বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি…. ৭


একটি লক্ষ্যে তন্ময় থাকাই শ্রেষ্ঠ সাধনা। এতে চিন্তা হয় প্রেমজগতমুখী, সত্যমুখী, উর্দ্ধচেতনমুখী সত্যমানুষরূপে হয় দিব্য প্রকাশ। সত্যমানুষ গুরু সর্বময় এই সীমার জগতে তাঁর রূপের লীলাময় বিচিত্র বিকাশ। স্তরভেদে দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ফলের হয় তারতম্য। সেখান থেকেই নিজের বিচারে পরমচেতনায় পরমসত্যলাভ। সংসারের কাছে আত্মনিবেদন, প্রতিদিনের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তপস্যাতো তাঁরই অর্থাৎ সত্যমানুষ গুরু সেবা, এইটুকু ভাবতে শিখলে এর ভিতর দিয়ে চলা যায় সত্যমানুষের দিকে। ভালোবাসা প্রেমজগতের একটি দেশ, সেখানে আকর্ষণ আছে, আছে ব্যাকুলতা। ভালোবাসাই দেখায় এবং শেখায়। ভক্তির পথে সত্যমানুষের অপার মহিমা এই পথ দিয়ে লাভ করা যায় সত্যমানুষ গুরুকে।
ব্যক্তি নিজে নিতান্ত ক্ষুদ্র মানুষ। নিজেকে বড় ভাবা না, কোনো মহতের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করা না। সত্যমানুষকুলের চরণাশ্রিত এক অধম, অভাজন ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে দেখা। শুধু তাঁদের নয় তাঁদের ভক্তদেরও দয়ার ভিখারী হয়ে থাকা। নিজের যোগ্যতা লাভ করা। আকাক্সক্ষা থাকলে বিশ্বাস ও আত্মসমর্পনের দেশে প্রবেশ করা যায় না। কামনা বাধাপ্রাপ্ত হলেই ক্রোধ হয়। এরপর অবিশ্বাস, সন্দেহ, বুদ্ধিভ্রংশ সমস্তই ঘটে, বিচার বিবেকের আলো ক্ষীণ হয়ে যায় এমনকি নিভেও যেতে পারে। বাসনা একমুখী না হলে স্বভাব গড়া যায় না আর বিশ্বাসেও প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় না। বিশ্বাসে মানুষ এমন এক দেশে প্রবেশ করে যেখানে সবই তুচ্ছ। যতই সত্যমানুষকুলের গুরুর চরণে নিজেকে নিবেদন করা যায়, অনুস্মরণ করে চলা যায়, ততোই জীবন ধন্য হয়। সুখ, শান্তি, সম্পদ, সম্মান সমস্ত কিছুর কৃপা করেন তিনি। এরচেয়ে বড় সত্য কিছু নেই।
শুধু ভালোকে ভালোবাসা, কাউকে ভালোবাসা না। যে ভালো-মন্দ নির্বিশেষে সকলকে ভালোবাসে, তারই ভালোবাসা খাঁটি। যিনি মানুষকে সেবা করেন, তিনি সত্যমানুষ গুরুর সেবা করেন। সংসারে বা সাধনক্ষেত্রে কোথাও বিপদে পড়তে হয় না। ধন চিন্তা দ্বারা ধনাগম হয় না। যেমন আলো জ্বললে আপনা থেকেই পোকা আসে; তেমনি সত্যমানুষ গুরুর চিন্তায়, সেবায়, প্রেম জগতে অবস্থান করলে জীবন আলোকিত হয়, কিছুই অলভ্য থাকে না। শুধু নিজের সুখকে বড় করে দেখা না। সুখান্বেষী জীবন বড় গ্লানিময় এবং প্রেমজগতের সত্য, ভক্তি, দয়া সমস্তই হারায়, শেষে সত্যমানুষ গুরুর কাছ থেকেও বহু দূরে সরে যায়।
সত্যমানুষ গুরুর দিকে এগোতে হলে গুরুর উপদেশ মোতাবেক পথটাকে ভালবাসার চেষ্টা করা শ্রেয়। পথের প্রতি ভালবাসা না এলে এগোনো যায় না। পথটা ভালো না লাগলে সবই বৃথা। একটি পথ ধরেই এগোতে হয়। সত্যমানুষ গুরুর যে রূপ ভাল লাগে, তাঁর প্রতি একটু আকর্ষণ বোধ, তাঁকেই ভালবাসতে চেষ্টা করা।
আধ্যাত্মিক শক্তির প্রভাব সূক্ষ্মভাবে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে কাজ করে। সূর্য উঠলে যেমন আলো আপনি ছড়ায়, তেমনি যারা আধ্যাত্মিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় তাদের প্রভাব আপনিই ছড়ায়। সত্যমানুষকূলের সমাজ যা কিছু করেন আর নাই করেন, তাঁদের অবস্থিতিতেই জগতের কল্যাণ সাধিত হচ্ছে।
সত্যমানুষ গুরু গভীর অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে এবং প্রজ্ঞার আশ্রয় নিয়ে সব ঘটনার মধ্যে নূতন জিনিস খুঁজে বার ক’রে তাঁর নিজস্ব অবদান রেখে দেন। ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’ এটাও যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে, পিতার মধ্যে লুকিয়ে আছে শিশুর শিশুত্ব। পরিণত বয়সেও এই শিশুত্বটি বীজাকারে থেকে যায়; দেখা যায়, বার্ধক্যের অসহায়তার মানুষ শিশুর মতোই হয়ে যায়, শিশু আর বৃদ্ধে বিশেষ প্রভেদ থাকে না। এটা হচ্ছে শিশুত্বের কথা, অর্থাৎ যে শিশুত্ব নিয়ে সে এই জগতে প্রথম এসেছিল। সাধনার চরম কথা এই শিশুত্ব-অর্জন। সত্যমানুষ গুরু নিজেই হয়ে যান বিরাট শিশু।
বাইরের প্রকৃতির সঙ্গে শরীরের প্রকৃতির যেমন একটা যোগ আছে, তেমনি চিন্তারও যোগ আছে। সত্যমানুষ গুরুর পথের যাত্রীদের চিন্তা জগৎকে এমন একটা স্তরে প্রতিষ্ঠিত করতে হয় যেখানে প্রকৃতির চঞ্চলতা কোনও অদিব্য প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। দিব্য চৈতন্যের রঙে প্রকৃতিই রঞ্জিত হয়ে উঠে। সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না যে-কোনও স্বল্পসময়ী ভাবই থাকুক না, সবই থাকতে হবে সত্যমানুষ গুরুর দিব্যভাবে রঞ্জিত।
ভালোবাসার দেশে তিনটি রূপ প্রাকৃতিক গুণময়, দু’টি রূপ অপ্রাকৃতিক। পাঁচ রূপ। এক রূপে ভালবাসা অন্ধ জৈব আকর্ষণ যা সর্বজীবে দেখা যায়। আর এক রূপে চাঞ্চল্য আছে, লালসা আছে, যার ছবি চারিদিকে ছড়ানো। আর এক রূপে সুস্থ সমাজ গড়তে পারা। আর এক রূপে একাগ্র এবং নিরুদ্ধ। এই একাগ্র রূপে ভালোবাসা ভক্তির পথ দেখায়। চেতনায় এটি স্থিতরূপ। শূন্য নিস্পন্দ চেতনায় জাগে তুমি-আমি-আমি-তুমি ভালবাসা চিত্তের নিরুদ্ধভূমিতে। এ হলো সত্যমানুষ গুরুলক্ষ্যে প্রেমজগত। প্রেম জগত সর্বশক্তির অধিকারী-নিরাকার-সর্বত্র বিরাজমান প্রসন্ন উদার স্নিগ্ধতায় জগতের পানে চেয়ে আছে, আর মহাভাবে প্রকৃতি বিবশ হয়ে তার বুকে ঢলে পড়ে চলছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন