শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমাদেরই কাজ : চারাগাছে পানি দেয়া


আমাদেরই কাজ : চারাগাছে পানি দেয়া
সংলাপ ॥ প্রচার, ধরপাকড়, জরিমানা কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না পথ দুর্ঘটনা। দিনের পর দিন রাস্তা যেন মরণফাঁদ হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে বেরনোর পর থেকে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত প্রিয়জনের পথ চেয়ে আতঙ্কের প্রহর গুনতে হয় আত্মীয়-পরিজনদের। অথচ, প্রতিদিন স্কুল-কলেজসহ অফিস-কাছারিতে তো যেতেই হবে। কিন্তু, যতক্ষণ ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী নিরাপদে না ফিরছে, ততক্ষণ যেন বুক ধড়ফড় করতে থাকে বাড়ির লোকের। কারণ, কিছু গাড়ি চালকের বেপরোয়া গতির নেশা। এই উদ্দাম-উচ্ছৃঙ্খল চালকদের জন্যই রোজ পথেঘাটে প্রাণ হারাচ্ছেন কত শত নিরীহ মানুষ, এমনকী সেই সব গাড়ির চালকরাও। বিশেষত, কিশোর-যুবকদের বিপদের ভয়ডরহীন ঝুঁকির প্রবণতাই আরও বেশি করে গ্রাস করে তরতাজা প্রাণ। সিনেমার নায়কদের মতো রেসের নেশা কিংবা অন্য গাড়িকে ধাওয়া করার মারণ খেলাই তাদের ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর দিকে। আর ঘরের ছেলের অকালমৃত্যুতে সব থেকেও পথের ভিখারি হচ্ছেন তাদের বাবা-মা’রা।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে যে, এর জন্য কি শুধুই পুলিশ-প্রশাসন দায়ী? বর্ষার ভিজে পথঘাট দায়ী? আমাদের নিজেদের কি কোনও দায়িত্ব নেই! উন্মত্ত ভোগবিলাসের যে জীবনধারা আমরা তৈরি করে ফেলেছি, পরিবারের অন্দরে অভ্যস্ত করে ফেলেছি তা কি কোনওভাবে দায়ী নয়? শুধু গতির বলি কেন, দামী মোবাইল না পেলে আত্মহত্যা, পড়াশুনার জন্য বকাঝকা করলে আত্মহত্যা, সামাজিক আন্তর্জালে অন্তরঙ্গ ছবি বা অশ্লীল ছবি পোস্ট করা ইত্যাদি বহু মানসিক ব্যাধিতে কি আমরা ‘অসুস্থ’ নই! আজ এই প্রশ্নটিই বড় হয়ে উঠছে আমাদের সমাজের সামনে, বিশেষত অভিভাবকদের কাছেও।
সামাজিক দিক থেকে এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, অত্যাধুনিক জীবনচর্যায় আমরা প্রত্যেকেই পরিবারে এমন একটা ভাবধারা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছি যে, আমাদের বেশ পয়সা আছে। যা জন্ম থেকে শিখছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। অত্যন্ত দরিদ্র ছাড়া অধিকাংশেরই সন্তান জন্ম নেয় মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত নার্সিংহোমে। পিতামাতার মনে একটাই চিন্তা থাকে, আমরা যে কষ্ট করে বড় হয়েছি, তার আঁচ যেন আমাদের সন্তানের গায়ে না লাগে। ফলে, শিশুর খাদ্যতালিকাও তৈরি হয় ডাল-ভাতের চেয়ে অনেক উন্নত। এছাড়া জন্মদিন পালনের মতো ছোটখাট অনুষ্ঠানের মধ্যেও তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়, বন্ধুমহলে খাটো হওয়ার কোনও কারণ নেই। এইভাবে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, রেস্তরাঁয় খানাপিনা, সবকিছুর মধ্যে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের ভাবখানা আমরাই তৈরি করে দিই। দুধের দাঁত পড়ার পরই হাতে তুলে দিই মোবাইল। আন্তর্জাল সংযোগ। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই স্মার্ট করে তুলতে শিখিয়ে দেয়া হয় দু’চাকা বা চারচাকা গাড়ি চালানো। তখন তো সে দুর্বার হবেই!
দ্বিতীয়ত, উপরের কারণগুলোর নেপথ্যে রয়েছে তরুণ সমাজের সামনে একাকিত্ব। যার প্রধান কারণ অণু-পরিবার। বড় হয়ে ওঠার দিনগুলোতে তাদের মনের ভাষা বোঝার মতো প্রিয় মানুষের গভীর অভাববোধ থেকেই তাদের মনে প্রবল হিংসা, হতাশা যা থেকে অবচেতনে উচ্ছৃঙ্খলতা জেগে উঠছে। আর তার অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে পাশ্চাত্য ভোগবাদ। বিভিন্ন ধরনের মাদক নেশার হাতছানি। অকালেই ঝরে যাচ্ছে আগামী সম্ভাবনা। অগাধ অ্যাডভেঞ্চারের নেশা, আমিও সব পারি এই মনোভাবের চ্যালেঞ্জ নিতে গিয়েই মৃত্যুকূপে পতিত হচ্ছে আমাদের ঘরের বাচ্চারা। শুধু বেপরোয়া গাড়ির গতির জন্য দুর্ঘটনাই নয়, বিরাট মনোজগতে অপরিসীম একাকিত্বকে জয় করতে না পারলে এভাবেই হয়তো আত্মহননের পথে পা বাড়াবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। এর জন্য পুলিশি ব্যবস্থায় কাজ হবে না। শিকড় থেকে চারাগাছকে শোধন করতে হবে। তবেই ভবিষ্যতে অমৃতফল ধরবে গাছে। আর এ কাজ করতে হবে আমাদেরই। আমাদেরই কাজ চারাগাছে পানি দেয়া।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন