শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

সময়ের সাফ কথা…. উপলব্ধি চরিত্রের একটি বায়বীয় বস্তু

সময়ের সাফ কথা…. 

উপলব্ধি চরিত্রের একটি বায়বীয় বস্তু

সংলাপ ॥ দেশের সাধারণ মানুষ, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মূল লক্ষ্য থেকে ক্রমাগত দুরে ছিটকে যাচ্ছে। নাগরিক হিসাবে প্রাপ্য ন্যূনতম সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যত, ততই বাড়ছে হিংসা ও বিদ্বেষের লেলিহান শিখা। সে শিখা কখনও জাতির নামে, কখনও ধর্মের নামে, কখনও ভাষার নামে। বাংলাদেশের এই যে সামূহিক বোধ, বিবিধের মধ্যে মিলনের মন্ত্র সেখান থেকে ক্রমাগত ছিটকে যেতে যেতে ছোট ছোট দ্বীপে পরিণত হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। এক মুষ্টিবদ্ধ হাত শক্তি হারিয়ে পরিণত হয়ে যাচ্ছে নিতান্তই পাঁচটা আঙুলে। যারা একত্র হলে বজ্রনির্ঘোষের পরিস্থিতি হয় তারাই এখন বিদ্বেষক্লিষ্ট সন্দেহদীর্ণ সহাবস্থানে।
এক দশক ধরে দেশের ‘অগ্রগতি’ নিয়ে শ্লাঘার শেষ নেই। ক্রম ক্ষমতায় কতগুলো দেশকে ছাড়িয়ে গিয়েছি, অর্থনীতির আকারে কতটা সামনের সারিতে চলে এসেছি, সামরিক শক্তিতে কতটা আস্ফালন করার জায়গায় পৌঁছে গিয়েছি, ফি বছর কত টাকার অস্ত্র কিনছি, গোটা দেশে কী ভাবে পরিকাঠামোর উন্নয়ন ঘটিয়েছি, মহাকাশে কতটা পথ পাড়ি দিয়েছি- সে নিয়ে বিস্তর দর্প আমাদের। দর্প অথবা শ্লাঘারই বিষয় এ সব, সংশয় নেই তাতে। কিন্তু সুদূর মহাকাশেও চোখ রাখতে দক্ষ হয়ে গিয়েছে যে ধর্মরাষ্ট্র, সে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সংসদের মাত্র দশ কিলোমিটারের বৃত্তে কি ঘটছে দারিদ্র আর ধর্ম নিয়ে দেখতেই পায়না রাষ্ট্র!
এ লজ্জা আমরা রাখব কোথায়? স্বাধীনতার পর চারটা দশক পেরিয়ে এসেছি। ধনকুবেরের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। দৈনন্দিন জীবনে অসীম জৌলুসের যাবতীয় উপকরণ ভেসে বেড়াচ্ছে। মসজিদও বাড়ছে কিন্তু এক বিপুল সংখ্যক নাগরিকের নাগালের অনেক বাইরে থেকে যাচ্ছে এখনও সে সব। ধনবৈষম্য ক্রমশ বাড়ছে, সম্পদ ক্রমশ মুষ্টিমেয়র হাতে সমন্বিত হচ্ছে, আর কোটি কোটি নাগরিকের রোজকার সংগ্রাম ক্রমশ কঠিন হচ্ছে। কঠিন থেকে কঠিন হতে থাকা সেই  জীবন-সংগ্রামটারই প্রতীক হয়ে ধরা দিচ্ছে ঢাকা শহরেই।
আমরা কি সুসংহত বা সুস্পষ্ট কোনও নীতি তৈরি করতে পেরেছি, যার মাধ্যমে এই বিপুল সংখ্যক নাগরিককে দারিদ্রের কবল থেকে বার করে আনা যায়? কোনও দিশা কি আমরা খুঁজে বার করতে পেরেছি, যাতে এই নাগরিকদের উপার্জন এবং জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটানো যায়? উত্তর কারও কাছে নেই। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না থাকাটাও সমান লজ্জার। রাষ্ট্রের কাছে লজ্জার, রাজনীতিকদের জন্য লজ্জার, সমাজের জন্য লজ্জার, দায়িত্বশীল নাগরিকদের জন্যও লজ্জার।
৪৭-টা বছর ধরে কী করলাম তা হলে! নিজেদের নাগরিক কর্তব্যগুলো কি ঠিক মতো পালন করতে পারলাম? যদি শাসনযন্ত্রে উপযুক্ত লোকগুলোকে মনোনীত করতে পারতাম, তা হলে কি এতটা শোচনীয় বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হত আজও? আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজেদেরকেই প্রশ্ন করা। শুধু প্রশ্ন করাই নয়, জরুরি উত্তরটাও খুঁজে বার করা। না হলে এ লজ্জার কবল থেকে আমাদের মুক্তি অসম্ভব।
উপলব্ধি চরিত্রে এটি বায়বীয় বস্তু। দেখা যায় না, কথাও কয় না। কিন্তু আছে কি না তা দিব্যি বোঝা যায়। সাধারণ মানুষেরা বোঝেন কম। খানিকটা লেখাপড়া শিখে ফেলার পরও সেই শিক্ষিতরা বেঁচে থাকতে থাকতে বোঝেন তারাও প্রকৃত উপলব্ধির বিশেষ কিছু বোঝেন না। বাংলাদেশে একমাত্র রাজনীতিকবৃন্দ প্রায় সবই বোঝেন। যখন যে–দল দেশের ভাগ্যবিধাতা হিসেবে সরকার পরিচালনা করে, তারা বিদ্যেবুদ্ধির সব বোঝে তো বটেই, তাদের উপলব্ধিও গভীর থেকে গভীরতম হয়ে শেষ পর্যন্ত মর্মান্তিক হয়ে দাঁড়ায়। দেশবাসী শোকস্তব্ধও হলেও, তবু কিচ্ছু করার থাকে না। ওই উপলব্ধি সংক্রান্ত উৎসাহেরও এক ধরনের ধারাবাহিকতা থাকে। কঠোর পরিশ্রম যে চিরকাল বুদ্ধি ও শিক্ষাকে হারিয়ে দেয়, সেটাও দেশবাসীকে বুঝতে হবে। প্রবল পরিশ্রম করেই সেই সত্য বুঝতে হবে। কিচ্ছু করার নেই, এটাই উপলব্ধি। দেশবাসী যদি এই অনুভব  উপলব্ধির মধ্যে রাজনীতি খুঁজে পান, সেটা তাদেরই বিচ্যুতি। ক্রমাগত কঠোর পরিশ্রম করলেই নিশ্চয় দেশবাসীর পবিত্র গণতন্ত্র সম্পর্কিত উপলব্ধি বাড়বে!
আর্থিক বৃদ্ধি বা মাথাপিছু আয় বাড়লেও সুখের সূচকে ক্রমশ নামছে দেশ। সমাজ হঠাৎই হিংসাত্মক হয়ে উঠছে। প্রায় রোজই সংবাদমাধ্যমে সেই সব ভয়ানক ঘটনা উঠে আসছে। শুধুমাত্র আইনরক্ষকদের দায়িত্ব দিলেই এ সবের সমাধান হবে না। আর্থিক উন্নয়নের পরিসংখ্যানের বাইরে গিয়ে সার্বিক ভাবে সামাজিক উন্নয়নের উপর জোর দেওয়ার সময় এসেছে। শিল্পমহলকেও শুধু মুনাফা নয়, নজর দিতে হবে সার্বিক উন্নয়নে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন