শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

‘মা’ শাশ্বত চেতনার উৎস

‘মা’ শাশ্বত চেতনার উৎস

সংলাপ ॥ সে’ই নিজের ধর্ম, রাসুল ও আল্লাহ্কে চিনতে পারবে যে নিজের মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিকে ভালবাসতে ও শ্রদ্ধা করতে শিখেছে – একজন সাধক-এঁর এই আপ্তবাক্যের মর্মার্থ উপলব্ধির সময় এসেছে আজ। ধর্মীয় অনুভূতির আবর্তে আমরা সবাই আবর্তিত। আবেগ তাড়িত তথাকথিত ধর্মীয় বিশ্বাসে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না সত্যদর্শন। নিজের ও অন্যের কল্যাণিক চিন্তা-চেতনায় ধারণ করতে হয় সত্যকে। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? এই মাটিতে কোন্ সত্যে প্রতিষ্ঠিত করবো নিজেকে?
‘মা’ শব্দটি স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণের এক অপূর্ব ও অনন্য সুষমামন্ডিত সমন্বিত রূপ। সঙ্গীতে স্বরগ্রামে মধ্যমের সংক্ষেপাক্ষরও বটে। আভিধানিক অর্থের সীমানা ডিঙিয়ে ‘মা’ এক শাশ্বত চেতনার উৎস। কেবল জন্মের কৃতজ্ঞতায় নয়, অস্তিত্বের প্রগাঢ় বন্ধনে ও মন্থনে ‘মা’ মানেই দুর্বার অঙ্গীকার, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে লালিত এক স্বপ্নগুচ্ছ। ‘মা’ থেকেই অস্তিত্বের প্রকাশ। ‘মা’য়েতেই অস্তিত্বের লালন। ‘মা’য়েতেই অস্তিত্বের বিকাশ।
আক্ষরিক গঠনে ‘মা’ যতো ছোটই হোক না কেন, চেতনায় এর বিস্তৃতি ব্যাপক, বিশাল।  তাই ‘মা’ কেবল ঘরের চার দেয়ালে আদর্শ গৃহিনীর আঙ্গিক নিয়েই আবদ্ধ থাকেনি। ছড়িয়ে পড়েছে কালিক বোধের উত্তরণে মর্মে মর্মে, জীবনে জীবনে একমাত্র ঠিকুজীরূপে। সৃষ্টির মহত্তর আনন্দে অবর্ণনীয় কষ্ট সয়ে যে ‘মা’ আমাদের এনে দেন পৃথিবীর আলোয়। আগলে রাখেন  স্নেহের সুশীতল আঁচলে। দেহে দেন পুষ্টি আর মুখে দেন বুলি। বুলি মানে কথা। কথা মানে ভাষা। এ ভাষা মায়ের ভাষা। মাতৃভাষা। মায়ের কোল থেকে আত্মনির্ভর হওয়ার আকাঙ্খায় পা রাখি যে ভূমিতে সেও আমার মায়ের ভূমি। মাতৃভূমি। সুতরাং সূত্রের অবিচ্ছিন্ন ও অনিবার্য সত্যে মা, মাতৃভাষা এবং মাতৃভূমি এক চেতনায় গাঁথা অস্তিত্বের স্তর বিন্যাসমাত্রা।
জীবনের সফল উত্তরণে ‘মা’ এক অবিকল্প সোপান-বেদী। যে সন্তান তার জন্মদাত্রী ‘মা’-এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও কর্তব্যপরায়ণ, তার সাফল্য অনিবার্য। কিন্তু যে তার নিজ মায়ের প্রতি অনুরক্ত নয়, নিজেরে যে শ্রদ্ধা করতে বা ভালবাসতে জানেনি বা শেখেনি, সে কখনো আদর্শ সন্তান হতে পারে না। অনাদর্শিক জীবনের যাত্রায় সে তখন নিজ ভাষা, নিজ জন্মভূমির প্রতি উদাসীন বা বিরাগী হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
দেশ চায় আদর্শ নাগরিক। কিন্তু কোথায় সে আদর্শ নাগরিক? কীভাবেই বা হওয়া যায় আদর্শ নাগরিক? একজন নাগরিক একজন সন্তানও। দেশ ও ‘মা’-তুল্য বা আখ্যায়িত। বলা হয়, ‘জননী, জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরিয়সী।’ মা, মাতৃভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্বের আসনে যিনি আসীন, সেই ‘মা’ কেমন আদর্শের প্রতীক এবং কতটুকু শ্রদ্ধাভাজন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘মা’-এর গুরুত্ব অনুধাবন করেই নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘আমাকে একজন আদর্শ মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি সুন্দর জাতি দিব।’ সুতরাং একটি সুন্দর দেশ ও একটি সুন্দর জাতি গড়বার ক্ষেত্রে ‘মা’ কতোটা গুরুত্ব বহন করে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। সেই ‘মা’-কে উপেক্ষা করে কোনভাবেই কি কেউ দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে?
মায়ের কাছে শেখা বুলি তথা মাতৃভাষার প্রতি তখনই শ্রদ্ধা ও প্রীতি জন্মাবে এবং প্রগাঢ় হবে যখন মায়ের প্রতি গভীর ও সুদৃঢ় আন্তরিক বন্ধন থাকে। মা-বোধ তখন আদর্শিক চেতনায় তাকে অনুপ্রাণিত করবে ‘মা’ তথা ‘আত্ম’ বিকাশে। ভাষাই সেই বিকাশের উৎকৃষ্ট মাধ্যম। তাই মাতৃভাষার চর্চা, চর্যা ও শ্রীবৃদ্ধিতে তার জাগে আন্তরিকতা। নতুবা ভিন্ন ভাষার প্রতি মোহ দিন দিন বাড়তেই থাকবে। আন্তর্জাতিক বিলাসিতায় রুচির বিকৃত ধারায় সে ছুঁতে উদগ্রীব হবে ভিন্ন ভাষা ও ভিন্ন ভাষীকে। গ্রাস হবে অন্যের দ্বারা। ছিন্ন হবে আপন বলয় থেকে। উপড়ে যাবে মূল শিকড়। টবে রাখা গাছের মতো সে তখন প্রোথিত হবে ভিন্নতায় কিন্তু যোগ থাকবে ভূমিতে। অন্যের দয়া-দাক্ষিণ্যের সীমারেখায় হবে বন্দি ও শোষিত। নিজস্ব ভূবনের অনন্ত আলো-বাতাস এবং মুক্ত দিগন্ত যাবে হারিয়ে। ভয়ংকর সেই পতনের কথা আমরা যেন স্মরণে রাখি।
ভিন্ন ভাষা প্রীতি, ভিন্ন সংস্কৃতির চর্চা করে যারা নিজেদের আন্তর্জাতিক করতে চায় তারা কি প্রথমেই তার মা-মাতৃভূমি, মাতৃভাষার প্রতি অনুরক্ত ও দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত? ভিন্ন ভাষায়, ভিন্ন সংস্কৃতির আবর্তে নিজেকে চালিত করে কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না জীবনের ভিত্তি। পতিত ব্যক্তির সমষ্টিতে জাতির জীবনেও নেমে আসে বিপর্যয়। এই সত্য – উপলব্ধি কি আমরা হারাতে বসেছি?
প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার বিশ্বের অনেক দেশেই  মা দিবস পালিত হয়। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, মা দিবস পালন করার রীতি এ যুগের নয়। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগেও অনেক জায়গায় এই দিবসটি পালন করতো মানুষ। অবাক হবারই কথা। খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগে থেকেই মিশর, রোম ও গ্রিসে মা দিবস পালন করা হতো। তবে সে দিবসটা ঠিক আমাদের বর্তমানের মা দিবসের মতো ছিলো না। সেটাকে মা দেবতাদের আরাধনা বলা যায়। সে সময়ে মা দেবতাদের পূজা করা হতো। যেমন দেবী আইসিস, সিবিলি, রিয়া প্রমুখ। ১৬ শতকে মা দিবস পালন করা হতো বলে জানা যায়, এটাই হলো দেব-দেবীদের মা ছাড়া নিজের আসল মা-কে নিয়ে দিবস। দিবসটি তারা মাদারিং ডে হিসেবে পালন করতো। সেদিন সরকারি ছুটিও ছিলো। কিন্তু নানা কারণে সেটা তারা চালু রাখতে পারে নি। এর প্রায় ১০০ বছর পর ১৮৭০ সালে আমেরিকার জুলিয়া ওয়ার্ড হাও নামের এক গীতিকার মা দিবস পালনের প্রস্তাব দেন। এরপর ভার্জিনিয়ার একটি মহিলা দল জুলিয়া ওয়ার্ড হাও-এর প্রস্তাবিত মা দিবসটি পালন করতো বেশ মর্যাদার সঙ্গেই। অনেক পথ পেরিয়ে ১৯১৪ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্র উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে জাতীয় মা দিবসের মর্যাদা দেয়। আরও পরে ১৯৬২ সালে এই দিবসটি আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার আন্তর্জাতিক মা দিবস হলেও সব দেশ এই দিবসটি পালন করে না। অনেক দেশেরই আলাদা আলাদা মা দিবস আছে এবং সেই দিনেই তারা মা দিবস পালন করে।
মা-এঁর প্রতি সীমাহীন শ্রদ্ধা, সন্তানের চিরন্তন অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা, ভালবাসা ও মা দিবসের চেতনায় বিনয়াবনত হওয়ার দিন মা দিবস। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ ও সুরক্ষাস্থল মা-এর কোল। যে তার মাকে শ্রদ্ধা করতে জানে সে মাতৃভাষা-মাতৃভূমিকে ভালবাসতে পারে। ভালোবাসার এই ক্রমধারা অটুট ও অকৃত্রিম রেখে আমরা জাগ্রত চিত্ত বাঙালি হয়ে উঠি এবং দেশ-জাতিকে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করতে মা-কে শাশ্বত চেতনার উৎস হিসেবে ধারণ করি এই হোক আমাদের প্রথম প্রার্থনা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন