শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

সময়ের সাফ কথা…. অদক্ষ ভরসায় টেকসই শক্তি!

সময়ের সাফ কথা…. 

অদক্ষ ভরসায় টেকসই শক্তি!

সংলাপ ॥ অদক্ষ শ্রমশক্তির এবং লক্ষ্যহীন আবেগের ভরসায় টেকসই শক্তি হবার খোয়াব আমরা দেখতে পারি। বিশ্বায়নোত্তর বাংলাদেশের বৃদ্ধির মডেলটা কখনও পণ্য উৎপাদন-নির্ভর ছিল না, জোর ছিল পরিষেবায়। ফলে, উৎপাদন ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে বিপুল কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বাংলাদেশে তৈরি হয় নি। কর্মসংস্থানও গতিহীন। ভবিষ্যতে গতিবৃদ্ধির সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
বিশ্বাসযোগ্যভাবে দায়বদ্ধ আমাদের রাজনীতিকরা এমনটা ভাবতে আমরা প্রায় ভুলে যাচ্ছি। সকলের ক্ষেত্রে না হলেও, অধিকাংশ রাজনীতিকের ক্ষেত্রেই ভুলে গিয়েছি। কিন্তু জনসাধারণের প্রতি বা গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা থাক বা না থাক, নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতাটা থাকা অত্যন্ত জরুরি। রাজনীতিকদের অনেকেই বোধ হয় সেটুকুও আর চিন্তায় রাখতে পারছেন না।
নির্বাচনকে ঘিরে প্রত্যেক বারই উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা বাংলাদেশ, দুঃসহ ক্ষতের রক্তস্রোতে অসহায় হয়ে পড়ে গণতন্ত্র। বাংলার সাম্প্রতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতিটা যে রকম, শাসক-বিরোধীর সম্পর্কটা যে পর্যায়ে আজ, তাতে রাজনৈতিক হানাহানির অঢেল আশঙ্কা এবারের নির্বাচনকে ঘিরেও।
বিরোধী দলগুলো পুলিশে ভরসা রাখতে পারছে না। বছরভরই বিরোধীরা অভিযোগ করে আসছেন যে, শাসক দল আর পুলিশ-প্রশাসন মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেছে। সে অভিযোগ যে নিতান্তই অমূলক, এমন কথা বলা অত্যন্ত কঠিন। বিরোধীদের কর্মসূচীর সামনে পুলিশের আচরণ মাঝে-মধ্যেই দেশবাসীর অপার বিস্ময়ের কারণ হয়ে ওঠে। সংসদ নির্বাচনী মরসুমে যে পুলিশের আচরণে বিস্ময়কর উপাদান আরও বেশি পরিমাণে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, সে নিয়ে সংশয় দেশবাসীর। ভরসার অভাবে সামরিক বাহিনীর নজরদারিতে নির্বাচনের দাবি উঠছে।
সরকারি কর্তারা অনেক কিছু শিখতে পারেন। শিখতে পারেন বৃহত্তর জনসমাজও, যেখানে ক্ষমতার উচ্চ অবস্থাই সামাজিক আচরণবিধি স্থির করে দেয়। প্রশাসনিকতা মানুষকে কেন্দ্র করেই চলে। দরিদ্র, অশিক্ষিত, অন্ত্যজ মানুষ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিতে এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ। রাষ্ট্রের নিকট তারা কিছু পরিষেবা পেয়ে থাকেন। কিন্তু, এক আনা পরিষেবার সাথে মিশে থাকে পনেরো আনা অপমান, অবজ্ঞা, দুর্ব্যবহার। হাসপাতাল হতে দোকান, সর্বত্রই তাদের মূল প্রাপ্তি অপমানের মুদ্রায়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাদের অবুঝ প্রশ্নে নাজেহাল হয়ে কর্মকর্তারা দুর্ব্যবহার করছেন। আবার, সেই ব্যবহারই অভ্যাস হয়ে  দাঁড়াচ্ছে। সমাজ শিখতে পারে, কী ভাবে সমমানুষের মর্যাদা দিয়েও অবুঝ বা অন্যায় দাবি হতে মানুষকে সরিয়ে আনা যায়। কিন্তু, তার আগে মানুষকে মানুষজ্ঞান করার অভ্যাসটা  তৈরি করা বিধেয়।
যে কোন ক্ষত শুকোতে অনেকটা সময় লেগে যায়। এই ক্ষত বহিরঙ্গে নয় অন্তরঙ্গে। এটাই দুর্ভাগ্যের।  দুর্ভাগ্যের কারণ এ বাংলার মাটির সঙ্গে মিশে থাকা সেই বাউল ফকিরেরও, পির দরগায় মাথা ঠেকানো সেই জনতার অথবা দুর্গাপুজোর প্রস্তুতিতে সামিল থাকা মুসলমান মুখগুলোরও।
অতএব, দারুণ বেদনার সময় এখন। ক্ষত যত, ক্ষতি তত এটা বোঝার ক্ষমতাও এখন বোধ হয় বিলুপ্ত হতে বসেছে। ক্রমাগত। অলিতে এবং গলিতে, পথে এবং প্রান্তরে এখন অস্ত্রের ঝনঝনি। তরবারির কোপ পড়ছে এখন ক্রমাগত সমাজের প্রতিটি গ্রন্থিস্থলে, প্রতিটি মিলন প্রাঙ্গনে, যে প্রাঙ্গন কয়েক হাজার বছর ধরে পরস্পরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সযত্নে লালন করে আসছিল হিন্দু এবং মুসলমানের সম্প্রীতি।
বানভাসি বলে যে শব্দটা বাংলা ভাষায় চালু আছে, তার অর্থ সকলের জানা। বানের পানির তোড়ে ঘরবাড়ি ভেঙে যায়, প্লাবনের রূপ নেয় গ্রাম ও শহর। মাঠভর্তি ফসল তলিয়ে যায় পানির তলায়। শহরের রাস্তায় নৌকো চলে। জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
রাজনীতিকদের এক শ্রেণী তাদের নিজস্ব ধার করা বিদ্যা বিতরণ করছেন। কিন্তু দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ, কষ্ট, হতাশা, যন্ত্রণা, বেদনার কোনও প্রতিফলন তাতে থাকে না। সেটা হয়ে উঠছে এক কল্পজগৎ বিড়ম্বনা।
চোখ বুজে বলা যায় দেশে গণতন্ত্র তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে, বুক ঠুকে তা বলা যাচ্ছে না। বলা যাচ্ছে না দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ ঠিক কী। সংসদ ও সর্ব্বোচ্চ আদালত  গণতন্ত্রের শিরদাঁড়া। এই দুই প্রতিষ্ঠানের হালে না থাকার অর্থ গণতন্ত্রের শয্যাশায়ী হয়ে পড়া। তাই বাংলাদেশের পক্ষে নিশ্চিতই এটা সুসময় হতে পারে না।
জাতি কতটা উন্নত তা পরিমাপের একটা সূচক হলো শিক্ষা। একমাত্র শিক্ষাই একটি অনুন্নত জাতিকে উন্নত জাতিতে পরিণত করতে পারে এবং উন্নতি ধরে রাখতে পারে। এইভাবে পৃথিবীর সব জাতি সুশিক্ষা লাভ করতে পারলে তবেই আমরা সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে পারব। শিক্ষাচিত্রের কোথায় কেমন পরিবর্তন ঘটছে তা জানার জন্য বিশ্বজুড়ে প্রতিবছরই নানা ধরনের সমীক্ষা করা হয়। বলা বাহুল্য, অধিকাংশ রিপোর্টে একটি সাধারণ চিত্র উঠে আসে যে, সব দেশে সব সমাজে সাক্ষরতার হার বাড়ছে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে যে পরিবর্তনটি ঘটে চলেছে তা অবশ্যই ইতিবাচক। আমরা জানি, যে-কোনও স্তরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ অন্তে শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট বা প্রশংসাপত্র লাভ করেন। এইসকল প্রশংসাপত্রই হলো শিক্ষা এবং গবেষণার পরবর্তী ধাপে উত্তরণের চাবিকাঠি। কর্মজীবনে পৌঁছনোর এবং পদোন্নতির প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশংসাপত্রের বিকল্প নেই। তাই যে-কোনও পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার লক্ষ্য সকলেরই থাকে। পরীক্ষার্থীদের সাফল্য বা ব্যর্থতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট স্কুল কলেজের নাম, সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠান পরিচালকদের ভাবমূর্তি। অস্বীকার করা যাবে না যে, বেশিরভাগ পরীক্ষার্থীই এজন্য পরিকল্পনামতো দীর্ঘদিন যাবৎ পরিশ্রম করে প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। যেসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বিষয়টির গুরুত্ব স্বীকার করেন তারাও সারাবছর ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোয় যত্ন নেন। এইভাবে পরিশ্রমের ফসল লাভ প্রশংসনীয় ও অভিনন্দনযোগ্য।
কিন্তু সমাজের একটি অংশ যে প্রকৃতির পরমসত্য নিয়মের উপর আস্থা রাখে না তাও আমাদের দেখতে হয়। যতগুলো কারণে শিক্ষাব্যবস্থা কলঙ্কিত হয়ে আছে তার একটা হলো বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণনকল করা। সুযোগ পেলেই এখনকার বিভিন্ন পরীক্ষায় কিছু ছেলে-মেয়ে নকল করে থাকে। পরীক্ষা চলাকালে পরীক্ষাগ্রহণ কেন্দ্রের বাইরে থেকে কীভাবে নকল সরবরাহ হয় তার ছবি ইদানীং গণমাধ্যমে আমরা পেয়ে থাকি।
এতদিন এসব কেলেঙ্কারিতে স্কুল কর্তৃপক্ষের নাম প্রকাশ্যে আসেনি কিন্তু এখন আসছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং নকলের পরিচিত দৃশ্যটাও নির্মূলের চিন্তাভাবনা যখন হচ্ছে, তখন কোচিং সেন্টারগুলো এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অভিযোগ উঠছে।
ভাবা যায়! আসলে শিক্ষা বিস্তার নয়, মজবুত প্রশংসাপত্রের বিতরণেই আস্থা রাখেন এইসব রত্নখচিত শিক্ষকরা। তাই দেশজুড়ে, বিশ্বজুড়ে শিক্ষার হার বৃদ্ধির ফুরফুরে কাগুজে প্রতিবেদনের প্রতিফলন দেখা যায় সমাজে। সরকারি ও বেসরকারি স্তরে কেলেঙ্কারির পাহাড় আর বিশ্বজুড়ে সংঘর্ষ আর মৃত্যুর মিছিলে আমাদের প্রতিটি দিন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। এর শেষ কোথায়? অন্তত চলমান শিক্ষাব্যবস্থা যে এর উত্তর দিতে পারবে না তা কোনও গবেষণা ছাড়াই বলে দেয়া চলে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন