বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি…. ১৭


দেশের জন্য অনেক কাজই করার আছে। দেশের সেবা করতে হলে কোথা থেকে কাজ আরম্ভ করতে হবে? দেশের কাজ করতে হলে প্রথমে মানুষ ও সত্যমানুষ তৈরির কারখানা গড়তে হবে।
মানুষ তৈরির যে আশু প্রয়োজন তা ভেবে দেখতে হবে। ভাল সংস্কার সম্পন্ন শিশু না জন্মালে শুধু শিক্ষা দিয়ে তাদের বিশেষ কি করতে পারা যাবে? বীজ থেকেই গাছ হয়, বীজ ভাল হলেই গাছ ভাল হবে। দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ। দীর্ঘ সময় লাগবেই। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ জাতীয় লক্ষ্য ছাড়া জীবন চলার পথে জাতির বা সমাজের জন্য কতটুকু করতে পারেন। বহু গলদ জমে আছে। তা সাফ করতে সময় নেবে। কোনও স্বল্পকালীন পরিকল্পনায় জাতির সত্যকার কল্যাণ হবে না।
বিষয় ভেদে শ্রবণ বা শোনা দু’ প্রকার, অর্থাৎ যে ক্ষেত্রে শ্রোতা নিজের অনুভবযোগ্য বিষয় অন্যের মুখ হতে শোনে সে ক্ষেত্রে শোনা এক । কিন্তু যে ক্ষেত্রে শ্রোতা যা কিছু শোনে তার কোন অংশই বুঝতে পারে না অথচ শ্রদ্ধার সাথে শোনে, সে ক্ষেত্রে শোনা দু’প্রকার। সাধারণ লোক কোন বিষয় বুঝতে না পারলে তা দীর্ঘকাল ধৈর্যের সাথে শুনতে চান না এবং পারেনও না। যখন কোন বিষয় রুচিকর হয় বা চিত্তাকর্ষক হয় তা হলে বিষয়ের গুণে শ্রোতার চিত্ত রঞ্জিত হয় বলেই সে ধৈর্য ধরে শুনতে পারে এবং সে অনুসারে কাজ করে থাকে। এটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু যারা আধাত্মিক সাধনার জগতে ঢুকে পড়েছেন তারা শোনাকে সাধনার অঙ্গ হিসেবে ধারণ করে থাকেন। এ স্তরে শোনাটা নিরপেক্ষ, বিষয়টা চিত্তাকর্ষক না হলেও অথবা অন্য কোন প্রকারে মনোরঞ্জনের না হলেও বিষয়ের অন্তর্নিহিত গুণে অথবা বাক্যের স্বভাবসিদ্ধ প্রভাবে শ্রোতা শুনতে প্রবৃত্ত হয়।
যে বিষয় অথবা যে ভাষা শ্রোতার বোধের অগোচর, তা শুনে কোন প্রকার ফল লাভ হতে পারে না। এটাই সত্য। কিন্তু অধ্যাত্ম ক্ষেত্রে শ্রোতার শোনা সাধনা, তার বুদ্ধি অথবা বিচার শক্তির সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে না। সিদ্ধবচন বুঝতে হবে। সব শব্দের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে চেতনাশক্তি নিহিত রয়েছে। সেই শব্দগুলো কেবলমাত্র লৌকিক শব্দ নয়, যদিও সাধারণ শ্রোতার নিকট ওইগুলো সাধারণ শব্দরূপে প্রতীত হয়। সকল শব্দের অন্তঃস্থিত শক্তির প্রভাবে মানুষের জীবন প্রভাবিত এমন কি পরিবর্তিত হয়ে থাকে। কিন্তু ওই গুপ্ত শক্তিকে কার্যকরী রূপে পেতে হলে পূর্ণ শ্রদ্ধার সাথে ওই সব বাক্য শুনতে হয়। বিশুদ্ধ শ্রদ্ধার সাথে শোনার ফলে ওই সব শব্দ জেগে ওঠে অর্থাৎ চেতনাময় শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই চেতনাময় শক্তির প্রভাবে দেহ, প্রাণ ও চিন্তার যাবতীয় শৃঙ্খল ক্রমশঃ ছিন্ন হয়ে যায় এবং একরৈখিক হয়।
এ জন্য বুদ্ধিদ্বারা বুঝতে না পারলেও বিভিন্ন অঙ্গনে শ্রীগুরুর বাণী শ্রদ্ধার সাথে শুনতে হয়। ওই শোনাও বৃথা যায় না। অনেক সময় ওই প্রকার সরল ও সাদরে শোনার ফলে অন্তঃকরণের আবরণ খুলে যায় এবং জ্ঞান ও অজ্ঞান উভয়ের অতীত নিজস্বরূপে স্থিতি লাভ করতে সমর্থ হয়। অনুভবে না আসলেও শুধু শোনার ফলে অনুভবের পথ খুলে যায়। পানি প’ড়ে প’ড়ে যেমন পাথরে ছিদ্র হয় ঠিক তেমনি।
পড়া, কথা এবং গান এই তিনটা স্থূলতঃ পৃথক্ পৃথক্ হলেও বিষয় গুণে অভিন্ন। সর্বত্রই শ্রীগুরু-প্রসঙ্গই একমাত্র অবলম্বন। ফলে কোন পার্থক্য নেই। যার যে দিকে রুচি সে সেই দিক্কার শোনায় আকৃষ্ট হয়। সেই দিক দিয়েই তার পথ খুলে যায়। অধিকার ভেদে সবই ঠিক। এ জন্য দোষ-দৃষ্টি বর্জন করে শোনা বিধেয়। বিভিন্ন অঙ্গনে শ্রীগুরুর উপদেশ শোনার সময় দোষ-গুণের বিচারের ভাব অন্তরের মধ্যে থাকা উচিত নয়। নিজ প্রচেষ্টায় উন্মুখ হয়ে সরলভাবে তা গ্রহণ করতে হয়। নিজে সমালোচক হয়ে উপদেশ শোনা নিষিদ্ধ। নিমগ্নভাবে শুনলে মননের অবসর আপনা থেকেই এসে উপস্থিত হয়। শোনা শ্রদ্ধার সাথে না হলে শোনার বিষয়ে সংশয় থেকে যায় বলেই তা অবলম্বন করে মননের কাজ ঠিকভাবে করা যায় না। মননের মুখ্য উদ্দেশ্য সংশয় নিরসন। কিন্তু প্রথমে শ্রদ্ধার সাথে শোনা না হলে দীর্ঘ সময় মননের যা যথার্থ ফল তা প্রাপ্ত হওয়া যায় না। মননের পরে দৃঢ় নিশ্চয়তার আবির্ভাব হলে তা উর্দ্ধমুখী কর্মরূপে প্রকাশ পেয়ে থাকে। যথাবিধি অনুষ্ঠানে শুনতে পারলে অনুভবশূন্য শোনা হতেও পূর্ণ অনুভবের উদয় সম্ভব। সংশয়-নিবৃত্তির পর কর্মরূপে প্রকাশ হওয়ার সময় প্রত্যক্ষ অনুভূতি অবশ্যম্ভাবীরুপে জেগে ওঠে।
মানুষ সর্বত্র খণ্ডভাব নিয়ে ব্যবহৃত-ভূমিতে কাজ করছে। তার দৃষ্টি ভেদ-দৃষ্টি। সমস্ত সত্তার মধ্যে যে এক অখন্ড অভিন্ন সত্তা বিদ্যমান রয়েছে এ উপলব্ধির বা প্রাপ্তির সৌন্দর্য অবলোকন করার দৃষ্টি তার নেই। তাই যে যখন যা দেখে সে তখন শুধুমাত্র তাই দেখে। দেশ ভেদে, কাল ভেদে, বস্তু এবং স্তর ভেদে সব দেখা পৃথক্ পৃথক্ সব অঙ্গনেই। এমন দেখা সে দেখে না যাতে তার এই নানা দেখার বৈচিত্রতা সাম্যে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তা’ই এ দেখা হতে সে স্থিতিলাভ করতে পারে না। কারণ সর্বত্র ভেদ রয়েছে, কোনভাবে পূর্ণ তৃপ্তি না পাওয়ার এক ভাব হতে অন্য ভাবে সঞ্চরণ অনবরত ঘটে যাচ্ছে। যা’র যে ভাব সেই ভাবই যে পূর্ণভাব এবং সেই ভাবই যে ভাবাতীত এটা অনুভবে আসে না। গুরুভাব, মাতৃভাব, পিতৃভাব, বন্ধুভাব, পতিভাব সবই খন্ড ভাব। শ্রীগুরু-অখন্ড ভাবের সাথে যোগ না থাকলে মা শুধু মা-ই, বাবা শুধু বাবাই। মা-তেও বাবাভাব নেই এবং বাবাতে মা-ভাব নেই। তাই অতৃপ্তির অবসান হয় না। কিন্তু প্রতি ভাবই সেই অখন্ড শ্রীগুরু-মহাভাবের প্রকার ভেদ মাত্র, এটার সৌন্দর্য দেখতে পেলে অনন্ত বৈচিত্র্যের মধ্যেও সব সময় এককেই জানতে পারা যায়। তখন মাতা, পিতা, বন্ধু, স্বামী সকলের মধ্যে সেই এক-ই যে অনন্তরূপে বিদ্যমান রয়েছে তা বুঝতে পারা যায়। সুতরাং খন্ড ভাবকেও পূর্ণরূপে পেতে হলে অর্থাৎ কোন ভাবকেও পূর্ণভাবে অখণ্ডরূপে পেতে হলে চেতনা লব্ধ অভেদ দৃষ্টি আবশ্যক। কিঞ্চিৎ মাত্র ভেদ দৃষ্টি থাকা পর্যন্তও পরম স্থিতি পরম চেতনা লাভ করা যায় না এবং বিরোধেরও সমন্বয় হয় না। প্রকৃত লক্ষ্য একটাই, সেখানে ভেদ ও অভেদের পরস্পর বিরোধ নেই। দেশের সার্বিক অঙ্গনে শ্রীগুরু যে পথে পরিচালিত করছেন সেটাই সর্বকালের, সর্বমানবের পথ। এতে কোনও সন্দেহ নেই। এই পথই মানব প্রজাতি অনুসরণ করে আসছে এবং শেষ পর্যন্ত করে যেতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন