শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

জয়-পরাজয়ের দোলাচলে

সময়ের সাফ কথা…. 

জয়-পরাজয়ের দোলাচলে


সংলাপ ॥ গভীর অনুশীলনের মাধ্যমে গবেষণা করলে দেখা যায় বাংলাদেশের বড় অংশের মানুষ নিজেদের সংস্কৃতি, ভাষা কিংবা ইতিহাসের প্রতি তেমন একটা সাংঘাতিক রক্ষণশীল নয়। বাংলাদেশের  নিজস্ব পতাকা তৈরি রয়েছে। মাঝেমধ্যেই বহিরাগত ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলে। সাইনবোর্ডে ভাঙাভাঙি চলে। ভাঙচুর হয়। বাঙালি অস্মিতা রক্ষা করতে হবে। প্রশ্ন হলো, এসবের মধ্যেই বাংলার সংস্কৃতি মোটামুটি একটা আঁচ পেয়ে গেছে যে আমাদের সামাজিক ধর্মপালনের পদ্ধতি জোর করে চাপাতে গেলে বিপদ আছে। হিতে বিপরীত হবে। ওই চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রবল সামাজিক প্রতিরোধ হতে পারে।
আজ পর্যন্ত কোনওদিন দেখা যায়নি দৈনন্দিন জীবনে বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরেও পরিপূর্ণ মর্যাদা দেয়া হোক এরকম কোনও দাবি নিয়ে কোন দল বা রাজনীতককে মাঠে নামতে বা সংসদেও উঠতে। কারণ ওসব ছোটখাটো বিষয় ভেবে রাজনীতিকরা পাত্তাই দেয় না। আর ঠিক এই আত্মঘাতী উদাসীনতার রন্ধ্র ধরেই ঢুকে পড়ছে বহিরাগত সংস্কৃতি প্রবলভাবে। ওই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বুঝেছেন বাঙালি নিজেদের স্বাতন্ত্র রক্ষায় প্রবল জেদী কিংবা যতœশীল নন। বরং ঢিলেঢালা।
এই যে বিবর্তন, সমাজ সংস্কার, ইংরেজি শিক্ষা, নোবেল প্রাইজ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, ফাঁসির পর ফাঁসি এসব সম্পর্কে বাঙালি উদাসীন। আমরা ওসব বরং ভুলে যাওয়ার তাগিদেই ব্যস্ত। বাংলার যে ধর্মীয় অথবা সাংস্কৃতিক ইতিহাস রয়েছে সেটির ওজন এতই বেশি যে আজকাল একটা বড় অংশের মানুষই সেটা গ্রহণ কিংবা অনুসরণ করতে ইচ্ছুক নন। দেশপ্রেমের আবহে কাউকে যদি কেউ স্মরণ করিয়ে দেয়, নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ নিয়ে কী লিখে গিয়েছিলেন সেটা দেখে নাও স্পষ্ট হবে। সেটা সমস্যা। কারণ তাহলে আবার খুঁজতে হবে, পড়তে হবে। তার থেকেও কঠিন হলো বুঝতে হবে। কেউ যদি বলে কুরআনকে হৃদয়ঙ্গম করলে বুঝবে যে যাকে তাকে শত্রু ভাবা চূড়ান্ত মূর্খামি। সেখানেও একই সমস্যা। তাই বার বার  পড়তে হবে। ছোট ছোট ঘটনার মাধ্যমে গভীর জীবনবোধকে আত্মস্থ করতে হবে। সে অনেক সময় ও কষ্টের ব্যাপার। তার থেকে বিনা আয়াসে যদি দলে ভিড়ে মিশে হুংকার দিতে বলা হয় এবং প্রতিপক্ষ তোমাকে এভাবেই ভয় পাবে বলে শিখিয়ে দেয়া হয় সেটা সুবিধাজনক।
অনেক রাজনীতিক এমনিতে বলে থাকেন তারা পশ্চিমী সভ্যতার বিরুদ্ধে। তারা বাঙালিত্বে বিশ্বাসী। আদতে কিন্তু তার লক্ষণ টের পাওয়া যাচ্ছে না। বরং তাদেরকেই সবথেকে বেশি পশ্চিমী সভ্যতার অনুসরণ করতে দেখা যায়। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে দেখা যায় উগ্র জাতীয়তাবোধকে উস্কে দিয়ে দেশ শাসনের একটা রীতি। সেই রীতি বা নীতি হল এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক শত্রু। শত্রু। অতিক্রিয় দেশপ্রেমের শাসনকালে সর্বদাই একটা বা দুটা শত্রুকে সামনে রাখতে হয় জনতাকে নিরন্তর খেপিয়ে রাখার জন্য।
উনবিংশ শতকে ব্রিটেনের ক্ষেত্রে এটি ছিল-যদি শুদ্ধ ব্রিটিশ হও তাহলে ইংরেজি বলতে হবে। ওয়েলস কিংবা গেলিকের মতো ইংরেজির উপভাষা বর্জনীয়। খাঁটি ব্রিটিশ হতে গেলে ধর্মে প্রোটেস্ট্যান্ট হতে হবে। ক্যাথলিক হলে সে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। আর প্রধান শত্রু হিসেবে সর্বদাই ফ্রান্সকে ভাবতে হবে। ফ্রান্সও ঠিক এই নীতিই নিয়েছিল। সেখানে উল্টো। তোমাকে ধর্মে ক্যাথলিক হতে হবে। ফ্রেঞ্চ ভাষা বলতে হবে। নর্মান্ডি বা ব্রিটানি অ্যাকসেন্টের ভাষা চলবে না। আর একমাত্র ব্রিটেনকে চরম ঘৃণা করলে তুমি প্রকৃত দেশপ্রেমিক।
পরবর্তী শতাব্দীতে এই একই জিনিস আরও বিপজ্জনকভাবে দেখেছি হিটলারের জার্মানীতে। মুসোলিনির ইতালিতে। সোজা কথায় ফর্মুলা হলো সেই একই। এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক শত্রু। ঠিক এই ফরমুলা নিয়েই কিন্তু জিন্না পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি তৎালীন পূর্ব পাকিস্তানে এসে বলেন পাকিস্তানী ও মুসলমান হতে গেলে উর্দু শিখতেই হবে। প্রধান শত্রু ভারত। সেই একই রীতি। আজকের ভ্লাদিমির পুতিন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক একই কাজ করছেন সূক্ষ্মভাবে। তাই আবার রাশিয়া বনাম আমেরিকার ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়েছে।
পড়শী দেশ ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির স্লোগান – হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান। শত্রু পাকিস্তান। আজও এই উপমহাদেশে সেই চেনা চেনা ধাঁচেই ব্যাপারটা যেন এগচ্ছে। এই ফর্মুলাটিরই একটা অন্য দিক হল অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে আরও বেশি করে ভিন্ন সংস্কৃতির আমদানি ঘটানো আর সেটিকে নানারকম জনপ্রিয় মোড়কে জনপ্রিয় করে তোলা। তাই আমাদের এখানে ধর্মীয় সন্ত্রাসের আগমন। এমন কিছু ধর্মাচরণের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছে, যে প্রক্রিয়াটি কয়েকবছর আগেও আমাদের সমাজে পরিলক্ষিত হয়নি। অথচ ধর্মাচরণ, তা প্রতিটি বাঙালি নিষ্ঠাভরে আবহমানকাল ধরেই পালন করে এসেছে নিজেদের মতো করে। যারা সমর্থন করছেন তাদের উদ্দেশ্যে ছোট্ট প্রশ্ন, আপনাদের পরিবারের পুত্রকন্যা, নাতি নাতনিকে কখনও কি বলেছেন – যাও বাছা মিছিলে যাও – যাও এমন কিছু করো যাতে গোলমাল বাঁধে। এটা দেশের স্বার্থে দরকার। না, আমরা কেউ বলিনি। কারণ আমাদের ছেলেমেয়ে নাতি নাতনিকে এসবের মধ্যে রাখতে চাই না। আমরা চাই তারা যত দ্রুত সম্ভব বাইরে চলে যাক। তার মানে এটা সর্বজনগ্রাহ্য কোনও জাতীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়। এর পিছনে ভক্তির তুলনায় আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম বেশি। রাজনীতির লড়াই রাজনীতি দিয়ে জিতলেই সেই জয় অনেক বেশি উপভোগ্য হয়। স্থায়ী হয়। তা না, রাজনীতির লড়াইটা আগেই হেরে গিয়ে অন্য পথ নিচ্ছে। বাঙালি হিসেবে আমাদের সামান্য লজ্জাবোধ হচ্ছে যে স্বজাত্যপ্রীতি অথবা সংস্কৃতিরক্ষার তাগিদ নেই বলেই আমাদের ভেবে নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। ধর্মীয় অন্যদেশী  সংস্কৃতির আগ্রাসী মানুষগুলো এবং তাদের দোষররা সমীহ করছে না, ভয় পাচ্ছে না। এটা ভাবছে না যে জোর করে কিছু চাপাতে গেলে আমরা এসব মেনে না নিয়ে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারি। বরং ভাবছে আমরা মেনেই নেব। এই যে আমাদের জাতি হিসেবে দুর্বল ভেবে অনেকটা হেয় করার প্রবণতা দেখানো হচ্ছে, এটাই আমাদের আসল হেরে যাওয়া নয় কি?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন