদের জন্য মিছিল করেছে? কবে শ্রমিকদের জন্য রাস্তায় নেমেছে? কবে কর্মসংস্থানের দাবিতে আন্দোলন করেছে? আমরা এখন সর্বাগ্রে ঝাঁপাই অন্যকে অবজ্ঞা করার দিকে।
আমরা নিজেরা প্রতিদিন যে সংসার, পেশা, আড্ডা, ফেসবুক, প্রেম, টিভি, যে কাজগুলো করে থাকি তা আসলে আগের দিনেরই প্রায় পুনরাবৃত্তি। পরদিনও ওই কাজগুলোতেই ব্যাপৃত থাকি। আমাদের এই স্বল্প জীবৎকালে এমন কিছুই খুব বেশি করি না যাতে নিজের প্রতি আমাদের গর্ব হয়। আমাদের অহংকার আছে, দম্ভ আছে, আত্মাভিমান আছে। কিন্তু নিজের প্রতি নিজেদের কতজনের আন্তরিক শ্রদ্ধা আছে? নেই। কারণ নিজেকে ছাপিয়ে, অন্যকে ছাপিয়ে নিজের চেষ্টায় এমন কিছু হয়ে উঠতে পারি না যাতে আমাদের কেউ রোলমডেল করতে পারে। আমাদের কজনকে দেখে অন্য কেউ ভাববে হ্যাঁ ওকে অনুসরণ করা যায়? ওর অনুগামী হওয়া যায়! ভাববে না। কারণ ক্রমশই আমাদের আচরণে অন্যকে অপমান করে নিজেকে জয়ী প্রমাণের প্রবণতা প্রোথিত হয়েছে। নিজের অবস্থান, কর্মে আর আদর্শে বলীয়ান হয়ে জয়ী হওয়ার চেষ্টা নেই। সেটা কঠিন।
আমাদের আত্মশক্তির প্রতি বিশ্বাস নেই। আমরা আজ লঘুতার চ্যাম্পিয়ন! লিডার বা নায়ক হওয়ার প্রধান শর্ত হলো অন্যরা আমাতে মুগ্ধ হবে। জনতা মনে করবে আমার মধ্যে এমন কিছু আছে যা আর কারও মধ্যে পাওয়া যাবে না। একে বিশ্বাস করা যায়। একে নির্ভর করা সম্ভব। ইনি আমাদের কথা বলেন। আর সর্বোপরি পারলে ইনিই পারবেন। এরকম কোনও লিডার আর বাংলাদেশে আসছে না। কারণ আমাদের নিজেদের উপরই তো বিশ্বাস নেই যে আমার সত্যিই গুরুত্ব কতটা। সেই কারণেই এই সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমা অবস্থা। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা প্রতিটি প্রতিবাদে আছি, প্রতিদিনের সুপ্রভাতে আছি, প্রতিদিনের রাজনীতিতে আছি, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীতে আছি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় আছি। কিছু না কিছু বলছি। শেয়ার করছি। পোস্ট করছি। কারণ কী? কারণ হলো একটি বহুল প্রচলিত ইংরেজি আপ্তবাক্য। বাক্যটির সংক্ষেপিত রূপ বেশি জনপ্রিয়। ফোমা। ঋঙগঅ। পুরো কথাটি হলো ‘ফিয়ার অফ মিসিং আউট!’ অর্থাৎ আমাদের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে না তো? আমরা হারিয়ে যাচ্ছি না তো পরিচিতদের মন থেকে? আমাকে ভুলে যাচ্ছে না তো? আমারও কিছু বলার আছে..আমার কথার গুরুত্ব দাও সবাই…। এই তাড়নাকেই বলা হয় ফিয়ার অফ মিসিং আউট। এটা যদি গ্রাস করে তাহলে তো বুঝতে হবে আমাদের আত্মবিশ্বাস শূন্য। এরকম সমাজ থেকে নেতার জন্ম হবে কীভাবে? তাই হচ্ছেও না। নতুন এই যুগে বাংলা দল আছে, নেতা নেই। ভিড়ের জয়গান আছে। ভিড়তন্ত্রে নেতা জন্মায় না। একক শক্তি নেই, দল আর ভিড়ের শক্তি তাই বাড়ছে। যেহেতু অনেকগুলো একের যোগফলেই ভিড় বা দল তৈরি হয়, তাই সেইসব দলের শক্তিতেও আন্তরিক প্রাণ নেই।
আছে নেহাত দেহের শক্তি। যেটা অত্যন্ত স্থূল। প্রাণের শক্তির সহজাত আকর্ষণ আছে, দেহের শক্তির আছে নিছক বলের জোর। বল দিয়ে জোর খাটানো যায়, আন্তরিকতা টানা যায় না। নিজেরা বাস করি ফাঁকি আর দ্বিচারিতার মানসে। প্রতারণা আর অসততার বিরুদ্ধে আমরা গর্জে উঠি দল আর সমষ্টির প্রতিবাদে, অথচ পকেটে ছেঁড়া নোট থাকলে সংগোপনে চেষ্টা করি বাজারে, দোকানে, অথবা অন্ধকারে রিকশা চালককে বা কোন দোকানীকে গছিয়ে দিতে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন