বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি…. ১৬

জ্ঞান, ভক্তি, ধর্ম নিজে অর্জন করতে হয়; খুব খাটতে হয়, তবেই নিজস্ব হয়, স্থায়ী হয়, চিন্তায় ভরপুর হয়ে থাকে। কেউ কাউকে এসব দিতে পারে না। সাধন চাই, তবে সিদ্ধিলাভ হয়। যেমন সাধন তেমনি সিদ্ধি। বিনা সাধনে বা চেষ্টায় যা পাওয়া যায় তার গুরুত্ব থাকে না, কদর হয় না, পেয়েও তেমন সুখ হয় না বরং লোভ বাড়ে। যা সহজে আসে তা সহজে চলেও যায়। জীবন চলার পথে সংসারের ঘাত-প্রতিঘাতে, আপদে-বিপদে নানা পরীক্ষায়-প্রলোভনে যেটা আসে সেটা বড় বেশি কাজে আসে না, কোথায় ভেসে যায়।
ধর্মভাব নিজস্ব করা মানে নিজেকে তদ্ভাবে ভাবিত করা, যাতে নিজের অভ্যাসগুলো একেবারে বদলে গিয়ে স্ব-ভাবে যেন আর এক মানুষ হয়ে যাওয়া-এই শরীরেই পরিবর্তনের সাথে সাথে নবজন্মলাভ করা। জীবনপণ করে লাগলে তবে হয়। আর যতদিন সিদ্ধিলাভ বা লক্ষ্য অর্জন না হয় অবিরাম অনন্যমনে সাধন করে যেতে হবে। নিজেকে দাও তো নিজেকেও পাবে, পরও নিজের হবে। যত নিজেকে বাঁচাতে যাবে, তত নিজেকে খোয়াবে, আপনও পর হয়ে যাবে।
অবিরাম সংগ্রাম। বীরের মতো লড়া, পেছন ফিরে না চাওয়া, শুধু এগিয়ে চলা। অবসন্ন হলে বা ক্ষত-বিক্ষত হলে, ভ্রূক্ষেপ না করা। ভয়শূন্য হওয়া। পরাজয়ের কথা চিন্তায় স্থান না দেয়া। মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর-পতন। হয় জয়, নয় মরণ। মরতে হয় তো বীরের মতো মরা শ্রেয়।
আমি অতি দীনহীন, দুর্বল, আমি কিছু পারছি না – বলে মিছে হতাশ হয়ে কোন ফল নেই। ওট নিষ্কর্মাদের লক্ষণ, ওদের দ্বারা কোন কাজ হয় না। উঠে পড়ে লেগে থাকতে হবে, তবে তো হবে। রাস্তা অনেক দূর ও দুর্গম বলে বসে থাকলে কি রাস্তা ফুরায় না।পথ চলতে শুরু করলে, অমনি পথ কমতে শুরু হবে। তবেই আশা হবে, সাহস আসবে, বল আসবে, অপ্রত্যাশিত সাহায্য আসবে, পথও ক্রমশঃ সহজ ও সরল হয়ে আসবে। দেখতে দেখতে গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যাবে। তখন শুধু আনন্দ!
অনেকের ধারণা যে শ্রীগুরুর কাছে বয়াত বা মুরীদ বা দীক্ষা নিলে তাঁর কৃপায় সব দুঃখ ঘুচে যাবে। তখন দুরারোগ্য ব্যাধি সেরে যাবে, মনের মতো চাকরি হবে, ঐহিক সুখ-সম্পদ লাভ হবে, কন্যাদায় হতে মুক্ত হবে, স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় পাশ হবে, মামলায় জিত হবে, ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি হবে, সংসারের জ্বালাযন্ত্রণা, অশান্তি দূর হবে, শনির দশা কেটে যাবে আরও কত কি অলৌকিক বা অপ্রত্যাশিত ভাবে হবে! তাদের জানা উচিত যে, ধর্মলাভের সঙ্গে এসব ঐহিক লাভের ব্যাপারের কোন সম্বন্ধ নেই। আর এ-সকলের জন্যে গুরুর কাছে আবদার করা মহা হীনতা, ধর্মভাবের মোটেই লক্ষণ নয়। যদিও শ্রীগুরু হর্তা- কর্তা – বিধাতা। তাঁকে এসবের জন্যে বিব্রত ও জ্বালাতন করা অত্যন্ত অন্যায়। তাতে তাঁর আশীর্বাদলাভের চেয়ে বিরাগভাজনই হতে হয়। তাঁর সঙ্গে মাত্র পারমার্থিক ব্যাপারের সম্বন্ধ উত্তম।
কামনাভাবে সেবা বা উপাসনা ব্যবসাদারী মাত্র। তাতে ঠিক ঠিক ধর্মলাভ হয় না, ফল লাভ যা হয় তা অতি সামান্য, তুচ্ছ, অস্থায়ী, সহজে ক্ষয় হয়ে যায়। কামনাভাবে উপাসনায় চিত্তশুদ্ধি হয় না, ভক্তি-মুক্তি, বা শান্তি ও আনন্দলাভও হয় না! শ্রীগুরুর কামনা করে দেয়া জিনিস গ্রহণ করতে, এমনকি ছুঁতেও পারছেন না যদিও তিনি মুখে কছু বলেন না।
তাঁকে এই জীবনে পেতে হলে নিজের সমস্ত শক্তিসামর্থ্য দিয়ে সাধন করতে হবে, তাঁকে সর্বস্ব অর্পণ করতে হয়, ষোল আনার ওপরও যদি সম্ভব হয় দিতে হয়। অর্থাৎ যেন পাত্র ছাপিয়ে গড়িয়ে যায়। নিরাশ হবার কিছু নেই। নিজের শক্তি-অনুযায়ী যথাসাধ্য করে যাওয়া উত্তম। স্মরণ রাখতে হবে যতই করি না কেন, তাঁকে পাবার পক্ষে তা কিছুই নয়, তাঁর কৃপা ভিন্ন কিছুই হবার নয়।
আত্মসুখের জন্য বা ভোগলিপ্সু দেহের জন্য যে অন্ন গ্রহণ করছি, তা এই দেহখানাকে আর অমর করে দিতে পারে না! মৌন ভাবসাধনার দ্বারা আজ ক্ষুধার সাথে সত্য-সুন্দরের সংযোগ সাধন করে দেহ রক্ষার সাথে সাথে গুরুকে পরিতুষ্ট করা শ্রেয়। এই দেহ যে জগতের কল্যাণকল্পে উৎসর্গ করতে হবে, সুখলোভী মনোবৃত্তির প্রলোভন-মুখিনী প্রবণতা হতে সযত্নে রক্ষা করে তাকে শ্রীগুরুর কাছে সমর্পণ করতে হবে, প্রতি গ্রাস অন্নতে তা স্মরণে রাখতে হবে।
সাধকের কাছে মৌন কর্ম্মহীনতা নয়, ভবিষ্যৎ কর্ম্মের আয়োজন মাত্র; কর্ম্মবিরতি নয়, আরম্ভ মাত্র। যারা প্রেমজগত জানা সত্ত্বেও পথ চিনতে পারে না, তারা তখন মৌনীর অনাহত উপদেশে পথ বেছে নেয় আর, যারা কল্যাণকে চায় না, অকল্যাণের নরক কু-কেই বেহেশতি সুখ ভেবে অনির্দ্দেশ পতনের পথে ছুটে চলে, তারা কুশলের অভাব অনুভব করে,অন্তরের গোপনতম প্রদেশে নিবিড়তম বেদনা উপলব্ধি করে চমকে উঠে জীবন চলার পথে।
ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত পুণ্যকর্মও কামনার শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। মলিন বাসনার স্পর্শ হতে তা মুক্ত নয়। গুরুর উপর নির্ভর করে নির্বিচারে তাঁর আজ্ঞা পালন করা-এটাও কামনার কর্ম। তবে এ ক্ষেত্রে কামনা বা বাসনা বিশুদ্ধ। গুরুর ইচ্ছা পূর্ণ করবার জন্য যে আন্তরিক বাসনা তা বাসনা হলেও ভুল নয়। এই জাতীয় কর্মকে প্রত্যাশাহীন বলা চলে। চিত্তে ক্ষুদ্র কামনা বা বাসনা না থাকলে এক হিসেবে সেটা কামনাহীন। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে এটাকে কামনাহীন বলা হয় না। আত্মদর্শন না হলে কামনাহীন কর্ম হয় না-এটাও সঠিক নয়। আত্মদর্শন হলে কর্ম থাকে না। দ্বন্দ্ব ভিন্ন কর্ম হয় না-আত্মদর্শন হলে দ্বন্দ্বাতীত স্তরে স্থিতি হয়। তখন গুরু হতে ভিন্ন কিছুই দৃষ্ট হয় না, সবই আত্মরূপে প্রতিভাত হয়। তখন দ্বন্দ্বও নাই, কর্মও নাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন