বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি…. ৮


গুরুর নাম স্মরণ করলে দেহ এবং চিন্তা জগৎ শুদ্ধ হয়ে যায়। তাঁর নাম স্মরণ করে, উপদেশ মতো চলে ভক্ত হয়ে গেছি ভাবে, নিজ কর্মে বিশ্বাস রেখে সাধনার পথের যাত্রীর যাত্রা শুরু করতে হয়। উদ্দেশ্য-তাঁকে জানা, তাঁর কৃপা লাভ করা। বিক্ষিপ্ত কামনায় চিন্তা জগৎ মলিন হয়ে আছে, ময়লা পড়ে আছে, তা সাফ করা এবং একরৈখিক হওয়া। জন্মের পর যুগে যুগে ময়লা পড়ে পড়ে চিন্তা জগতে বেজায় ময়লা ধরে রয়েছে, তাকে সাফ করতে না পারলে হাজার চেষ্টা করলেও, কিছুই হয় না। চিত্তশুদ্ধি না হলে গুরুর কৃপালাভ করা যায় না। তাঁর স্মরণ-মনন করলে, সরল প্রাণে তাঁর নিকট নিজেকে শপে দিলে, নিজেকে নিজে বিচার করলে, লক্ষ্যহীন কাজের জন্য অনুতাপ করলে, ব্যাকুল হয়ে সংস্পর্শ ও সান্নিধ্য অর্জনে ব্রত নিলে ধীরে ধীরে ময়লা সব ধুয়ে যায়। তখন গুরুরূপ আকর্ষণ তাকে টেনে নেয়। চিত্ত শুদ্ধ হলেই তাঁর কৃপা হয়, কৃপা হলেই দর্শন হয়।
গুরুর কৃপা পেতে হলে, তাঁর দর্শনলাভ করতে হলে সর্বদা কাতর প্রাণে ভক্তিতে নত থাকতে হয়। তিনি জ্ঞানসূর্য। তাঁর আলোকৃপা একবার যখন কেউ নিজের অবয়বের উপর গুরুরূপ ধারণ করে চিত্ত গঠনে লালন করেন তখন দর্শনলাভ হয়। যতক্ষণ বিক্ষিপ্ত ভোগবাসনা থাকে, ততক্ষণ গুরুকে জানতে বা দেখা করতে প্রাণ ব্যাকুল হয় না। ভোগবাসনা নিয়ন্ত্রিত হলে গুরুর জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়, তখন কি করে তাঁর সান্নিধ্য পাওয়া যায় এই চিন্তা সব সময় অন্তরে তরঙ্গায়িত হয়। প্রেমাস্পদ বাসনা সহজে অন্তরে জাগে। যাদের ওই বাসনা জেগেছে তাদের ওপর গুরুর প্রেমজগতের বিশেষ কৃপা বর্ষণ হয়। সময়ের সাথে সাথে এই মায়ার জগতে মানুষ কতরকমের ধাক্কা খায়, কত কষ্ট পায়, তবুও গুরু আকর্ষণে জীবন চলার পথে পরিবর্তন আনতে সক্ষমতা অর্জন করে।
মজা এখানেই, আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যায়, তবু তাতেই বার বার হাত দেন। শুধু তাই নয়, আরও দশ জনকে ডেকে নিয়ে যান। যদি কেউ তাদের মতে মত না দেন তাকে পাগল বলেন, সম্ভব হলে মারপিট করতেও ছাড়েন না। ছেলে-মেয়েরা যখন নিজের সত্য উপলব্ধি করে পথ চলে, সদ্ভাবে জীবন কাটাতে চায়, অভিভাবকরা তাদেরকে যথাসম্ভব বাধা দেন, কিন্তু যখন তারা দুর্দান্ত হয়ে নিজের ও দশের অমঙ্গলের কারণ হয়, তখন তাদের অভিভাবকরা শুধরাবার যথেষ্ট যত্ন নেন না। সদ্ভাবে চললেই যতো গণ্ডগোল! কোন রকমে তাকে নিজেদের মতাদর্শে নামিয়ে আনার অভিভাবকরা চেষ্টা করেন। এরই নাম সংসার! সামান্য কারণে মানুষ এত চঞ্চল হয়ে উঠেন যে, একটু ভেবে-চিন্তে কিছু করবার ধৈর্য তারা হারিয়ে ফেলেন। একবার ক্ষনিকের জন্য ভেবেও দেখেন না যে, এ কাজটা করলে আমার ভাল হবে কি মন্দ হবে। শুধু তাই নয়, ছেলে-মেয়েদেরকে এমনভাবে তৈরি করেন যে, ভবিষ্যতে তারাও তাদের মতো ধাক্কা খায়। কত সংস্কার রয়েছে, তার উপর ছেলেবেলা থেকেই তাদের মতিগতি ও ভোগবাসনার দিকে যাতে যায় সেরূপভাবে তৈরি করেন। গুরু সান্নিধ্যে এসে এইসব আপদ-বিপদ কাটিয়ে যারা বেরিয়েছেন বা বেরুবার চেষ্টা করছেন তারাই ভাগ্যবান।
যিনি মিথ্যাভাষী, রুক্ষভাষী তিনি আপন সুখেই নিজের ক্ষতি নিজে করেন এবং অন্যের সুকৃতি বাড়িয়ে দেন। সজ্জনের সেবা করলে সজ্জনের ভাব পাওয়া যায়। চোরের সেবা করলে চৌর্যবৃত্তির প্রতি আসক্তি জন্মে। অন্যের ক্ষতি করতে গেলে নিজের ক্ষতি আগে হয়; চিন্তা অশুভে রঞ্জিত হয়। ইচ্ছেটাই সব। স্ব-ইচ্ছা না হলে ভালো হতে পারা যায় না । খারাপ থেকে নিবৃত্ত হতে স্ব-ইচ্ছা হলেই তা থেকে মুক্ত হওয়া যায়, অন্যকে জয় করতে না চাইলে তাকেও কেউ জয় করতে পারেন না। কারুর অমঙ্গলের চিন্তা না করাই শ্রেষ্ঠ আচরণ।
গুরুসেবাকার্যে ব্যাপৃত থাকলে অন্তরে শান্তির পরাকাষ্ঠা আসে। রক্ষণীয় হলো সদাচার। ধন আসে যায়, বিত্তহীন হলেও সদাচারের গুণে অক্ষীণ থাকা যায়, কিন্তু সদাচারভ্রষ্ট হলেই একেবারে নষ্ট হতে হয়।
মিত্রতা স্থাপন সদাচারের একটা বড় অংশ। মিত্রদের সম্মান করা, যত্ন করা অবশ্য কর্তব্য। ধর্ম ঘাট, সত্যরূপে তার প্রকাশ, ধৈর্য তার তট আর দয়া তার তরঙ্গ। আত্ম-অন্বেষণ নদীতে যারা প্রতিনিয়ত স্নান করেন তারাই সত্যব্রতী হওয়ার পথের যাত্রী। গুরুই সত্য। গুরু চিন্তা অভ্যাস না করলে পা পিছলে পড়তে পারে। গুরুকে ধরে থাকলে চোখ বুজে দৌঁড়ালেও পতন হয় না।
জ্ঞান অর্জনের পথে কর্ম্ম চলমান রাখলে আপনা হতে স্মৃতির দ্বার উদঘাটিত হয়। কালের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ চিত্রের ন্যায় প্রকাশিত হয়। গুরুতে সার্বিক অঙ্গনে নির্ভর করা, সর্ব্বাবস্থায় তাঁর নাম স্মরণ-মনন করা, সংযত হওয়া, ধৈর্য ও ক্ষমা অঙ্গের ভূষণ করা, নিজকে সংযত ও প্রকৃতিকে স্ববশে আনতে পারার অভ্যাসে রত থাকলে স্ব-ভাব তৈরী হয়। স্ব-ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে পৃথিবীর যেখানেই যাওয়া যাক না কেন, অভাব অশান্তি সঙ্গে সঙ্গে যাবে না। চিন্তায় অস্থিরতা থাকলে শান্তি মেলে না। আবার গুরুর ইচ্ছা হলে অশান্তির মধ্যেও শান্তি পাওয়া যায়।
বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান ও শক্তি সমস্তই গুরু আশ্রিত। নিজকে তাঁর বিকাশের যন্ত্ররূপে ব্যবহার করা শ্রেয়। আনন্দস্বরূপত্ব প্রেমজগতের একটা দেশ। ব্যক্তি নিজেই আনন্দের উৎস। জগতের সকল আনন্দ সেই উৎস হতে উৎসারিত। এই দেশে জগতের সমস্ত সুখ হেয় হয়ে যায়, জৈবিক চাহিদা তুচ্ছ হয়, বাসনা কামনা নিবৃত্ত হয়। তখন নিজকে ভুলে পাপী, তাপী, দুঃখী, দরিদ্রকে দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে সেবা করলে গুরু দর্শন হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন