বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি.... ২৪


বর্তমানের সমাজ ধর্মের দিক হতে একেবারে না অথবা নকলবাগীশ, নিজের আচারের দিক হতে ভোগবাদী কিন্তু নিজের বিচারের দিক থেকে ঘোর সংস্কারচ্ছন্ন। সমাজে প্রায় ষাট ভাগ মানুষ তাগা-তাবিজ, মাদুলি, ঝাড়ফুঁক, মন্ত্র-পড়া, তেল-পড়া, পানি-পড়া, নুন-পড়া ইত্যাদি নানা সংস্কারে আবদ্ধ। আধুনিক শিক্ষাতে শিক্ষিত হয়ে যারা নানান ভাবে গর্ববোধ করেন, তারাও কিন্তু নানা রকম সংস্কারের শিকড় তাদের মধ্যে গেড়ে রেখেছেন। সুতরাং শিক্ষিত সমাজও সংস্কার হতে মুক্ত নয়। এরা নিজেদের অজান্তে বা খেয়ালের আবেগে, ভয়ের তাড়নায় ও লোভের বশবর্তী হয়ে অনেক সংস্কার স্বীকার করছে এবং তা আচরণেও কার্যকর করবার প্রয়াস করছে। কী বিভ্রান্তি! কী মেকী শিক্ষার গর্ববোধ! ব্যক্তি পর্যায়ে যতদিন না অধ্যাত্ম চেতনার উন্মেষ হচ্ছে, ততদিন সমাজ সংস্কার ও ভ্রান্তি হতে মুক্ত হবে না। তাই যথার্থ নিজেকে নিজে বিচার করা এবং বিবেকী হওয়া।
ধর্ম বলতে যা বুঝায়, তা হলো যা ব্যক্তি নিজে সমস্তকে ধারণ করে বা ধরে রাখে এবং যাকে অবলম্বন করে সমষ্টিগতভাবে বাঁচে। কারণ জীবনের কলা হলো বাঁচার তাগিদ ও পূর্ণতা লাভের প্রবণতা বা প্রচেষ্টা। ধর্মকে আশ্রয় করেই সমষ্টিগতভাবে বাঁচা যায় এবং পূর্ণতা লাভের পথ প্রশস্ত হয়। নতুবা বাঁচার উদ্দেশ্যই বৃথা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তি বাঁচতে চায় এবং তার জন্য প্রয়োজন হয় আহার, আচ্ছাদন ও আশ্রয়। জীবন ধারণ করতে গেলে এগুলোর একান্ত প্রয়োজন এবং সুন্দরভাবে বাঁচতে গেলে আরও তিনটি জিনিসের প্রয়োজন হয়, যথা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষা। কিন্তু এই জীবন ধারণ কিসের জন্য বা এর উদ্দেশ্য কি? নিশ্চয় জীবন ধারণের উদ্দেশ্য আছে এবং এর প্রয়োজনও আছে। কি সেই উদ্দেশ্য এবং কি সেই প্রয়োজন? উদ্দেশ্য হলো পরমসত্য বা আত্মতত্ত্বের উপলব্ধি আর এর জন্যই জীবন ধারণের প্রয়োজন। আত্মোপলব্ধি ও আনন্দলাভই হলো জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। যখন জীবনধারা সমষ্টির অনুকূল হয়ে প্রভাবিত হয় তখনই ধার্মিকতা, কারণ জীবন সহজ সৃজনাত্মক পথেই অগ্রসর হচ্ছে। জীবনধারা যখন সমষ্টির প্রতিকূল হয়ে চালিত হয় তখন তা অধার্মিকতা বা অসহজতা। কারণ তা অধর্ম বা অসহজ ধ্বংসাত্মক পথে অগ্রসর হচ্ছে। সুতরাং সমষ্টির অনুকূল হয়ে বাঁচা এবং বাঁচার লক্ষ্যে বা জীবন-ধারণের উদ্দেশ্যে উপনীত হওয়া। ধর্মের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হল মহান। কিন্তু অধিকাংশ ধর্মজীবীরা বা ধর্মের তথাকথিত শিক্ষকরা ধর্মের নাম নিয়ে কি করছেন! সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা বা ভ্রান্তিকে আশ্রয় করে তারা করছেন ষড়যন্ত্র এবং ধর্মীয় অনুশাসনের নামে ধর্মীয় শোষণ। বিবেক বৃত্তি জাগ্রত হলে তাদের ষড়যন্ত্র ধরে ফেলে, তাই তারা প্রচার করছেন ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।’ কারণ বিশ্বাস কি তারা তা জানেন না এবং যুক্তি বা তর্কে তাদের চালাকি ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে, এজন্য কৌশলে তারা সাধারণ মানুষের চিন্তা জগৎকে পঙ্গু করতে লেগেছেন। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস আনার জন্য আধ্যাত্মিকতার নাম নিয়ে তারা নানা কুসংস্কার ও বিচার বিহীন আচার তৈরী করছেন এবং নানা ভেলকিও ধারণ করছেন। ব্যক্তি যখন বিপদগ্রস্ত হয় এবং অসহায় বোধ করে তখনই সে ওই ব্যক্তিগণের ফাঁদে পা দেন আর শোষণ ও অপকর্মের শিকারে পরিণত হন। আবার অত্যধিক লোভাতুর তথাকথিত শিক্ষিত অসহজরা তাদের খপ্পরে পড়ে নাজেহাল ও নাস্তানাবুদ হন। যতক্ষণ অসহজ অবস্থা থাকে ততক্ষণ ওদের খপ্পরে পড়ে থাকেন, কিন্তু সহজ বা অধ্যাত্মচেতনা সম্পন্নরা ওদের ফাঁদে পড়েন না। আর পড়লেও তা বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না। সহজ হতে হবে, অধ্যাত্মচেতনার বোধে উদ্বুদ্ধ হতে হবে, তবেই সমস্ত ভেল্কি বা অজ্ঞান কুসংস্কার দূর হবে, নতুবা ওগুলো দূর হওয়া বড়ই দুরূহ। অধ্যাত্ম চেতনার বোধ বিহীন সাধারণ মানুষ আজও প্রতারিত হচ্ছে স্বার্থান্বেষীদের ষড়যন্ত্রে। আধাত্মিক অজ্ঞতার শিকারগ্রস্ত সাধারণ মানুষ কামনা সফলতার ভুয়ো আশ্বাসে অবাধে শোষিত ও ভ্রষ্টাচারে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। অধ্যাত্মচেতনার উন্মেষ ব্যতিরেকে এই কুচক্রের ব্যুহ ভেদ করা সম্ভব নয়। 
জীবন কেহ একইভাবে চালাতে পারে না। জীবন স্তরে স্তরে সজ্জিত। সুতরাং কোন স্তরে কোন কর্ম করবে এরূপ অবস্থায় কর্তব্য সকল সময় লক্ষ্য ঠিক রাখা এবং শান্তভাবে জীবন চলার পথে পথ চলা। শ্রীগুরুর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে তাঁর নাম স্মরণে জীবন কাটানো। চঞ্চলতার বশবর্ত্তী হয়ে নিত্যনূতন পদ্ধতির কল্পনা করা নিতান্ত ভ্রমাত্মক। যেরূপ অবস্থাই আসুক না কেন, তাতে জীবনের লক্ষ্য ও চলার পথ ঠিক রাখতেই হবে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিবর্ত্তন করলে কোনও দিনই কেহ লক্ষ্যস্থানে পৌঁছতে পারেন না। দেহসংযম, বাক্সংযম ও চিত্তসংযম, এই তিন সংযমেই আছে ধর্ম। কোনও কারণে দেহ, চিন্তা ও চিত্তে চঞ্চলতা জন্মাতে না দেয়া। সত্য যার জীবনের লক্ষ্য, ভ্রমেও যেন তাকে অন্য পথ ব্যবহার করতে না হয়। সংসারে কর্ত্তব্য গুরুতর। বিপদে-সম্পদে অবিচলিত থেকে ধীর ও স্থিরভাবে কর্ত্তব্যপালন করতে হয়। উত্তেজিত বা অবসন্ন হলে চলে না। অনিত্য উপাদানে যে বাসা ব্যক্তি বেঁধেছে, প্রতিমুহূর্ত্তে তা ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনায় ভরপূর। 
স্বভাবমৃত্যু না হওয়া পর্য্যন্ত সুখ-দুঃখ রোগ-শোক সহ্য করে যাওয়াই ব্যক্তির কর্ত্তব্য। এখানের বোঝা এখানেই ফেলে যেতে হবে। প্রকৃতির বিধান লঙ্ঘন করে কেউ কোন দিন সুখী হন না।
জীবনভোর চিত্তবৃত্তির সঙ্গে লড়াই করতে হবে। কর্মানুসারে সঞ্চিত গুণে আত্মসমর্পণ করলে চলে না। সত্য দ্বারা অসত্যকে, ক্ষমা দ্বারা ক্রোধকে, প্রেম দ্বারা হিংসাকে জয় করতে হবে। সাধকের ধৈর্য্য, তিতিক্ষা, পরমতসহিষ্ণুতা, সমদর্শিতা অঙ্গের ভূষণ। সম্পদ বিপদ উভয় কালেই সুখ বা দুঃখে বিচলিত না হয়ে বীরের ন্যায় কর্মফল অতিক্রম করে লক্ষ্যপথে অগ্রসর হওয়াই সাধনা। 
ফলাফল না দেখে কর্ত্তব্যগুলো যথাযথ করাই আদর্শ। জন্ম-মৃত্যু যা সাধ্যায়ত্ত নয় তার জন্য অধীর হওয়া মায়া জ্ঞান অর্জনের পথে সহায়ক নয়। মর্ম্মান্তিক দুঃখের কারণ হলেও মঙ্গলময় শ্রীগুরুর দান মাথা পেতে গ্রহণ করতে হয়। কর্ম-জগতে থেকে কর্ত্তব্যে অবহেলা অপরাধ। কর্ত্তব্যে যার অবহেলা, তার দ্বারা জগতে কোন কর্ত্তব্য সাধিত হয় না। শ্রীগুরুর কৃপায় জ্ঞান হলে সুখ-দুঃখ, রোগ-শোক, বিপদ-সম্পদ সকল অবস্থাতেই শান্তি পাওয়া যায়। অজ্ঞান অশান্তি উদ্বেগ আনে। শত দুঃখ মাথায় নিয়ে ত্যাগী আনন্দময়। এখানের কর্মগুলোর বোঝা এখানেই নামিয়ে রেখে না যেতে পারলে শান্তি নেই। রোগ-শোক, বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট দেখে ভয় পেলে হবে না। সবই শ্রীগুরুর মঙ্গল হস্তের দান বলে গ্রহণ করতে হয়। ফলাফল শ্রীগুরু নির্ভর করে অকপটে চেষ্টা, যত্ন এবং নিমগ্নতাই কর্ত্তব্য। 
শ্রীগুরু প্রাপ্তির একমাত্র উপায় ব্যাকুলতা। তাঁর জন্য পাগল না হলে বেঁচে মরা না হলে কেহ তাঁকে পরিপূর্ন পান না। প্রেম জগতেই প্রেমময়কে লাভ করতে হয়। ব্যাকুলতাই সে পথের পাথেয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন