বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি…. – ৬


সকলেই গুরু তথা সত্যমানুষ হতে পারেন না। আবার শিষ্যও সবাই হতে পারেন না। গুরু ও শিষ্যের উপযোগী গুণাবলী থাকা চাই । গুরুলাভে আগ্রহশীল, জগতের ক্ষণস্থায়িত্বে বিশ্বাসী, জাগতিক ব্যাপারে নিরাসক্ত এবং জাগ্রতচিত্ত ব্যক্তি শিষ্য হওয়ার অধিকারী। গুরু গুরুময়। দশ লক্ষে একজন এই সত্যোপলব্ধি হয়তো করে থাকেন। আবার যিনি গুরুলাভ করেছেন, তার উপলব্ধির বিষয় গুপ্ত রাখা তিনি বেশি পছন্দ করেন। এ কারণে উপযুক্ত গুরু-শিষ্য হওয়া খুব কঠিন। সকলে সব রূপে গুরুকে উপলব্ধি করেন না। আমরা সকলেই জানি এবং দেখতে পাই ভিন্ন ভিন্ন দেশে নৈতিক ধারণা ভিন্ন। এক দেশে যা সুনীতি বলে বিবেচিত হয়, অপর দেশে হয়তো তাহা সম্পূর্ণ দুর্নীতি বলে পরিগণিত। বিশ্ব সমাজে অন্যান্য অঙ্গনেও দেখতে পাওয়া যায় যে, মূল্যবোধ ও মান দেশে দেশে ভিন্ন, তথাপি সদাচারের একটি সার্বভৌম মান ও আদর্শ আছে।

কর্তব্য-সম্বন্ধেও একইরূপ। কর্তব্যের ধারণা বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন। কোন দেশে কেহ বিশেষ কোন ধর্মীয় কর্ম না করে, লোক বলবে সে অন্যায় করছে; অপর দেশে আবার ঠিক সেই কর্মগুলো করলেই লোকে বলবে, সে ঠিক করে নাই। তথাপি কর্তব্যের একটি সর্বজনীন ধারণা অবশ্য আছে। সমাজ এক শ্রেণীর কর্মবিশ্লেষণকে কর্তব্য মনে করে, অপর এক সমাজ আবার ঠিক এর বিপরীত মত পোষণ করে এবং ওইরূপ কর্ম করতে হলে আতঙ্কিত হয়। দু’টি পথ খোলা : অজ্ঞ লোকের পথ, তারা মনে করে সত্যলাভের পথ মাত্র একটি, আর সব পথ ভুল; আর একটি জ্ঞানীদের পথ, তারা স্বীকার করেন, মানুষের মানসিক গঠন অথবা অবস্থার স্তর অনুসারে কর্তব্যও ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। সুতরাং কর্তব্য ও সদাচারের ক্রম আছে; জীবনের এক অবস্থায় এক পরিবেশে যা কর্তব্য, অপর অবস্থায় অন্যরূপ পরিবেশে তা কর্তব্য নয়। লাভের পথ বহুবিঘ্ণে পূর্ণ। একমাত্র দৃঢ় সঙ্কল্পই এসব বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করতে পারে।
অজ্ঞতা হেতু প্রতারিত হওয়া সহজ। সমাজের চারদিকে প্রচুর সংখ্যায় নকল বর্তমান। প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে সাধরণ মানুষের কোন ধারণা নেই। সামান্য অলৌকিক শক্তির ছটা বিভ্রান্ত করার পক্ষে যথেষ্ট। অলৌকিক শক্তির সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কোন সম্পর্ক নেই। কোন ফন্দিবাজ বা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ধোঁকা দিয়ে সাধারণ মানুষদের যে কোন একটা বাজে মতবাদে ভিড়িয়ে দিতে পারে। অনেকে এই ফাঁদে পা দিয়ে প্রচন্ড কষ্ট ভোগ করেন। জীবন ব্যর্থ হয়ে যায় এবং ধর্ম-বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। আন্তরিকভাবে গুরুকে চাইলে, কোন ঝোঁকে পড়ে ধর্মানুশীলন না করলে, সহজাত প্রকৃতি বলে দেবে যে নিজেকে গুরু বলে দাবি করেন তিনি অকৃত্রিম গুরু কিনা। আন্তরিকতাই পথপ্রদর্শক।
গুরু ধর্মশাস্ত্রের মর্মজ্ঞী। যিনি গুরু শব্দ নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করেন ও চিন্তাকে কেবল মুখ-শব্দের শক্তি দ্বারা চালিত হতে দেন; তিনি ভাব হারিয়ে ফেলেন… শাস্ত্রের মর্ম যিনি জানেন, তিনিই গুরু তথা সত্যমানুষ। শব্দ যোজনা, সুন্দর ভাষায় বক্তৃতা ও শাস্ত্রমর্ম ব্যাখ্যা করার বিভিন্ন উপায় পন্ডিতদের বিচার ও আমোদের বিষয় মাত্র, এ দ্বারা অন্তর্দৃষ্টির বিকাশ হয় না। …জগতের কোনও গুরু তথা সত্যমানুষ এরূপ শাস্ত্রের নানাবিধ ব্যাখ্যায় অগ্রসর হননি। শুধু তাঁরা জগৎকে অতি সুন্দর শিক্ষা দিয়েছেন।
গতিবিজ্ঞান, রসায়ণ বা অন্য কোন পদার্থবিজ্ঞান শিখতে হলে, শিক্ষক যেই হোন না কেন, কিছু আসে যায় না। কারণ ওতে কেবল বুদ্ধিবৃত্তি চালনা বুদ্ধি বৃত্তিকে কিঞ্চিৎ সতেজ করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু অধ্যাত্মবিজ্ঞানের পথযাত্রীরা অশুদ্ধচিত্ত হলে, তাতে ধর্মালোক থাকতে পারে না। অশুদ্ধচিত্ত ব্যক্তি ধর্ম কি শিখবে বা শিখাবে? নিজে আধ্যাত্মিক সত্য উপলব্ধি এবং অপরে সঞ্চার করার একমাত্র উপায় অন্তর ও চিন্তার পবিত্রতা। যতদিন না চিত্তশুদ্ধ হয়, ততদিন গুরুদর্শন বা সেই অতীন্দ্রিয় সত্তার আভাস জ্ঞানও অসম্ভব। নিজের মধ্যে শক্তি না হলে তিনি সঞ্চার করবেন কি? সত্যমানুষ হওয়ার পথের যাত্রীদের এরূপ প্রবল আধ্যাত্মিক স্পন্দন বিশিষ্ট হওয়া চাই যে, তা যেন সমবেদনাবশে অন্য পাশাপাশি যাত্রীদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে যায়। সত্যমানুষ হওয়ার পথের যাত্রীদের বাস্তবিক কাজই এই কিছু সঞ্চার করা, কেবল বুদ্ধিশক্তি বা অন্য কোন শক্তি উত্তেজিত করা নয়। নিজে নিজেই বুঝতে পারা যায়, গুরু সংযোগে যাত্রীদের যথার্থই একটি শক্তি আসছে শুদ্ধচিত্ত হওয়ার।
চিন্তাকে জাগতিক বিষয় থেকে নিবৃত্ত করা নয়, ওই সব বিষয়ের প্রতি প্রেরণা-প্রসূত নিয়ন্ত্রিত হওয়া এবং এই সঙ্গে গুরুর জন্য ব্যাকুলতা। প্রথম প্রথম ব্যাকুলতা খুব স্পষ্ট হয় না এবং গুরু ধারণাও সুনির্দিষ্ট নয়। যারা আন্তরিকভাবে নিয়মিত সাধন করেন তাদের মধ্যে কেউ হয়তো দেখতে পারেন, ক্রমে সূক্ষ্মতর স্তরের সীমানায় উঠে গিয়েছেন, যেখানে রয়েছে উচ্চতর চেতনা ও আনন্দ। এর সামান্য আভাসে চিত্ত উচ্চতর অনুভূতির জন্য উন্মত্ত হয়ে ওঠে। এই আকাক্সক্ষা অম্লান হয়ে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। আকস্মিক ধর্মাকাক্সক্ষা স্বাভাবিক নাও হতে পারে, হয়তো মূলে রয়েছে গভীর শোক, হতাশা বা ব্যাধি। এমনও হতে পারে, প্রিয়জন কেউ মারা গেছে। চিন্তা জগতে প্রচন্ড প্রতিক্রিয়া অনিত্যত্ত্ব বোধরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। অনেকে এ অবস্থায় ধর্মজীবন গ্রহণ করে এবং গুরুমুখী হয়। এর প্রতিটি পদক্ষেপেই যে ভুল তা নয়। অনেক সময় এরূপ মানসিক বিপর্যয় বন্ধন ছিন্ন করে স্থায়ী আধ্যাত্মিক সুফল নিয়ে আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ ক্ষণিক আবেগের বশীভূত হয়ে পড়ে। তার ফলে যেটুকু উদয় হয় তা অতি কৃত্রিম। কিছুদিন পর দ্বিগুণ উন্মাদনার সঙ্গে দেহসুখে ডুবে যায়। এ হচ্ছে সময় ও শক্তির অপচয়। এ ধরনের অস্বাভাবিক অবস্থার চাপে পড়ে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়। চরম পন্থা ভাল নয়। তার ফলে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং ঘনিয়ে আসে প্রবল বিতৃষ্ণা।
সাংসারিক বিফলতা ও ব্যাধিপ্রসূত বৈরাগ্য আরও হেয়। বাস্তব জীবনে এরূপ বহু মানুষ দেখা যায়। তাদের পক্ষে সবচেয়ে ভাল, আপন কর্তব্য-সীমা অতিক্রম না করে যথাশক্তি সাধনা চালিয়ে যাওয়া। গুরু লাভের বৃথা চেষ্টার পরিবর্তে তাদের ধন যশ লাভের প্রয়াসই করা উচিত। ব্যাধিগ্রস্ত হলে চিকিৎসকই তাদের প্রথম ও প্রধান। অতএব যখন কেউ ধর্মসাধনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, অতি সাবধানে তাকে নিজ উদ্দেশ্য বুঝে নিতে হবে। অতি দীর্ঘ ও নিপুণ পর্যবেক্ষণের পর প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ করতে হয়। চিন্তার ভিতর সন্দেহজনক কিছু ধরা পড়লে, সবচেয়ে ভাল পূর্বজীবন অনুসরণ করে চলা, যতদিন পর্যন্ত না গলদ বেরিয়ে যায়। নড়বড়ে ভিত্তির উপর আধ্যাত্মিক জীবন গঠন চেষ্টা অত্যন্ত বিপদজনক। এর জন্য পরে অনেক বেশি খেসারত দিতে হতে পারে। ভিত্তি সুদৃঢ় ও ত্রুটিহীন হতে হবে যেন কোথাও একটু দুর্বলতা না থাকে। একমাত্র তার উপরই প্রকৃত ধর্মজীবন গড়ে তোলা সম্ভব। যখন ধর্মাকাক্সক্ষায় কোন কৃত্রিমতা নেই, তখন পরবর্তী পদক্ষেপ হবে এই আকাক্সক্ষা কতোটা দৃঢ় তা বিচার করা। এর সঠিক মূল্যায়নের উপর উর্দ্ধমুখী হওয়া নির্ভর করে।a

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন