বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি…. ১২


গুরুর কাছে জাগতিক কোন জিনিস প্রত্যাশা করা উচিত নয়। জাগতিক প্রত্যাশা অশান্তিও নিয়ে আসতে পারে। আমরা যখন গুরু সম্মুখে যাব তখন কখনোই আমাদের ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষা ও বাসনার সঙ্গে জড়িত পার্থিব জিনিস তাঁর কাছে চাওয়া উচিত হবে না। আমরা গুরুর কাছে শুধু চাইতে পারি তিনি যেন আমাদের সংসার সাগরে বা পার্থিব সম্পদের মোহে নিমজ্জমান অবস্থা থেকে রক্ষা করেন। সাধারণতঃ আমরা যখন অসুখী বোধ করি, তখন আমাদের পথ পরিবর্তন না করে এবং সত্য ও শান্তির দিকে না গিয়ে বরং অসুখী অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে চলি আর আমাদের বাসনা ও কল্পনাকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখি। আমাদের দেহবোধ এত বেশি যে দৈহিক ভোগকে সব কিছুর ওপর স্থান দিয়ে থাকি। এতে ত্যাগ করতে আমরা প্রস্তুত নই। আমরা বার বার ধাক্কা ও আঘাত ছাড়া অন্য কিছু না পেলেও ভোগের বিভিন্ন বিষয়ে বেপরোয়াভাবে জড়িয়ে ধরে থাকি। অজ্ঞানতার এমনই ভীষণ শক্তি।
গুরু দেখছেন যে তাঁর ভক্তরা পার্থিব সংসার খেলায় রত। যখন কোন ভক্ত নিজের খেলায় ও কাজে অবসন্ন হয়ে পড়ে তখন গুরু করুনার ডালি নিয়ে তার কাছে আসেন এবং মায়াময় খেলার জগৎ থেকে তাকে উদ্ধার করেন। যতক্ষণ তারা সংসার খেলায় ক্লান্ত না হচ্ছে বা বিরক্তিতে ওই সকল খেলা থেকে সরে না আসছেন, ততক্ষণ গুরুর কিছু করার থাকে না। গুরুর কাছে এটাকে একটি বিরাট গবেষণার স্তর। তারপর একদিন ভক্ত একটু একটু করে উপলব্ধি বড় হন এবং বিলাপ করে বলেন, ‘এ জীবন নিয়ে আমি কি করলাম?’ আর গুরু তখন বলেন, ‘ঠিকই বাছা, কি করলে? কে তোমাকে এসব করতে বলেছিল? কে তোমাকে লোভীর মতো অনিশ্চিতকাল পর্যন্ত এ খেলায় রত থাকতে বলেছিল? কে বলেছিল তোমাকে এ খেলায় আঘাত পেতে ও জড়িয়ে পড়তে? কে এসব করল?’ তিনি বিধ্বস্ত জীবনের ধ্বংসাবশেষের ওপর বসে অনেকসময় বিলাপ করছেন। আমাদের সকলের বিবেকের ও শ্রেয়ের পথ ধরে চলার সুযোগ আছে। কিন্তু আমরা আমাদের সংসারিক বিশেষ বিশেষ খেলা নিয়ে এমন জড়িয়ে থাকি যে ওদের হাতছাড়া করতে চাই না। তাই আমাদের দুঃখ ভোগ করতে হয় এবং এ দুঃখ ভোগ করতে হবে যতদিন না আমাদের জীবন বারবার অসংখ্যভাবে গুরু যে মহান শিক্ষা দিয়ে চলেছেন তা শিখব আর প্রাজ্ঞের মতো কাজ করব। অধিকাংশ মানুষ জাগতিক আশা ও আদর্শ পূরণের জন্য চেষ্টা করে থাকে, আমাদেরও তেমনি আধ্যাত্মিক জীবন ও জ্ঞানের জন্য চেষ্টা করা প্রয়োজন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এই চেষ্টা করছে না। এটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল পছন্দের ওপর, ইচ্ছার ওপর, সিদ্ধান্তের ওপর যা নির্ণয় করে আমরা পার্থিব জীবন বেছে নেব না আধ্যাত্মিকতার পথ ধরে পার্থিব জীবন বেছে নেব, অথবা আমরা দাসত্বের ও ভীতির জীবন-যাপন করব, না মুক্তির ও ভয়শূন্যতার জীবন-যাপন করব।
আমাদের চেষ্টা করতে হবে এমন একটা কিছু পেতে যা শ্রেয়, যার পরিবর্তন ও ক্ষয় হয় না। কিন্তু প্রায়ই আমরা স্বেচ্ছায় বিবেচনা করে অবিদ্যার পথই বেছে নিচ্ছি। কারণ আমরা দেহজ ও আবেগজনিত ভোগের মায়ামূর্তিগুলোকেই জড়িয়ে থাকি। যদিও এগুলোকে আমাদের একদিন না একদিন ত্যাগ করতেই হবে। একদিন আমাদের এসব ছেড়ে দিতেই হবে, তা স্বেচ্ছায় না করলে তা আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে একসময়। সে হবে বড় দুঃখের এবং বহু ক্ষেত্রে হৃদয়বিদারক। অধিকাংশ মানুষ শুধু এভাবেই শিক্ষালাভ করে জীবন চলার পথ চলছেন যদিও এ বেশ বেদনাদায়ক। আমাদের আধ্যাত্মিক জীবন-যাপনের চেষ্টা করতেই হবে। জ্ঞাতসারে, সচেতনভাবে বিচার করে, জীবনোৎসর্গের ভাবে উদ্দেশ্যের প্রতি অনন্যমনা হওয়া। আমাদের এই ইচ্ছাশক্তি আমাদের পছন্দমতো জীবনকে উচ্চতর স্তরে নিয়ে যেতে পারে আবার হীনতর স্তরেও পাঠাতে পারে।
ধর্ম বাক্যাড়ম্বর নয়, অথবা মতবাদবিশেষ নয়, অথবা সাম্প্রদায়িকতা নয়। সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্ম আবদ্ধ থাকতে পারে না। ধর্ম অন্তরের গুণাবলী ও শক্তির সাথে জীবনের লক্ষ্যের সম্বন্ধ নিয়ে। ধর্ম কিরূপে সম্প্রদায়ে পরিণত হবে? সংখ্যাধিক্য হলেই কি মানুষ অধিক ধার্মিক হবে, অথবা এর সংখ্যাল্পতায় কম ধার্মিক হবে? মন্দির বা চার্চ বা মসজিদ-নির্মাণ অথবা সমবেত উপাসনায় ধর্ম হয় না, কোন গ্রন্থে, বচনে, অনুষ্ঠানেও ধর্ম পাওয়া যায় না। আসল কথা অপরোক্ষানুভূতি। ধর্ম অনুরাগে, আকর্ষণে, ব্যাকুলতায়, বাহ্য অনুষ্ঠানে নয়। অন্তরের পবিত্র ও অকপট প্রেমেই ধর্ম।
কোনও ব্যক্তি যে পথে চলতে ইচ্ছা করে তাকে সেই পথে চলতে দিতে হবে; কিন্তু যখন আমরা তাকে অন্য পথে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করি, তখন তার যা আছে, তিনি তাও হারাবেন, তিনি একেবারে অকর্মণ্য হয়ে পড়বেন। যে দেশে সকলকে এক পথে পরিচালিত করবার চেষ্টা করা হয়, সে দেশ ক্রমশ ধর্মহীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে কখনও এরূপ চেষ্টা হয় নি। বিভিন্ন শাস্ত্রীয় ধর্মের মধ্যে কখনও বিরোধ ছিল না, অথচ প্রত্যেক শাস্ত্রীয় ধর্মই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ কার্য–সাধন করে গেছে, সেজন্য বাংলাদেশে প্রকৃত ধর্মভাব এখনও জাগ্রত। সকল শাস্ত্রীয় ধর্মে ভাল ভাল লোক আছেন, এই কারণেই সেসব ধর্ম লোকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে থাকে, সুতরাং কোনও ধর্মকেই ঘৃণা করা উচিত নয়।
শাস্ত্রীয় ধর্মের নামে এত গন্ডগোল, যুদ্ধ ও বাদানুবাদ কেন? ধর্মের নামে যত রক্তপাত হয়েছে, অন্য কোনও বিষয়ের জন্য এত রক্তপাত হয় নি; কারণ সাধারণ মানুষ ধর্মের মূল উৎসে যায় না। সকলেই পূর্বপুরুষগণের কতকগুলো আচার অনুমোদন করেই সন্তুষ্ট থাকেন। তারা চান অপরেও তাই করুক। আত্ম অনুভূতি জাগ্রত না করে অথবা আত্ম ও গুরু দর্শন না করে ‘গুরু’ বলবার অধিকার কি মানুষের আছে? তাঁকে দর্শন করতে হবে; আত্ম উপলব্ধি করতে হবে। যখন জীবনের বর্তমান অবস্থায় ভয়ানক অশান্তি উপস্থিত হয়, যখন নিজের জীবনের ওপরও আর মমতা থাকে না, যখন গোলেমালের জীবনের ওপর ভয়ানক ঘৃণা উপস্থিত হয়, যখন মিথ্যা ও প্রবঞ্চনার ওপর ভয়ানক বিতৃষ্ণা জন্মায়, তখনই ধর্মের আরম্ভ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন