শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

সময়ের সাফ কথা…. নির্বাচনে ব্যালটে ‘না’ প্রতীক সময়ের দাবী

সময়ের সাফ কথা…. 

নির্বাচনে ব্যালটে ‘না’ প্রতীক সময়ের দাবী

সংলাপ ॥  ভোট দেয়ার অধিকার গণতন্ত্রের একটি বলিষ্ঠ ব্যবস্থা। ভোট দেন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকরা। তারা মানসিকভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিক। ক্ষমতায় ও বিরোধী আসনে বসার পক্ষে কোন দল বা জোট যোগ্যতম সেটি বাছাই করার জন্য তারাই যথেষ্ট। বাংলাদেশ বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশ। তাই ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছনোর জন্য দল ও জোটগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বনিদ্বতা, লড়াই চলাটাই স্বাভাবিক। রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হলো দেশ ও জনগণের কল্যাণ। দেশবাসীর সেবা বা দেশোদ্ধারের কথা বলেই রাজনীতিকরা ভোট নেন। কিন্তু, দেশবাসীর অভিজ্ঞতা বেশিরভাগ সময়েই অন্য। ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পরই রূপ, রং, স্বভাব বদলে ফেলেন অনেকেই। প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা হাতানোর পর সাধারণ মানুষকেই দূরে রাখতে তৎপর হন তারা। হঠাৎ হঠাৎ, কারও কারও ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পত্তি কয়েকশো শতাংশ বেড়ে যায়। রাজনীতিকদের ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়ে ওঠে। দেশজুড়ে এই যে কেলেঙ্কারির মিছিল সে তো এই জন্যই। ক্ষমতার সঞ্জীবনি সুধা দখলের জন্য দলগুলোর মধ্যে যে মরিয়া প্রচেষ্টা চলে, তাতে বেশিরভাগ সময়েই নীতি-নৈতিকতার সীমা লঙ্ঘিত হয়। কিছু দল এমন কিছু প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয় যারা কোনওভাবেই সংসদীয় রাজনীতির আঙিনায় পা রাখার উপযুক্ত নয়। সমাজের চোখে তাদের অনেকেই অপরাধী হিসেবে পরিচিত। আবার কেউ কেউ টাকার জোরে অপরাধী তকমাটি আড়াল করে ফেলে। গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল হলেও সেই জায়গায় তাদের গালভরা পরিচয় হয় ‘সমাজসেবী বা দেশদরদী’। ভোটের বিপুল খরচ জোগাড় করতেই বিভিন্ন দল এই ব্যবসায়ী রাজনীতিকদের আমদানি করে। সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠা সচেতন নাগরিকদের পক্ষে এইসব তথাকথিত সমাজসেবী ভোটপ্রার্থীদের মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
একটি আসনে মোট দশজন প্রার্থী আছেন। কিন্তু, কোনও ভোটারের চিন্তা হতে পারে যে প্রার্থীদের সকলেই একই গোত্রের। তিনি এদের কাউকেই জনপ্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চান না। তখন তিনি কী করবেন? ভোট দেবেন না?
এ নিয়ে গণতন্ত্র বিশ্বে সমাধান দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ আদালত এক রায়ে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে, এবার থেকে ব্যালটে এবং ভোটযন্ত্রে (ইভিএম) ‘এনওটিএ’ বা ‘নোটা’ নামক একটি পৃথক অপশন রাখতে হবে। একটি আসনের সকল প্রার্থীকেই যেসব ভোটারের অপছন্দ (‘নান অফ দি অ্যাবাভ’) তারা নোটায় ভোট দেবেন। সবার ওপরে থাকবে বিভিন্ন দলের কিংবা নির্দল প্রার্থীদের নাম ও প্রতীক। একদম নীচে থাকবে নোটার প্রতীক। গোপনীয়তার অধিকারটিও সুরক্ষিত রাখার কথা বলা হয়েছে।
বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচনে প্রার্থীদের জয় পরাজয়ে না-ভোটের কোনও ভূমিকা স্বীকার করা হয় না। একটি আসনের বেশিরভাগ ভোটার না-ভোট দিলেও কারও জয় আটকানো যাবে না। সামান্য প্রদত্ত ভোটের মধ্যেও যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন, নির্বাচন কমিশন তাকেই বিজয়ী বলে ঘোষণা করে দেবে। তবু, না-ভোটের গুরুত্ব নস্যাৎ করা যায় না। একজন সংখ্যার জাদুতে ‘জয়ী’ হলেও তার ‘নৈতিক পরাজয়’-এর ছবিটাও একইসঙ্গে প্রকট হয়ে থাকে। জয়ের পরেও মুখ লুকাতে হয় এমন পরিস্থিতি কোনও দলের কাছেই কাম্য নয়।
২০১৩ সালে ভারতের পাঁচ রাজ্যে অনুষ্ঠিত বিধানসভার ভোটেই ভারতে প্রথম না-ভোট ব্যবহৃত হয়। সেবারই ১৫ লক্ষাধিক ভোটার না-ভোট পছন্দ করে নীতি  নৈতিকতার প্রতি দেশবাসীর আস্থাটি টের পাইয়ে দিয়েছেন। পরবর্তী অন্যসব ভোটেও এই অবস্থা অক্ষুন্ন রয়েছে। ভারতের সদ্যসমাপ্ত গুজরাত বিধানসভার ভোটে পাঁচ লক্ষাধিক নর-নারী না-ভোটের চিহ্নে ভোট দিয়েছেন। প্রথমবার না-ভোটের মোট ভোটারের ১.৫ শতাংশেরও কম ভোট পড়েছিল, আর এবার তা হয়েছে ১.৮ শতাংশ! স্পষ্ট হচ্ছে না-ভোটের প্রতি ভারতের সমীহ। বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের। না-ভোট ক্রমশ রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি কড়া বার্তাই দিচ্ছে সাবধান হও! প্রার্থী নির্বাচনের ব্যাপারে এখনই  সাবধান হওয়ার সময় এসেছে বংলাদেশে। নয়তো ভীষণ পস্তাতে হবে। অবশ্য, ভয় দেখিয়ে শোধরানো সম্ভব নয়। নীতি  নৈতিকতা উপলব্ধির বিষয়। না-ভোটের আধিক্য যখন রাজনৈতিক দলগুলোকে এবং প্রার্থীদের মধ্যে  উপলব্ধি জাগাতে সমর্থ হবে তখনই না-ভোটের সার্থকতা। ভবিষ্যতে জয়-পরাজয়ের খেলাতেও না-ভোটের প্রদত্ত ভোটকে কোনওভাবে গণ্য করা যায় কি না ভেবে দেখতে হবে। না-ভোটের রক্তচক্ষুকে হেলাফেলা করা হয়তো সম্ভব হবে না। রাজনীতিতে নীতি ফেরাতে, নির্বাচন প্রক্রিয়াকে অবাধ করে তুলতে না-ভোট  হতে পারে এক বলিষ্ঠ অনুশীলন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন