বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি.... ২২



জগতে বস্তুর সঙ্গে ভয় মিশ্রিত থাকে। যার প্রচুর টাকা আছে, যার ভাল ব্যবসা আছে, তার ব্যবসায়ের ক্ষতির সম্ভাবনা আছে; সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে। সব বস্তুতেই ভয় মিশ্রিত হয়ে রয়েছে।
এই জগতে এমন কোন বস্তু নেই যাতে ভয় নেই। কেবল একটা জিনিস আছে যাতে ভয় নেই বৈরাগ্য ভয় নেই। বৈরাগ্যটা কী? বি-রন্জ ধাতুর উত্তর ঘঞ্ প্রত্যয় করে ‘বিরাগ’ শব্দ উৎপন্ন। ‘বিরাগ’ মানে কোন বস্তুর রঙেতে নিজেকে রাঙাতে দেব না। জগতে যা কিছু বস্তু রয়েছে, মানুষ জেনেশুনে বা না জেনে সেই বস্তুটার রঙেতে আকৃষ্ট হয়। যেমন মানুষের চোখ সবুজ রঙ, চকোলেট রঙ এগুলোতে চোখ ভাল থাকে, ঠান্ডা থাকে। সব জিনিসেই রঙের প্রভাব আছে। যখন মানুষ নিজেকে এমন মজবুত করে নেয় যে অন্য বস্তুর রঙের দ্বারা সে আর প্রভাবিত হচ্ছে না, তখন সেই অবস্থাটাকে বলা হয় বৈরাগ্য। বৈরাগ্য মানে সব কিছু ছেড়েছুড়ে পালিয়ে যাওয়া নয়। বৈরাগ্য মানে পলায়নী মনোবৃত্তি নয়, বৈরাগ্য মানে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত না হওয়া। পাঁকাল মাছ পাঁকে থাকে, তবুও গায়ে পাঁক লাগে না। এই ধরনের জিনিসকে বলা হয় বৈরাগ্য। বৈরাগ্য জিনিসটাতে মানুষ প্রতিষ্ঠিত হয় কখন? যখন বুঝতে শেখে যে, যে বস্তুর রঙ আমার ওপর এযাবৎ পড়েছে বা পড়তে পারে, চিন্তা জগতের ওপর তার যে প্রভাবই পড়ুক না কেন, সে জিনিসগুলো কোনটাই স্থায়ী নয়। আজ আছে, কাল চলে যাবে। সুতরাং নিজের ওপর যদি তা রঙ লাগিয়ে দিই, সে যখন চলে যাবে তখন বড্ড কষ্ট হবে। সুতরাং আমাতে কোন বস্তুর রঙ না লাগানোই উচিত।
চরম সত্য, শ্রীগুরু-বন্ধু, তাকে নিয়েই থাকতে হবে। কারণ, চিন্তা কোন না কোন বিষয় নিয়েই থাকবে। বিষয়রাহিত্য হয় না। বিষয় বর্জন করে চিন্তা জগৎ থাকতে পারে না। সৎকর্ম যে করে না, অসৎ কর্ম সে করে এই হচ্ছে নিয়ম। সুতরাং বিষয়ের রঙ যাতে লাগছে না, অবিষয়কে নিয়ে তাকে থাকতে হবে। এই অবিষয় হচ্ছে শ্রীগুরু, যিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন। তিনিই হলেন সৎ। এই সৎ-এর যে বাহ্যিক প্রকাশ তাকেই বলা হয় সত্য। সত্যকে সে আশ্রয় করছে, শ্রীগুরুর কাছে যে আশ্রয় নিয়েছে তার ভয় নেই। 
আনন্দজগৎ যিনি জেনেছেন, তিনি আর কিছু থেকেই ভয় পান না। ভয় পাবার কোন হেতুই নেই কারণ সমস্ত সাহসিকতা, তেজস্বিতা তৈরী হবেই। যার সাহসিকতা ও তেজস্বিতা আছে, তার মধ্যে ভয় থাকবে কী করে? একেবারে নির্ভয় জিনিস হ’ল সত্য। যখন সত্যের সঙ্গে অসত্যের সংগ্রাম শুরু হয়, তখন সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী।
জীবন নিত্য অভাব ও অভিযোগ ও প্রয়োজনে পরিপূর্ণ, সুতরাং তার কামনা থাকেই, কেবল দেহে প্রাণে নয়, চিন্তায় এবং আধ্যাত্মিক সত্তাতেও। যখন মানুষ জানে যে জগৎ চলছে কোন উর্দ্ধচেতন শক্তির নিয়ন্ত্রণে, তখন সে ওই উচ্চশক্তির কাছে তার অভাব পূরণের জন্য প্রার্থনা জানায়, যাতে তার জীবনের বন্ধুর পথে ও কঠিন সংগ্রামে সাহায্য ও আশ্রয় লাভ করতে পারে। ধর্মীয় রীতিতে শ্রীগুরুর কাছে যতই কেন স্থূলভাবে প্রার্থনা করা হোক, যতই কেন স্তব-স্তুতির দ্বারা ও নৈবেদ্যাদি উৎসর্গ প্রভৃতি দেয়ার দ্বারা শ্রীগুরুর তুষ্টি সাধনের চেষ্টা করা হোক, যার মধ্যে আধ্যাত্মিক স্পৃহা প্রায় কিছুই থাকে না, তথাপি এ কথা সর্ববাদীসম্মত সত্য যে প্রার্থনার প্রয়োজন আছে আমাদের সত্তার পক্ষে।
প্রার্থনার যে কোন সুফল আছে এতে প্রায়ই সন্দেহ প্রকাশ করা হয়, বলা হয় যে তা অনাবশ্যক এবং নিষ্ফল। এ কথা সত্য যে বিশ্বনিয়ম তার আপন লক্ষ্যের পথে চলছে, কারো ব্যক্তিগত উপরোধে টলছে না, আর এ কথাও সত্য যে তিনি তাঁর সর্বজ্ঞ শক্তিতে দেখতে পান যে কখন কি করা দরকার, তিনি মানুষের চিন্তা ও ব্যক্তিগত কামনার দ্বারা জগৎ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোনরূপে প্রভাবিত হতে পারেন না। তথাপি সেটা যান্ত্রিক নিয়ম নয়, সেটা জীবন্ত শক্তির ক্রিয়া এবং সেখানে মানুষের আস্পৃহা ও শ্রদ্ধা স্থান নিতান্ত অনর্থক নয়। প্রার্থনা মানুষের সেই স্পৃহা ও শ্রদ্ধাকেই একটা আকার দেয়। যদিও তা অনেক সময় নিতান্ত স্থূল হয়ে দাঁড়ায়, তথাপি তার মধ্যে একটা তাৎপর্য থাকে এবং কিছু প্রকৃত শক্তিও থাকে। অর্থাৎ তা মানুষের ইচ্ছা ও স্পৃহা ও শ্রদ্ধাকে শ্রীগুরুর চেতন ইচ্ছার সংস্পর্শে এনে একটা সচেতন ও জীবন্ত সম্বন্ধ স্থাপন করে।
যদিও সেই সম্বন্ধ অহংবুদ্ধি প্রণোদিত হওয়াতে নিতান্ত নিম্নস্তরের হয়, কিন্তু তারপরে আমরা তার উচ্চতর আধ্যাত্মিক সত্যে গিয়ে পৌঁছাতে পারি। তখন আর কি চাইছি তা নিয়ে কথা নয়, মানুষের জীবনের সঙ্গে শ্রীগুরুর চেতন সংস্পর্শ ও লেনদেন নিয়ে কথা। আধ্যাত্মিকের দিক থেকে এই চেতন সংস্পর্শের শক্তিমূল্য অনেক বেশি। জীবনে আমরা একান্ত আত্মনির্ভর হয়ে যে সংগ্রাম করি, প্রার্থনা তার মধ্যে একটা পূর্ণতর আধ্যাত্মিক অনুভূতি এনে আমাদের শক্তিসমৃদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত সেই প্রার্থনা তার চেয়ে বৃহত্তম সংযোগে গিয়ে বিলীন হয়, অর্থাৎ তার ভিতরকার স্পৃহা ও শ্রদ্ধাবিশ্বাসই আনন্দের স্তরে ভক্তি হয়ে ওঠে। তখন আরো উচ্চ স্তরে গিয়ে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে উপনীত হয়, কোন দাবিদাওয়া ঘুচে গিয়ে তখন তা সহজ ও বিশুদ্ধ শ্রীগুরুর প্রেমে পরিণতি লাভ করে।
মানুষ শ্রীগুরুর কাছে চায় সাহায্য, চায় আশ্রয় এবং নির্দেশ, চায় সাফল্য অথবা চায় জ্ঞান, চায় শিক্ষণ, চায় আলো, কারণ তিনি জ্ঞানসূর্য, অথবা সে চায় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি, ব্যক্তিগত ব্যথাবেদনা, অথবা জগৎযন্ত্রণা থেকে মুক্তি, অথবা তার মুক্তি। তার সকল কামনা ও দুঃখের কথা জানায় শ্রীগুরুর কাছে, আর জগন্মাতাও তাই চান, যাতে তিনি তাঁর হৃদয়ের স্নেহ সেখানে ঢেলে দিতে পারেন। শ্রীগুরুর ওই স্নেহ আপনা হতে আছে বলেই জীবন চলার পথের যাত্রীরা তাঁর দিকে ফেরে, কারণ সেখানেই আমাদের আপন গৃহ, জগতের পথে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে সেই শ্রীগুরুর হৃদয়ে গিয়েই আমরা বিশ্রাম পেতে পারি। স্পৃহার কি দরকার? কিছু চাইবে কেন? শ্রীগুরুর যা করতে চান তাই তিনি করবেন এবং তাই তিনি করছেন। অবশ্য এ কথা বলাই বাহুল্য, তথাপি এই যে প্রার্থনা এতে তার অভিব্যক্তির মধ্যে একটা স্পন্দন জাগে।
নতুবা শ্রীগুরু তাঁর জগৎটাকে তিনি এমনভাবে গড়তেন না, এই জগতের আস্পৃহার মধ্যে তিনি তার পূর্বাবস্থাতে ফিরে যাবার জন্য এমন এক তীব্র স্পন্দন দিয়ে রেখেছেন যার মধ্যে বিশেষ রকমের শক্তি ও আনন্দ রয়েছে। আর ঠিক সেই কারণেই, সেই জন্যই বিবর্তনের ক্রিয়া চলছে। কিন্তু যদি চিরন্তন সম্পূর্ণ ও চিরন্তন নিখুঁত হ’ত তাহলে এখানে সেই বিবর্তনের অগ্রগতির আনন্দ থাকত না।
আমিত্বের আবরণকে দূর করার জন্য বই-পুস্তকের ধারায় কোনো কৃত্রিম উপায়ের আশ্রয় নিতে বলা হয়নি। প্রকৃতির স্বাভাবিক ধারায় চেতনার আকুঞ্চন-প্রসারণ, গুটিয়ে আনা ও ছড়িয়ে পড়ার দিকে দৃষ্টি রেখেই এই আবরণ মুক্ত করার প্রয়াস। চেতনা যখন ছড়ানো থাকে আমাদের জাগ্রত অবস্থায়, তখন তাকে তার আপন স্বরূপে পাওয়া যায়না, কারণ সে বাইরের জগতের নানা বস্তুর সঙ্গে জড়ানো থাকে তখন। কিন্তু বাইরের জগৎ থেকে যখন সে নিজেকে গুটিয়ে আনে তখন কিছুদূর পর্যন্ত বাইরের জগৎও ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করে। এরই নাম স্বপ্নাবস্থা। চেতনাকে তাই এখানেও বিষয়বিহীন নিবারণরূপে পাওয়া যায় না। তারও পরে গভীর নিদ্রাতে স্বপ্নের নানা দৃশ্যও যখন মিলিয়ে যায়, তখন চেতনা বিষয়নির্মুক্ত হয়। এখানেই তাকে সরাসরি সাক্ষাৎভাবে ধরতে পারার সুযোগ। কোনো সময়ই শ্রীগুরুকে একলা পাই না। তিনি বাইরের দরবারে পাত্র-মিত্র নিয়ে সমাসীন। একবার অন্দরমহলে তাঁকে নিরিবিলি একলা পাওয়া গেল। কিন্তু পেয়েও তাঁকে পাওয়া গেল না, সামনে এক ঘন কৃষ্ণ আবরণ, অজ্ঞানের বা মোহের কালো পর্দা। বুঝতে পারা যায় এই কালোর আড়াল ঘুচে গেলেই সেই আলোর পারাবারে উপনীত হতে পারা যাবে ।
শ্রীগুরু আনন্দের পরাকাষ্ঠা, তার কারণ স্বরূপ-চেতনার সান্নিধ্য। অজ্ঞানে বা মোহের আবরণের মধ্য দিয়েও তার যে একটু ছোঁওয়া লাগে, তাই আমাদের জুড়িয়ে দিয়ে যায় স্বরূপানন্দের বিমল পরশে। করতে হবে এরই অন্বেষণ, তবেই মিলবে চেতনার মূল স্বরূপের সন্ধান। চেতনার এই আরোহ-অবরোহ, দেহের স্তরে নেমে আসা আবার দেহ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে উঠে যাওয়া, এই প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক ঘটনাটির উপর সতর্ক দৃষ্টি দাও, সজাগ হয়ে দেখো। 
মৃত্যু একটি অবধারিত, সুনিশ্চিত পরিণাম জীবনের। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে মৃত্যুপথযাত্রী মুমূর্ষু ব্যক্তির চেতনার আলো কেমন ক্রমে ক্রমে গুটিয়ে আসে। দেখা যায় হঠাৎ তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, চোখ খোলা রয়েছে অথচ মানুষ চিনতে পারছেন না আর, ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, কোনো শব্দ আর কানে প্রবেশ করছে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন