বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি.... ২১



অনেক অবিশ্বাস সন্দেহ মানুষের চিত্তলোককে আচ্ছন্ন করার চেষ্টা করে, অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের দ্বন্দ্বে হৃদয় হয় ছিন্নভিন তবু সে যখন অবিচলিত থাকে সংকল্প ও সাধনায় অনেক অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে পর একদিন আসে জীবনের পরম লগ্নজয়ের গৌরব।
মানুষ ছুটছে স্বর্ণ-মরীচিকার পিছু পিছু। জীবিকার অন্বেষণের চেয়ে জীবনের অন্বেষণ অনেক মহত্তর। সুখ ও সম্পদ জীবন ধারণের সামান্য উপকরণ। অতি সংকীর্ণ তার পরিধি ক্ষণভঙ্গুর তার দান। সত্যমানুষ শ্রীগুরু মানুষকে দেন শাশ্বত সত্যের সন্ধান, মৃত্যুতোরণ উত্তরণের উত্তরাধিকার সকল ক্ষয়ক্ষতির ঊর্ধ্বে এক দুর্লভ অমর জীবন।
দেহ একদিন মিশে যাবে ধুলোয়। একে কেন্দ্র করে স্বপ্ন-নীড় রচনা করা বৃথা। এই দেহে আমিতে আমার অস্তিত্ব, সেই অব্যক্ত আমি-কে করতে হবে ব্যক্ত, অনুভব সেই সাধনায় নিয়ন্ত্রিত হোক দেহের গতি ও প্রকৃতি। অকপট, অক্লান্ত যার সাধনা সেই হতে পারে দিব্যজীবনের অধিকারী। প্রকৃতির সকল ঐশ্বর্য প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রয়েছে; কিন্তু আত্মবিস্মৃত তাই এত দুঃখ, এত নৈরাশ্য। মোহগ্রস্থতা এবং অবিদ্যা আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে অন্ধকারের কঠিন অবরোধ, তাই রুদ্ধগতি শক্তির মুক্তধারা।
আমি-র মধ্যে যে মহাশক্তি ঘুমিয়ে আছে, তাকে জাগিয়ে তোলাই হোক সাধনা। অসামান্য হয়ে উঠুক জীবন। এরজন্য প্রয়োজন অশেষ দুঃখ বরণ, অসীম ত্যাগ ও তপস্যা আর অনন্ত ধৈর্যধারণ। অতীতের পানে ফিরে তাকালে দেখা যাবে কী দুঃখের তপস্যার ভিতর দিয়ে পাওয়া যায় সত্যের আলো নন্দনের আনন্দ সংবাদ। আমিত্বের আবরণগুলোকে শুধু ভুলে যাওয়ার চেষ্টায় রত থাকা, শুধু নিজকে বিলিয়ে দিতে হবে সত্যের শুভ সাধনায়। সেবায় ধন্য হবে দেশ, পুণ্য হবে জীবন।
রৌদ্রতাপে পুড়ে, বর্ষধারায় ভিজে, কঠোর পরিশ্রম করে চাষী তার ক্ষেতে ফসল ফলায়। আর আমি দেহের মাটিতে সোনার ফসল ফলাবে কোন দুঃখ বরণ না করে, সে কি হয়? মহৎ কিছু পেতে হলে মহৎ মূল্য দিতেই হবে, সইতে হবে অনেক দুঃখের তাপ, ফেলতে হবে চোখের জল, কত প্রতীক্ষার প্রহর কেটে যাবে, এরপর আসবে উজ্জ্বল ফসলের কাল। যেমন দীর্ঘ রাত্রির পর আকাশে ফোটে আলোর কুঁড়ি, আলোর ফুল, তেমনি দুশ্চর তপস্যার ভিতর দিয়েই আমিকে পেতে হবে দুর্লভের সন্ধান, আবাদ করতে হবে সোনার ফসল। যে যত দুঃখ সইতে পারে, সে-ই ততো আনন্দ পাবার অধিকারী। একটি অকিঞ্চন দীপ হতে হয় কি দীপান্বিতা? অনেক সলিতার বুক পুড়ে জাগে আলোর উৎসব, অগণন দুঃখের অনলশিখাই তো জীবনে জাগায় উৎসব রজনী, মুছে নেয় অন্ধকার। এতো দুঃখ, এতো কান্না, যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে কেন পেতে হয় পরম জীবনকে? এ না হলে পাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ ও গৌরব থাকে না; এ ছাড়া সুলভ যা আছে সহজে তাকে হারাই। তাকে ধরে রাখি না। যাতে অনাদরের ধুলোয় হারিয়ে না ফেলি, সেজন্য মূল্য জানিয়ে শ্রীগুরু তাঁর দুর্লভ ধন শিষ্যের হাতে তুলে দেন।
শ্রীগুরুর এক নিয়মের বা উপদেশের অধীন হয়ে না চললে জীবন গঠন হয় না। যেদিন ভাল লাগল, সেদিন তাঁকে ডাকবো আর যেদিন ভালো লাগল না, সেদিন মুখ ফিরিয়ে থাকবো, অলস সুখে ঝরে পড়বে মুহূর্তের অফোটা কুঁড়ি, বৃথা জল্পনায় কাটবে দিন এ সমীচীন নয় মোটেই।
আধ্যাত্মিক সাধনায় ভক্তি স্বীকৃত সহায়ক। ভক্তের মাঝে কোন অনুতাপ নেই। ভক্ত সর্বদা আনন্দোচ্ছ্বল। তারা আনন্দে দিশাহারাও হন না, আবার ব্যথা-বেদনায় আতুরও হন না। অবিচ্ছিন্ন আনন্দানুভূতি ছাড়া তাদের ভিতরে দ্বিতীয় আর কোন অনুভূতিই থাকে না, তাই তারা সুখে-দুঃখে অবিচল থাকে। ভক্তের হারাবার কিছু নেই। যেহেতু তারা সত্যমানুষ শ্রীগুরুকে একান্ত আপনার বলে ধারণ করেই মানেন, তাই তাদের লাভ-ক্ষতির কোন ব্যাপারই নেই। কেবল ভক্তই বলতে পারেন, সত্যমানুষ শ্রীগুরু সবার কাছে সমান। তিনি সুখই দেন আর দুঃখই দেন, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না, কারণ দুঃখ-সুখ সবই তো সেই একই শ্রীগুরুর অভিব্যক্তি। অন্যরা জীবন চলার পথে যখন বিভিন্ন বিপরীতধর্মী পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, তখনই সুখ-দুঃখ-নিন্দা-অপমান ইত্যাদি বিরুদ্ধধর্মী অনুভূতির দ্বারা পরামৃষ্ট হন। ভক্ত কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়ে অন্যের বিরুদ্ধে কোন বিদ্বেষ বা ঈর্ষার মনোভাব পোষণ করেন না। হিংসা-অসুয়ার মনোভাব তিনি পোষণ করেন না। 
শ্রীগুরুর সান্নিধ্য পাওয়া যায় না যতক্ষণ আমিত্বের আবরণ থাকে। ভুলের রাজ্য ভুল। যখন দেহ বলে দাও দাও - মানে অভাব আছে। অভাব যেখানে সেখানে ভ্রান্তি, অজ্ঞান। যেখানে মোহ আর অজ্ঞান সেখানে ভুল ত থাকবেই। এর মধ্যে নিজেকে চেনা ও পাওয়ার দিকে যখন সাধনা করা, বা কৃপা পেয়ে যখন সাধনা হয় সাধনামাত্রেই কৃপা স্তর পার হতে হতে দেখতে পাওয়া যায়, উপলব্ধি করা যায় শ্রীগুরু ও আমি-কে সমগ্র রূপে। আমি আছি, তবেই না পৃথিবী, যত রূপ সে ত আমি-ই। যেখানে আমি-ই সেখানে এক অনন্তভাব, অনন্ত প্রকাশ। আমিও অনন্ত। 
দেশের সীমা ছাড়িয়ে আজ পৃথিবীর ঘটনাবাবলীর দিকে এক নজরে তাকালে প্রত্যেক দেশেই যে-লক্ষণটি সহজে চোখে পড়ে তা হলো যৌবনের পুনরুজ্জীবন। উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে, যে-দিকেই তাকাই না কেন, সত্যব্রতী যুব আন্দোলন বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করেছে। আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলো : একদিকে কোন কোন শক্তিসমূহ তাকে পরিচালিত করছে এবং অপরদিকে কী তার চূড়ান্ত লক্ষ্য এই সমস্ত বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা । যুবক ও যুবতীদের যে-কোনও সংগঠনই যুব সংগঠন নামে আখ্যাত হওয়ার যোগ্য নয়। একটা সমাজসেবী সঙ্ঘ অথবা একটা দুর্ভিক্ষত্রাণ সমিতি অনিবার্যরূপে যুবসংগঠন নয়। যুব-সংগঠনের বৈশিষ্ট্য হলো বর্তমান ব্যবস্থা সম্পর্কে অসন্তোষের সত্যানুভূতি এবং উন্নততর ব্যবস্থার জন্য আকাঙ্খার সঙ্গে সেই ব্যবস্থার রূপ কল্পনায় ডুবে থাকা। দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে আন্দোলন সংস্কারধর্মী নয়, বিপ্লবী। কোনও আন্দোলন শুরু হবার আগে অবশ্যই বর্তমান ব্যবস্থা-সম্পর্কে এক অস্থির, এক অসহিষ্ণু অনুভূতি জন্ম নেবে। আদিমকাল হতে মানুষ এক মহত্তর পৃথিবীর স্বপ্নে অনুপ্রাণিত হয়েছে এবং সেই অনুপ্রেরণার বশে সমাজ-পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছে। আধুনিক যুগের সত্যব্রতী যুব-আন্দোলন-সমূহও অনুরূপ স্বপ্ন এবং প্রচেষ্টার লক্ষণাক্রান্ত। পৃথিবীর যেখানেই কোনও আন্দোলন হোক না কেন সর্বত্রই একই আবেগ, একই স্বপ্ন এবং একই লক্ষ্য দেখতে পাওয়া যাবে। যেখানেই আগের প্রজন্মের নেতারা ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানেই সত্যব্রতী যুবকরা আত্মসচেতন হয়ে উঠেছেন এবং সমাজ পুনর্গঠনের এবং সমাজকে উৎকৃষ্টতর এবং মহত্তর অস্তিত্বের পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
এখন আমরা নিজের ঘরের আরও কাছে আছি। শুধু বিশ্বের সত্যব্রতী তরুণরাই জেগে ওঠেনি, এই দেশেও জাগরণ এসেছে। এ জাগরণ এসেছে অন্তর থেকে এবং এ জাগরণ শুধু বাইরের বুদ্বুদ নয়। বাংলার তরুণরা আর সব দায়িত্ব বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে, করজোড়ে বসে থেকে অথবা তাড়িত মূক প্রজাতির মতো অনুসরণ করে সন্তুষ্ট নয় আজ। তারা বুঝতে পেরেছেন যে, তাদেরই এক নতুন সৃষ্টি করতে হবে এক পরমসত্য, মহান এবং শক্তিশালী বাংলাদেশ। তারা দায়িত্ব গ্রহণ করছেন, পরিণামের জন্য তারা নিজেদের প্রস্তুত করছেন এবং যে-মহান কার্যভার তাদের জন্য অপেক্ষা করছে তার জন্য এখন তারা নিজেদের প্রশিক্ষিত করতে ব্যস্ত রয়েছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন