শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

সময়ের সাফ কথা…. জাগ্রত চিত্তকে আহ্বান করতে হবে- মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির জন্যে

সময়ের সাফ কথা….
জাগ্রত চিত্তকে আহ্বান করতে হবে-
মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির জন্যে

সংলাপ ॥ এ দেশের সংবিধানে যে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ দ্বিধা ও সংশয়ের অবকাশ থেকে গেছে, তার মধ্যে সম্ভবত প্রধান স্থানটা নেবে, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি। যে ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে নূতন সার্বভৌম দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল, তার মধ্যেই এই দ্বিধাময়তার সূত্রটি লুক্কায়িত। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলতে গিয়ে ধর্ম বস্তুটাকে পিছনে রাখবার দুঃসাহস জাতির নির্মাতারা দেখাতে পারেন নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ভাবতে হবে, বাংলাদেশে গণস্থান বস্তুটার ক্রমবিকাশের ইতিহাস বিষয়ে। ঔপনিবেশিক সমাজে গণস্থান কোনও কালেই ইউরোপ বা পশ্চিম বিশ্বের মতো একটি ধর্ম-বিযুক্ত স্থান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি। সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ও জাতীয়তাবাদের আবাহন করতে গিয়ে বারংবার উপনিবেশকে নিজ ঐতিহ্য, এবং সেই সূত্রে নিজ ধর্মীয় ঐতিহ্যকে প্রকাশ্যে  আনতে হয়েছে।
স্বাধীন দেশ বিবিধ ধর্মকে সমান অধিকার দেবার কথা ভাবলেই যে প্রকাশ্য গণস্থানে বিবিধ ধর্মের আচার পালন করতে দিতে বাধ্য হতে হবে, এমন কথা বলা চলে না। সরকারের অধীন ভূসম্পত্তির উপর তো সকল নাগরিকের সমান অধিকার থাকবার কথা। ধর্মের ভিত্তিতে সেই অধিকার কমানো-বাড়ানো সঙ্গত কাজ নয়। ধর্মকে স্থান দিতে গেলে পরোক্ষে সরকার তথা রাষ্ট্রের, ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটাই তাতে কলুষিত হয়। এ প্রশ্ন কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, সাম্প্রতিক সংখ্যাগুরুবাদের দ্রুতবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে অতি সংবেদনশীলও বটে।
বাঙালি জাতির মধ্যে যারা রাষ্ট্রবাদী ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা করছেন, তারা ধর্ম সম্পর্কে যে কোনও ভাবনাকেই ঠেলে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন বলে ধর্ম বিষয়টা পুরোপুরি ধর্মান্ধদের কবলে চলে গেছে। বাঙালি সমাজে একটা ধর্মভাবের শিকড়ও যথেষ্ট গভীর যাকে বলতে পারা যায় ধর্মীয় মানবতাবাদ। সামাজিক ক্ষেত্রে ধর্মমুখী কিন্তু মানবতাবাদী চিন্তাধারা বাঙালি পেয়েছে লালন, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ, আজানগাছি এবং সত্যমানুষ সমাজ তথা সাধককূলের কাছ থেকে। মানবধর্ম পালনের কথা জাতি শুনেছে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের এবং রাজনৈতিক নেতা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর কাছেও। তাই আশা জাগে, বাঙালি সমাজটাকে ধর্মীয় বিরোধিতার কাচের মধ্য দিয়ে না দেখে তাকে বরং মিলনের ক্ষেত্র হিসেবে দেখার শুভবোধ অবশ্যই একদিন বাঙালির মধ্যে জাগ্রত হবে।
মানুষের ধর্ম-এর বিবিধ ভাষ্য বাঙালি পেয়েছে বাংলার সাধককূলের ভাবনায়। এঁদের পরস্পরের চিন্তাধারার মধ্যে অনেক তফাত আছে ঠিকই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এঁদের ভাবনায় একটা সাধারণ ঐক্যও আছে। বাঙালি সমাজের বিভিন্ন স্তরে সেই চিন্তাধারার প্রভাবটা বেশ গভীর প্রসারী। রাজনীতির মধ্যেও সেই উত্তরাধিকার আমরা দেখতে পাই। আবার বঙ্গবন্ধু এবং মণিসিং-মোজাফ্ফর-ভাসানী কথাও স্মরণ রাখতে হবে, যারা বহির্জীবনে বিরাট মাপের রাজনৈতিক নেতা আর ব্যক্তিজীবনে ধর্মপ্রাণ ছিলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে ধার্মিকতা দেখানো তারা একদম পছন্দ করতেন না। তাই, এই যে এখনকার তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ নেতারা মন্দিরে মাজারে ঘুরছেন, এটা তারা কখনও করার কথা ভাবতেন না। ধর্ম যা কিছু, সে সব ছিল তাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস। ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হয়েও কী ভাবে ধর্মের প্রতি কোনও পক্ষপাত না দেখিয়ে রাজনীতি করা যায়, এই সব নেতা দেখিয়ে গিয়েছেন। বাংলার মুসলমান, বা গোটা বাঙালি জাতি সেই জন্যই তাদের প্রতি ভরসা রাখতে পেরেছিলেন।
জাতীয় জীবনে এক-একটা সময় আসে যখন এই ধরনের ধর্মান্ধতা অনেক বেশি করে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা এখন তেমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি। মাঝে মাঝে ভয় হয়, ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত তৎকালীন কলকাতার মধ্যবিত্তের মনোভাব যেভাবে পাল্টে গিয়েছিল, তারই যেন নতুনরূপে প্রতিফলন উঁকি দিচ্ছে আজকের বাংলাদেশেও। হিন্দু মুসলমান উভয়ের মধ্যেই উগ্র ধর্মান্ধতার মনোভাব ছড়িয়ে পড়ছে।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ হেরে গেল, জিতল আওয়ামি লীগ আর কৃষক শ্রমিক পার্টি। মাত্র পাঁচ-সাত বছরের ব্যাপার। ওই সময়গুলো সমাজের জন্য ভয়ের, তবু আমাদের ধর্মীয় মানবতাবাদের ঐতিহ্যটা এত গভীর যে সেখানে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তবে, সঙ্কটের মুহূর্তগুলোয় সাধারণ নাগরিকদের অনেক বেশি রাজনৈতিক সচেতনতা দেখাতে হবে, মানবতাবাদী চিন্তাধারাটা ধরে রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধু সবার। তার দেখিয়ে যাওয়া পথে রাজনীতি করতে হবে। বাঙালি জাতি যেন সেই রাষ্ট্রশক্তির আহ্বান করে যা শত্রু মিত্র কারও ভিতরে কোনও ভয় ও সংশয় উদ্রেক করবে না। জাগ্রত চিত্তকে আহ্বান করতে হবে, যার সংস্কারমুক্ত উদার আতিথ্যে মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি অকৃত্রিম সত্যতা লাভ করে। মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির কথাটা জোর গলায় বলার সময় এসেছে। সঙ্কীর্ণ বিরোধিতার ক্ষমতালোভী রাজনীতি থেকে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী মানবতাধর্মী রাজনীতি অনেক অনেক বেশি মূল্যবান, অনেক বড় মাপের উত্তরাধিকার এটা রাজনীতিকদের উপলব্ধি করার সময় বহমান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন