বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি…. ১৫

গুরু ব্যতীত সাধকের জীবনে উচ্চতর লক্ষ্য আর কিছু নেই। সাধকের সর্বোচ্চ লক্ষ্য গুরুকে দর্শন করা, তাঁকে সম্ভোগ করা। গুরু অপেক্ষা উচ্চতর বস্তু সাধক ধারণাই করতে পারে না, কারণ গুরু পূর্ণস্বরূপ। প্রেমজগতের গুরুপ্রেম স্তর অপেক্ষা কোন উচ্চতর আনন্দ সাধক ধারণা করতে পারে না। প্রেম শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রেম-শব্দ দ্বারা সংসারের প্রত্যাশা যুক্ত সম্পর্ক সাধারণ ‘স্বার্থযুক্ত ভালবাসা’ বুঝায় না -একে প্রেম নামে অভিহিত করা আত্মনিন্দার সমান। মানুষের সংসারের প্রতি ভালবাসা প্রজাতির ভালবাসার মতো। যে ভালবাসা সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ, তাই একমাত্র ‘প্রেম’ এবং তা কেবল গুরুর জন্যই সম্ভব। এই প্রেমস্তর লাভ করা বড় কঠিন ব্যাপার। মানুষ পিতামাতা, পুত্রকন্যা ও অন্যান্য সকলকে ভালোবাসছে -এ রকম বিভিন্ন প্রকারের ভালোবাসা বা আসক্তির ভেতর দিয়ে মানুষ চলছে।
মানুষ ধীরে ধীরে প্রীতিবৃত্তির অনুশীলন করে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই বৃত্তির পরিচালনা হতে কিছুই শিখতে পারে না – একটা স্তরে আরোহণ করে তাতে মানুষ আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কখন কখন মানুষ এ বন্ধন অতিক্রম করে থাকে। মানুষ এ জগতে চিরকাল স্ত্রী-পুত্র ধন ও মান-এ সবের দিকে ছুটছে, সময়ে সময়ে তারা বিশেষ ধাক্কা খেয়ে সংসারের ভালোবাসার বিভিন্ন রূপ বুঝতে পারে। এ জগতে গুরু ব্যতীত আর কাকেও ঠিক ঠিক ভালোবেসে প্রেম করতে পারে না। শেষ বয়সে মানুষ বোঝে, মানুষের ভালবাসা সব শূন্য। মানুষ ভালবাসতে পারে না-শুধু কথায় বলে। স্বামী আমি তোমায় বড় ভালোবাসি – বলে স্ত্রী অশ্রু বিসর্জন করে তথাকথিত পতিপ্রেমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে থাকে, কিন্তু সেই স্বামীর যখন মৃত্যু হয়, অমনি সন্ধান করে, ব্যাঙ্কে তার কত আছে; আর কাল কি গতি হবে ভেবে আকুল হয়। স্বামীও স্ত্রীকে খুব ভালবেসে থাকেন, কিন্তু স্ত্রী রূপ-যৌবন হারালে অথবা সামান্য দোষ করলে তার দিকে আর চেয়েও দেখেন না। জগতের সব ভালোবাসা অন্তঃসারশূন্য ও কপটতাপূর্ণ।
সান্ত জীব কখন ভালোবাসতে পারে না, অথবা সান্ত জীব ভালোবাসার যোগ্যও হতে পারে না। প্রতি মুহূর্তেই যখন ভালবাসার পাত্রে দেহের তরঙ্গে তরঙ্গায়িত এবং সঙ্গে সঙ্গে চিন্তারও পরিবর্তন হচ্ছে, তখন এ জগতে অনন্ত প্রেমের কি আর আশা করা যেতে পারে? গুরু ব্যতীত অন্য কারও প্রতি প্রকৃত প্রেম সম্ভব নয়! তবে এসব ভালোবাসাবাসি কেন? এগুলো কেবল ভ্রম মাত্র, প্রেমজগতের বিভিন্ন অবস্থামাত্র। মহাশক্তি সত্যমানুষকূল নিরাকার পথে মানুষ প্রজাতির অন্তরাল হতে ভালবাসবার জন্য প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন-মানুষ জানেন না কোথায় সেই প্রেমাস্পদ সত্যমানুষ গুরুকে খুঁজবে, কিন্তু ব্যাকুলতা মানুষকে এর অনুসন্ধানে সামনে অগ্রসর করে দিচ্ছে। বারংবার ভুল ধরা পড়ছে। একটা জিনিস ধরলাম-সেটা হাত হতে ফসকে গেল, তখন অন্য একটা কিছুর জন্য হাত বাড়াচ্ছি। এ ভাবে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি মৃত্যুর দিকে। শেষ পর্যন্ত আলো এসে থাকে, তখন অনুসন্ধিৎসু গুরুর কাছে হাজির হন – একমাত্র গুরুই যথার্থ ভালোবেসে থাকেন, তাঁর ভালোবাসার কোন পরিবর্তন নেই, তিনি সর্বদাই অভাবিদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকেন। ব্যক্তি নিজেকে অনিষ্ট করতে থাকলে কে কতক্ষণ অত্যাচার সহ্য করবেন?
যাঁর ক্রোধ ঘৃণা বা ঈর্ষা নেই, যাঁর সাম্যভাব কখন নষ্ট হয় না, যাঁর জন্ম নেই-মৃত্যু নেই, তিনি গুরু ব্যতীত আর কি হতে পারেন? তবে গুরুকে লাভ করা বড় কঠিন এবং তাঁর নিকটবর্তী হতে হলে বহু দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়-অতি অল্প লোকই তাঁকে লাভ করে থাকেন। মানুষ শিশুর মতো হাত-পা ছুঁড়ছে মাত্র। লক্ষ কোটি লোক ধর্মের দোকানদারি করেন, সকলেই ধর্মের কথা বলেন, খুব কম লোকই প্রকৃত ধর্ম লাভ করে থাকেন। এক শতাব্দীর মধ্যে অতি অল্প লোকই সেই গুরুপ্রেম লাভ করে থাকেন। এক সূর্যের উদয়ে সমগ্র অন্ধকার তিরোহিত হয়, তেমনি এক অল্পসংখ্যক যথার্থ ধার্মিক ও কালোত্তীর্ন সাধকের অভ্যুদয়েই সমগ্র দেশ ও জাতি ধন্য ও পবিত্র হয়ে যায়।
শিক্ষার মাধ্যমেই দেহ এই শিক্ষা পায় যে ব্যাধি আছে, অপ্রতিরোধ্য দুর্ঘটনা আছে বা দেহের বার্ধক্য আছে-এই শিক্ষা আস্থা ও বিশ্বাসকে নষ্ট করে দেয়। চিন্তার বিকৃতিই নিশ্চিয়তাকে বিনষ্ট করে। দেহ নমনীয় আবার খুবই অনমনীয় এবং সে জন্যই দেহের অবনতি ঘটে। দেহকে কি করে ব্যবহার করতে হয় মানুষ জানেন না। জানি না আমরা যখন ছোট ছোট পাতার মত সতেজ থাকি তখন কেমন করে মনোরম, অত্যুৎকৃষ্ট ও নিখুঁতভাবে পুষ্পিত হওয়ার জন্য আস্পৃহা করতে হয়। সৌন্দর্য্যরে যে বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে, তার উপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। একটা ছোট শিশুকেও সৌন্দর্য্যরে জন্য আস্পৃহা করা উচিত; অন্যদের সন্তুষ্ট করা বা তাদের প্রশংসা লাভের জন্য নয় বরং শুধু সৌন্দর্য্যকে ভালবাসার জন্যই। সৌন্দর্য্য এক আদর্শ যা স্থূল জীবনে সকলকেই লাভ করতে হবে। প্রত্যেক মানুষেরই তার শরীরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ও তার ক্রিয়ারত বিভিন্ন গতিধারার মধ্যে সংগতি প্রতিষ্ঠা করার সম্ভাবনা আছে। প্রত্যেক মানবদেহই-যা তার অস্তিত্বের আদি থেকে যুক্তিসিদ্ধ প্রণালীতে শরীর চর্চা সাধন করে-নিজস্ব সংগতি লাভ করে এবং সৌন্দর্য্যরে প্রকাশে উপযুক্ত হয়ে ওঠে। সত্তার প্রত্যেক অংশে গুরু তাকে বিভিন্ন ভাবে প্রকাশিত করে থাকেন। উচ্চতর অংশে শক্তি ভালবাসা ইত্যাদি রূপে প্রকাশিত হওয়ার পথ দেখান যাতে শরীর সত্তায় তিনি সৌষম্য ও সৌন্দর্য্য হিসাবে অভিব্যক্ত হন।
ধর্ম বাক্যাড়ম্বর নয়, অথবা মতবাদবিশেষ নয়, অথবা সাম্প্রদায়িকতা নয়। সম্প্রদায়ে বা সমিতির মধ্যে ধর্ম আবদ্ধ থাকতে পারে না। ধর্ম প্রেমিকের সাথে প্রেমাষ্পদের সম্মন্ধের মধ্যে নিহিত। ধর্ম কিরূপে দলে পরিণত হবে? সংখ্যাধিক্য হলেই কি মানুষ অধিক ধার্মিক হবে, অথবা উহার সংখ্যাল্পতায় কম ধার্মিক হবে? মসজিদ-মন্দির বা চার্চ-নির্মাণ অথবা সমবেত উপাসনায় ধর্ম হয় না, কোন গ্রন্থে, বচনে, অনুষ্ঠানে বা সমিতিতেও ধর্ম পাওয়া যায় না।
আসল কথা – অপরোক্ষানুভূতি। ধর্ম অনুরাগে, বাহ্য অনুষ্ঠানে নহে। হৃদয়ের পবিত্র ও অকপট প্রেমেই ধর্ম।
কোনও ব্যক্তি যে পথে চলতে ইচ্ছা করে তাকে সেই পথে চলতে দিতে হবে; কিন্তু যখন আমরা তাকে অন্য পথে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করি, তখন তার যা আছে, সে তাও হারাবে, সে একেবারে অকর্মণ্য হয়ে পড়বে। যে দেশে সকলকে একপথে পরিচালিত করবার চেষ্টা করা হয়, সে দেশ ক্রমশ ধর্মহীন হয়ে দাঁড়ায়। অতীতে বাংলাদেশে কখনও এরূপ চেষ্টা হয় নাই। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে কখনও বিরোধ ছিল না, অথচ প্রত্যেক ধর্মই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ কার্য-সাধন করে গেছে-সেইজন্যই এখানে প্রকৃত ধর্মভাব এখনও জাগ্রত। সকল ধর্মে আছে ভাল ভাল লোক, এ কারণেই সে সব ধর্ম লোকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে থাকে। সুতরাং কোনও ধর্মকেই ঘৃণা করা উচিত নয়।
আল্লাহ, ভগবান বা গডের নামে এত গন্ডগোল, যুদ্ধ ও বাদানুবাদ কেন? তাদের নামে যত রক্তপাত হয়েছে, অন্য কোনও বিষয়ের জন্য এত রক্তপাত হয় নি; কারণ সাধারণ মানুষ ধর্মের মূল উৎসে যায় না। সকলেই পূর্বপুরুষগণের কতকগুলো আচার অনুমোদন করেই সন্তুষ্ট থাকে। তারা চায় অপরেও তাই করুক। আত্ম অনুভূতি এবং উপলব্ধি না করে অথবা আত্ম বা গুরু দর্শন না করে ধর্ম-ধর্ম করার অধিকার কি মানুষের আছে? গুরুকে দর্শন করতে হবে; আত্মকে উপলব্ধি করতে হবে। জীবনের বর্তমান অবস্থায় ভয়ানক অশান্তি উপস্থিত হয়, যখন নিজের জীবনের পারিপার্শ্বকতার ওপরও আর মমতা থাকে না, যখন মিথ্যার ওপর ভয়ানক ঘৃণা উপস্থিত হয়, যখন প্রবঞ্চনার ওপর ভয়ানক বিতৃষ্ণা জন্মায়, তখনই ধর্মের শুরু হয় নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন