শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

সময়ের সাফ কথা…. সম্পর্কের স্বচ্ছতা

সময়ের সাফ কথা…. 

সম্পর্কের স্বচ্ছতা


সংলাপ ॥ মানুষ কি মানুষের সাথে সম্পর্ক করে? জীবন চলার পথে যাদের সংস্পর্শে বা সান্নিধ্যে একজন মানুষ যায় তাদের একজনের সঙ্গে কি সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যে সম্পর্ক অজর অমর! চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে কি সম্পর্ক হয়?
স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের স্বচ্ছতাও কি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে? না হলে সামান্য রোজগারের হিসেব নিতে স্ত্রী কোর্ট চত্বর পর্যন্ত দৌঁড়ে বেড়াচ্ছেন কেন? একটা সময় পর্যন্ত একজন নারী সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল থাকত একজন উপার্জনশীল পুরুষের ওপর। শুধু কি আর্থিক নির্ভরতা? বিশ্বাস, স্বচ্ছতা ও সাবলীলতা দিয়েই গড়া এই সম্পর্ক দু’জনের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
ক্রমশ নারীরা স্বনির্ভর হতে শুরু করলেও সম্পর্কের প্রতি সম্মান, স্বচ্ছতা বা গভীরতা তাদের কমেনি। এই জোরেই মহিলারা সংসার সামলালেও মাসে সংসার চালানোর খরচ বা টুকিটাকি প্রয়োজনে স্বামীর কাছ হাত পাতেন। এর বাইরে পরিবারেই কর্তাব্যক্তির ঠিক রোজগার কত তা জানার অধিকার বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশীয় পরিবারে এখনও সেভাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। বরং গৃহবধূদের অনেক সময় জবাবদিহি করতে হয় স্বামীর দেয়া অর্থ সংসারের কোন কোন কাজে ব্যয় হল।
এখন প্রশ্ন হল, এই উত্তর-আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর এমন ভাবনাচিন্তার বহিঃপ্রকাশ কি নারী অগ্রগতির নতুন ধাপ? নাকি স্বামী ও স্ত্রী’র ব্যবহারিক সম্পর্কের মৃত্যু ঘটছে? ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে চলেছে সম্পর্কের ভিত? কী ভাবছেন সমাজবিজ্ঞানীরা?
সমাজবিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, বাঙালি সমাজব্যবস্থায়, যে ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ সবটাই ছিল এবং আছে পিতৃতান্ত্রিক। মূলত কৃষি প্রধান অর্থনীতি। নারীদের সমানাধিকার ছিল না। ইংরেজ শাসন আসার পরে নগর, শহর পত্তন শুরু হয় এবং তারও পরে গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা, স্বাধীনতা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ হয়। ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থায় নারীদের অধিকার রক্ষা নিয়ে যে আন্দোলন ঘটেছিল তার একটা প্রভাব এই উপমহাদেশের জনমানসে পড়েছিল। ফলত নারীদের অবস্থানেরও অনেক পরিবর্তন ঘটে।
স্বাধীনতার পরবর্তী অবস্থায় মানুষ যত গণতান্ত্রিকতার দিকে এগিয়েছে ততই নাগরিক আইনের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হয়েছে এবং হচ্ছে। অর্থনীতিরও প্রভূত পরিবর্তন ঘটছে। সেই নিয়মানুসারে নারীরা সচেতন হচ্ছে, স্বাধীন হচ্ছে। তাই আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে প্রয়োজনে রাষ্ট্রের দ্বারা নির্ধারিত আইনের সুফল নিতে দ্বিধাহীনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। এটা শুধু নারীর স্বাধীনতা বা অগ্রগতিই নয়। অত্যাধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ফল। একথা কখনওই বলা যায় না যে, স্ত্রী রোজগার জানতে চাইলে সম্পর্কের ভিত আলগা হচ্ছে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা এ ধরনের প্রশ্ন করতে সাহসী হচ্ছে। সারা জীবনের সঙ্গীর কাছ থেকে কোনও কিছু লুকিয়ে রাখা, না বলা স্বচ্ছতাকে মলিন করে। এখন নারী তার অধিকার সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন। নানা উপায় ও পথ তার সামনে খোলা। স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজনে সেই সুযোগকে তারা ব্যবহার করছে।
বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতি যা, তাতে একজন নারী তার সুরক্ষার প্রশ্নে স্বামীর রোজগার জানতে চাইতেই পারেন। এতে অন্যায় কিছু নেই। স্বামী-স্ত্রী যুগলের বৈবাহিক জীবন সবসময় এক সুর তাল ছন্দে গাইবে এটা সবার কাম্য হলেও জীবন তো কোনও কোনও সময় বেসুরেও বাজে। বিবাহে বিচ্ছেদ ঘটে, সম্পর্কের অবনমন হয়। সে সব ক্ষেত্রে স্বামীর রোজগার সম্পর্কে স্ত্রী’র সম্যক ধারণা থাকলে সে যখন এই প্রশ্নে আইনের দ্বারস্থ হন তখন তার ন্যায্য অধিকার পেতে অনেক সুবিধা হয়। আর শুধু স্ত্রীই বা কেন? যদি দেখা যায় একজন স্বামী তেমন সুরোজগেরে নন অথচ স্ত্রী উচ্চপদে কর্মরতা সেক্ষেত্রে একজন স্বামীও তাঁর স্ত্রীর রোজগার বা পে স্লিপ জানতে বা দেখতে চাইতেই পারেন। আইন দু’জনের ক্ষেত্রেই সমান। তাই জানার অধিকার দু’জনেরই রয়েছে।
সাধারণত একটা স্বাভাবিক সম্পর্কে এ সবের কথা ওঠে না। আর সমস্যা যখন তৈরি হয় তার সমাধানও আইনে রয়েছে। যে কোনও খোলামেলা সম্পর্কে এটুকু জানা বা ওয়াকিবহাল থাকা তো আজকের দিনে দাঁড়িয়ে খুব জরুরি। একজন গৃহবধূও যদি হন, তিনি তো পুরোপুরি স্বামীর ওপর নির্ভরশীল। তাহলে তার নির্ভরতার জায়গাটা শক্ত করতে গেলেও তো জানা প্রয়োজন। আমরা যতই মুখে বলি যে টাকা পয়সা দিয়ে সম্পর্ক হয় না, কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না টাকা পয়সা কিন্তু সম্পর্কের মূল মেরুকরণ। বাস্তব এটাই। তাই স্বামীর রোজগার কত, তা জানতে চাইলে সম্পর্কের ভিত ক্ষয়ে যায় বা নষ্ট হয় না। পুরোটাই নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর।
পুরুষশাসিত সমাজে ছেলেরা রোজগার করবে মেয়েরা সংসার সামলাবে এমনটাই দস্তুর। মেয়েরা অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বামীর ওপর নির্ভরশীল ছিল। অতএব বৈষয়িক ব্যাপারে তারা একেবারেই অজ্ঞ। এখন মেয়েরা পরনির্ভরতা কাটিয়ে উঠছে। চিন্তাভাবনার পরিধিও বেড়েছে। মনীষিরা বলছেন নারীশিক্ষার প্রয়োজন। এর প্রসার না ঘটলে সমাজ এগবে না। নারীরা শিক্ষিত হচ্ছে। উপার্জনও শুরু করেছে। আজকের ডিজিটাল দুনিয়ার স্ত্রী তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে, অধিকার নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। সামাজিক মাধ্যম, পাড়াপড়শি, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নানান বিষয়ে আদান-প্রদান চলছে। স্বভাবতই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল বদল ঘটছে।
এখন মানুষ অনেক বেশি সন্দেহপ্রবণ। শুধু স্বামী-স্ত্রীই নন। পরিবারের ভেতরে বোন, ভাই, বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি অথবা বন্ধুদের মধ্যেও এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ধৈর্য কমছে। মানিয়ে নেব বা কোনও কিছু না থাকলেও চলবে এই ভাবনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সবকিছুতেই যেন বিদ্রোহের মনোভাব। কেন কিছু ছাড়ব-এ নিয়ে রাগ, বিদ্বেষ। এতে সম্পর্ক কলুষিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো টাকার অঙ্কটা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে সেরকম বড় বিষয় না থাকলেও আদালতে ছুটছে মানুষ। একটা সম্পর্ককে সহজভাবে নিয়ে চলার কথা মানুষ ভুলে যাচ্ছে। হয়তো অভাব নেই, তবু একান্ত প্রাপ্য কতটা সেটা জানার প্রত্যাশা আছে ।
অহংকার মানুষকে গ্রাস করে নিচ্ছে। শুধু স্বামী-স্ত্রীই নয়। রাস্তায়, ঘাটে, বাসে ছোট্ট জিনিসকে কেন্দ্র করে বড় ঝগড়ার রূপ নিয়ে নিচ্ছে। সহ্য ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। দুর্বলতা বাড়ছে। এসব থেকে মানসিক অবসাদ তৈরি হচ্ছে।
অপরদিকে, পুরুষ যে তিমিরে সেই তিমিরেই। নারীকে সে বন্ধু হিসেবে দেখে না, সহকর্মী হিসেবেও না, নারী কেবলই পুরুষের ভোগের সামগ্রী। আমরা কেউ কারও থেকে ছোট কিংবা বড় নই, আমাদের সকলের মধ্যে একই শক্তি বিরাজ করছে। প্রত্যেকেই যখন সমান শক্তি ও মর্যাদার অধিকারী হবে তখন কেউ কারও ভোগের সামগ্রী হতে পারবে না। এ কথাটা ঠিকমতো বুঝতে হবে। এখনও ভোক্তা ও ভুক্তভোগীর সম্পর্কের তিক্ততা যায়নি, নারী ও পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভদ্রতার বাতাবরণ তৈরি হয়নি।
পুরুষ কোনও দিনই নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার দেয়নি, দেবে না। করুনায় যেহেতু বাঁচা যায় না, অতএব নারীকে তার অধিকার ও মর্যাদা নিজের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এজন্য দরকার শিক্ষা, দরকার আর্থিক স্বাবলম্বন এবং নিজেকে বাঁচানোর উপযোগী শরীর ও উর্দ্ধমুখী চিন্তাজগৎ। ‘নারী তুমি অর্ধেক আকাশ’ বলে পুরুষ যতই সোহাগ করুক, নারী যতক্ষণ না শক্ত মাটির ওপর নিজেকে দাঁড় করাতে পারছে ততক্ষণ তার মুক্তি নেই।
লক্ষ্য করা যায়, সমাজে প্রতিষ্ঠিত মেয়েরাও পুরুষতন্ত্রের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। পিতৃপরিচয় ছাড়া তাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। নারী আন্দোলন তাহলে কথার কথা ছাড়া আর কী? নারীর স্বাধিকার যদি আকাশের চাঁদ, তবে এই সভ্যতা নিয়ে কীসের অহঙ্কার?
পরিশেষে একটাই কথা, খুব নিরুপায় না হলে সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে গেলে আইন আদালতের দোরগোড়ায় না যাওয়াই বোধহয় শ্রেয়। যৌথ দায়িত্ব, পারস্পরিক বিশ্বাস আর কর্তব্যবোধের বেড়া দিয়ে একটা নিটোল সম্পর্ককে বেঁধে রাখা যেতেই পারে। আপনাদের  কী অভিমত?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন