বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি....২৯


আনুষ্ঠানিকতা অধমাধম। তার মানে অধমেরও অধম, সবচেয়ে নীচু, সবচেয়ে স্থূল। ধ্যানভাব মধ্যম। অধম হলেও আনুষ্ঠানিকতা ত্যাজ্য নয়। আনুষ্ঠানিকতা একেবারে তলায়, তলায় হলেও সেটা একটা ধাপ; আরম্ভেতে সেটাও করতে হয়। সিঁড়ি দিয়ে ধাপে ধাপে ছাদে উঠতে হয়।
সাধনা নিজের মন্দকে দূর করা। শ্রীগুরু শুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ, তাঁকে পাপ স্পর্শ করতে পারে না, তিনি পাপকে প্রকাশ করতে পারেন। লক্ষ্য অর্জনের জন্য লক্ষ্যকে চিন্তা করতে হয়। আরোপ করতে করতে লক্ষ্য স্বরূপ সম্বন্ধে ধারণা হয়; নিয়ন্ত্রণ আসে নিজের ওপর, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় নিজের ওপর। কৃচ্ছসাধন ইচ্ছে হয়, তাই কৃচ্ছসাধন করা। তীর্থভ্রমণে কাজের কাজ কিছু হয় না, কেবল অন্তর উচাটন আর অর্থহানি হয়ে থাকে। ঘরে বসে শান্তভাবে অন্তরে শ্রীগুরু চিন্তা করলেই কাজ হয়। মানুষ নিজের অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। দরকার সকলেরই আছে! যত জপ করতে পারা যায় ততই ভাল। গুরুউপদেশ! লালন আর পালনে খাটতে হয় খুব। শ্রীগুরুর সান্নিধ্য লাভ করতে হলে সাধনার পথের যাত্রীর চাই:-(১) ধৈর্য। (২) অধ্যবসায়। (৩) দেহ ও অন্তরের পবিত্রতা। (৪) তীব্র আকাক্সক্ষা বা ব্যাকুলতা। (৫) অন্তরের স্থিরতা, বিষয়ে আসক্তি-ত্যাগ, সকল প্রকার দুঃখে অবিচলিত থাকা, শ্রদ্ধাবনত শ্রীগুরুতে ও তাঁর উপদেশবাক্যে আস্থা ও চিত্তস্থাপন।
সাধন-ভজনের দ্বারা যেসব বিষয়ে উপলব্ধি বা দর্শনাদি হয় তা শ্রীগুরু ছাড়া আর কাকেও না বলা। আধ্যাত্মিক সম্পদ-অন্তরতম চিন্তাধারা-নিজের অন্তরে লুকিয়ে রাখতে হয়। তা অপরের কাছে প্রকাশ করতে হয় না। ওটা পবিত্র গুপ্তধন, একমাত্র শ্রীগুরুর সঙ্গে একান্তে উপভোগ্য বস্তু। আবার দোষ, ত্রুটি ও অনাচারের কথা অপরের কাছে বলে বেড়ানো সঠিক নয়। তাতে আত্মসম্ভ্রম খোয়া যায় ও অপরের কাছে হীন বলে প্রতিপন্ন হয়। নিজের দোষ, দুর্বলতা শ্রীগুরুকে জানাতে হয় ও তার কাছে প্রার্থনা করতে হয় যেন তিনি সেগুলো শোধরাবার শক্তি দেন।
ধ্যান করতে হলে প্রথমে খানিকক্ষণ স্থির হয়ে বসে চিন্তা যেখানে যেতে চায় যেতে দিতে হয়। ভাবতে হয়, নিজেই সাক্ষী, নিজেই দ্রষ্টা। বসে বসে লক্ষ্য-চিন্তায় ভাসা-ডোবা, চিন্তার দৌঁড়-ঝাঁপ দেখা এবং উপলব্ধি করা। ভাবতে হয়, আমি সম্পূর্ণ পৃথক। যখনই কোন অন্য চিন্তা আসে, তখনই সেটাকে জোর করে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হয়। অভ্যাস বৈরাগ্য ছাড়া লক্ষ্যে একাগ্রতা আনবার অন্য কোনও সুগম বা সহজ উপায় নেই। যতক্ষণই জপ বা ধ্যান করা-ততটুকু নিমগ্ন হয়ে করা। শ্রীগুরু অন্তর্যামী, ভেতর দেখেন, তিনি তো আর কতটুকু সময় ধ্যান করা হলো বা কতবার জপ করা হলো তা দেখেন না। ৪/৫ বছর নিষ্ঠার সাথে নিয়মিত করলে তবে আনন্দ পাওয়া যায়। তখন একদিন না করলে ভারি কষ্ট হয়, কিছু ভাল লাগে না। আধ্যাত্মিক জীবন লাভ করতে দৃঢ় প্রত্যয়ী হওয়া দরকার। 
জীবনের অর্ঘ্য শ্রীগুরুর পায়ে অর্পণ করতে হয়। এটা জীবনের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য। তারপরে নির্ম্মাল্য হয়ে জগতের প্রতিজনের সংস্পর্শে আসা। অকপটে যে জীবন শ্রীগুরুতে উৎসর্গীকৃত হয়েছে, সে জীবনের সংস্পর্শে যে যখনি আসুক, নির্ম্মাল্যের পবিত্রতাকে সম্মান করে চলতে সে বাধ্য হয়। চর্মচক্ষে মানুষ শ্রীগুরুর বাহ্যিক রূপ দেখতে পায় আসল সত্য রূপ দেখতে পায় না, কিন্তু সত্যময় পবিত্রতা-রূপে যে প্রভা তিনি বিকিরণ করছেন, তা অনুভব করতে পারে এবং তার সৌরভ গ্রহণ করতে সমর্থ হয়। যে যতটুকু নিবেদনে পবিত্র, সে ততটুকু শ্রীগুরুর, সে ততটুকু উন্নত, সে ততটুকু আদরণীয়। শ্রীগুরুর হলে,-পবিত্রতার দিব্য সুগন্ধ সমস্ত অস্তিত্বকে ঘিরে ধরে থাকে।
শ্রীগুরুকে ভালবাসলে কামনা আপনি কমে যায়, ক্রোধ আপনি থেমে যায়, লোভ আপনি দমিত হয়,- এর জন্য আলাদা করে আর কোনও চেষ্টা করতে হয় না। পন্ডিতেরা মানবের সকল আচরণে, সকল দৃষ্টিভঙ্গীতে, সকল চিন্তা-ধারায় কামনার অপ্রতিহত মূর্তি আবিষ্কার করে শঙ্কিত হয়েছেন এবং অর্দ্ধোপভুক্ত ও অনুপভুক্ত কামনার কুফল যেমন করে সমাজের প্রতি অঙ্গে অকল্পনীয় অশান্তি এনেছে, তা দেখে কামনাকে অধিকতর নিশ্চয়তার সাথে উপভোগ করে অন্তরের বিকার প্রশমিত করে নিয়ে সকলকে শান্তি ও নিরুদ্বেগ জীবনের পথপ্রদর্শন করবার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন। 
কামনার পৃথক অস্তিত্ব নেই। নিখিল ভুবন প্রেমময় প্রেমজগৎ, একের সাথে সম্পর্ক হতে প্রেম সৃষ্টি হয়েছে, তাই সব-কিছু প্রেমময়। সে প্রেম ক্ষুদ্র আধারে পড়ে কামনা নাম ধারণ করে। আবার অনন্ত অসীম শ্রীগুরুর চরণে পড়ে নিজ স্বরূপ প্রকাশ করে, প্রেম হয়। কামনা প্রেমজগতেরই একটা দিক মাত্র, সম্পর্ক নিত্যশুদ্ধ অবস্থা। আত্মসুখের লিপ্সার সাথে যখন মিশ্রিত হয়, সম্পর্ক তখন কামনা হয়ে যায়; শ্রীগুরুর বিশ্বসুখে, বিশ্বাত্মার সুখে, বিশ্বপ্রভু সুখের লিপ্সার সাথে যখন যুক্ত হয়, কামনা তখন প্রেমে পরিণত হয়ে যায় এবং বিভিন্ন রূপ ধরে সর্ব্বপ্রাণীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হৃদয়ে বাস করে। যে মুহূর্তে কোনও প্রাণী জানে যে, কামনার পৃথক কোনও অস্তিত্ব নেই, শ্রীগুরুর প্রেমময় অস্তিত্বেই তার প্রকৃত অস্তিত্ব, তখন আর কামনা তার ক্ষুদ্র লক্ষ্য, ক্ষুদ্র দৃষ্টি, ক্ষুদ্র লীলা-বিলাস-লাস্য নিয়ে বসে থাকতে পারে না, তখন সে প্রেমের বিশ্বম্ভরী মূর্তি ধারণ করে এবং শ্রীগুরুর প্রতি অর্পিত ভালবাসাকে বিশ্বের প্রতিজনের প্রতি বিসর্পিত করে দিয়ে নিজেও হয় প্রতিক্রিয়া বর্জিত মধুময়, বিশ্বকেও করে বিপুল আনন্দে উল্লসিত। শ্রীগুরুকে ভালবেসে, অন্তরের কামনাকে শ্রীগুরুর চরণে রাখতে হয়, তাঁর অকৈতব প্রেমের মধুময় স্পর্শে কামনা তার কণ্টকমালা হতে রিক্ত হয়ে পারিজাত-মাল্য গলদেশে ধারণ করে বার হয়ে আসে, পূতিগন্ধময় তার অস্তিত্ব কলুষহীন নিষ্পাপ-সুন্দর দিব্যসুরভি নিয়ে বহির্গত হয়। যা ছিল গুপ্ত শত্রু, তা হোক নিখিল বিশ্বের প্রতিজনের পরম কুশলকারী নিত্যবন্ধু।
সত্য-প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শ্রীগুরুচর্য্যের পরম-সহায়ক। পরম সত্যই স্রষ্টা শ্রীগুরু - এটা সাধককুলের তথা সত্যমানুষকুলের উপলব্ধি। সত্যে যে বিচরণ করে, শ্রীগুরুতে বিচরণ তার কঠিন হয় না। সত্যে দৃঢ় প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে হয়। যে পরের প্রাপ্যের প্রতি অন্যায় ও লুব্ধ দৃষ্টি দেয় না, তার পক্ষে সত্যে সুদৃঢ় হওয়ার পথ সুগম। যে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না, তার পক্ষে সত্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সহজ। যে অপরের অনুগ্রহ-লাভের প্রত্যাশী নয়, নিজের কার্য্য নিজের শক্তিতেই সাধন করতে চেষ্টিত, তার পক্ষেও সত্যে প্রতিষ্ঠালাভ সহজ। জগতের অধিকাংশ ভুলই বস্তু লাভের লোভ হতে সৃষ্ট হয়। যা লক্ষ্যপথে কিছু লাভ করতে পারে না। শ্রীগুরুর প্রতি লোভ মানুষকে ভুল পথে যেতে বাধ্য করে। যার প্রতি বিদ্বেষ আছে, ক্ষমার মহিমায় যদি তার প্রতি অন্তরের শত্রুতা-বোধ প্রশমিত করতে না পারা যায়, তা হলে তাকে অপদস্থ, হতমান ও পরাভূত করবার জন্য ভুল পথের আশ্রয় নিতে প্রলুব্ধ হয়।
ধর্মের শিক্ষা মানবকে বিনয়ী করে। ধর্মের জ্ঞান মানবকে মহান করে। মানবের এই জ্ঞানকে জীবনে লালন করতে হয়। একজানা জীবনে যুক্ত না হলে, সমস্তই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এটা জীবনে অনুশীলন করতে হয়, তাহলেই এর সার্থকতা। যে কোন অনুভূতি অনুশীলন সাপেক্ষ অর্থাৎ সব কিছুই অনুশীলনের ভিতরে। এক-লক্ষ্য জানাকে জীবনে অনুশীলন করাই মানব জীবনের সাধনার একটা বৈশিষ্ট্য। সত্যাশ্রয়ী, নিষ্কন্টক, সহজ মানবই এক-লক্ষ্য জানাকে জীবনে অনুশীলন করেন। আর তাই তিনিই কেবল পরম উপলব্ধি লাভ করতে পারেন। অনুভূতিই ধর্মের প্রাণ-অনুভূতি বিহীন ধর্ম নিষ্ফল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন