বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি.... ১৯


মানুষের সামর্থ্য খুবই সীমিত। ওই সীমিত পরিবেশের ভেতরে যে যতটুকু জানে, তাই নিয়ে বলতে পারে আমি যা জানি, বুঝি, তদনুযায়ী কাজ করছি; কোনো নিশ্চয়তা দেবার মতো বিদ্যে-বুদ্ধি আমার নেই। এ হ’ল স্পষ্ট স্বীকারোক্তি। জাগতিক জানা যে রকমেই হোক আর যতোই বেশী হোক না কেন কারুর পূর্ণ জানা নেই, থাকতে পারে না। খন্ড বিদ্যা, খন্ড চিন্তা দিয়েই আহৃত হয়ে থাকে, তাই তা চিরদিন থাকে না। প্রকৃত জানা অর্থাৎ পুরোপুরি জানার পথে অর্জন হয় জ্ঞান। এই জ্ঞান একটাই এবং তা কোন লক্ষ্য বা শ্রীগুরু বিষয়ক জ্ঞান, জানার যে প্রয়াস সেটার মধ্যে জ্ঞান অর্জনের পথে চলে হয় জ্ঞানবান, বাকী জানার মধ্যে কোন জ্ঞান নেই কারণ তা আজ আছে, কাল থাকবে না ও যেটুকু আছে সেটুকুও পূর্ণ নয়, একটা কথা হলো যে জানাটা আছে সেটা শুদ্ধ নয়, খুবই কম; আর দ্বিতীয়ত:, সেই কম জানাটুকুও কেউ চিরদিন রাখতে পারবে না, কারণ এ পৃথিবীতে কোনো খন্ড বস্তুই চিরদিন থাকে না, তাই ওই জানাটাও থাকবে না। 
খন্ড জানা কোন অবস্থাতেই পূর্ণ নয়, নিজের শ্রীগুরুতে নিষ্ঠা এবং নিমগ্নতায় , যখনি কাজ করা যাক না কেন সেটাই শুভ সময়। সেটাই শুভ কাজ। এছাড়া আর অতিরিক্ত শুভ সময় কিছু হয় না। 
প্রাণের গতি অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী বা বিষয়মুখী, দুই-ই হতে পারে। শ্রীগুরুর দিকে গতি হলে সাধন-সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যাপার বিনা চেষ্টায়ই সিদ্ধ হয়, বিনা চেষ্টায় প্রাণের সংযম আয়ত্ত হয়, বিনা চেষ্টায় হৃদয়গ্রন্থি ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য গ্রন্থি খুলে যায়, বিনা চেষ্টায় সুন্দর সর্বাঙ্গ সম্পন্ন ভাবে সিদ্ধি ঘটে এবং নিজেকে সরল রেখে কর্ম করতে কোন প্রকার বেগ পেতে হয় না। এ সব স্বাভাবিকভাবে আয়ত্ত হয়ে থাকে। 
যখন প্রাণের গতি বাইরের দিকে ধাবিত হয় অথবা পূর্ব সংস্কার বশতঃ বহির্মুখী, তখন ভিতরের কাজ করতে গেলে চেষ্টা করতে হয়। চেষ্টা সত্ত্বেও সব সময় কর্ম ঠিকভাবে সিদ্ধ হয় না। এই জন্য অন্তর্মুখ ও বহির্মুখ দুটি স্রোতে সংঘর্ষ উৎপন্ন হয়ে থাকে। প্রাণের গতিটি অন্তর্মুখ না হলে অধ্যাত্ম সাধনার ফল ঠিক ঠিক করা যায় না।
চেষ্টা করে কিছু করা বলতে ‘জোর করে করা’ বুঝতে হবে। বস্তুতঃ করা বলতে সর্বত্রই তাই; করা ও অভ্যাস স্বভাবের ধারার অন্তর্গত নহে। এটা হওয়ার ধারা নয়, স্বীকার করতে হবে; কিন্তু এরও সার্থকতা আছে। কারণ করতে করতে স্বভাবের গতি লাভ করা যায়। যতক্ষণ এটা না পাওয়া যায় ততক্ষণ এর উপকারিতা হৃদয়ঙ্গম হয় না, ততক্ষণ সাধন নীরস বলে প্রতীয়মান হয়। স্বভাবের ধারাতে প্রাণের গতি চালিত হলে, যেখানে থাকলে যখন যা প্রকাশ হবার তখন তা আপনিই হয়ে থাকে। করার পথে চিন্তার পরিবর্তন হয় না। করতে করতে স্বভাবের ধারাতে গেলে চিন্তার পরিবর্তন সিদ্ধ হয়। 
শ্রীগুরু শিষ্যের প্রাণের গতি বুঝে তাকে চালাতে পারেন। শ্রীগুরু কোন নির্দিষ্ট নিয়মের অনুসরণ করে চলেন না। যাকে চালাতে হবে, তার যোগ্যতা, রুচি, সংস্কার প্রভৃতি বিচার করে তাকে চালনা করেন। এজন্য অবস্থা অনুসারে প্রয়োজন বোধ করলে তিনি তাকে অগসর পথে চালনা করেন। কখনও তার প্রয়োজন অনুসারে অগ্রসর হতে না দিয়ে পেছনে টেনে নেন। উভয়ই শিষ্যের মঙ্গলের জন্য। তিনি ভবসাগরের কান্ডারী, শিষ্যের জীবনরূপী নৌকার কান্ডারি তিনি। তিনিই কর্ণধার। তিনি সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিসম্পন্ন অন্তর্যামী। তিনি শিষ্যের কল্যাণের জন্য যখন যে দিকে প্রয়োজন হয়, তখন সে দিকেই নৌকাকে চালনা করে থাকেন। শ্রীগুরুতে শিষ্যের প্রতিটা স্থানের প্রতিটা ব্যাপার সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বিদ্যমান থাকে। তাঁর স্বভাবের স্পর্শ প্রাপ্ত হতে না পারলে জীবনের গতি অনুকূল হয় না। যতক্ষণ স্বভাবের গতি প্রাপ্ত না হওয়া যায় ততক্ষণ পর্যন্ত আয়াস ও প্রয়াস উভয়ই থাকে।
চিন্তার শক্তি হতেই সর্বাপেক্ষা বেশি শক্তি পাওয়া যায়। বস্তু যত সূক্ষ্ম, শক্তিও ততই বেশি। চিন্তার নীরব শক্তি দূরের মানুষকেও প্রভাবিত করে, কারণ লক্ষ্য এক অর্থাৎ শ্রীগুরু এক, আবার বহু। সর্বব্যাপী এক অখন্ড সত্তারই প্রকার। বাহ্যিক জগৎ একটা ভ্রম, অর্থাৎ সত্য বস্তুর অসম্পূর্ণ প্রকাশ। সরলরেখাকে অনন্ত পর্যন্ত টানলে একটা বৃত্তই হয়। ‘আমি’ রহস্যের সমগ্র রূপ শ্রীগুরু।
মানুষের পবিত্রতা ও নীতিপরায়ণতায় ইচ্ছাশক্তি দৃঢ় হয় যা যথার্থ স্বরূপ প্রকাশ করে মনন ও ইচ্ছাশক্তিকে সতেজ করে তার নৈতিকতাকে। যা কিছু এটার বিপরীত, তাই দুর্নীতি। দেশভেদে ব্যক্তিভেদে এর মানও পৃথক। মানুষকে বিধিনিষেধ শাস্ত্রীয় কথার দাসত্ব হতে মুক্তিলাভ করতে হয়। ইচ্ছার কোন স্বাধীনতা নেই, কিন্তু যখন মুক্ত তখন ইচ্ছা স্বাধীন। সংসারকে এভাবে ছেড়ে দেয়ার নামই ত্যাগ। ত্যাগের ভাবে পূর্ণ হওয়া যায়। আমার দেহ ছিল, জন্ম হয়েছিল, আমি জীবন-সংগ্রামে লিপ্ত ছিলাম এবং মরে গেলাম: কি ভয়াবহ প্রহেলিকা! দেহের মধ্যে আবদ্ধ থকে মুক্তির জন্য কাতর ক্রন্দন!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন