বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি…. (৪)

কর্ম হতে জ্ঞান অর্জনের পথে যাত্রা, যাত্রা পথে ভক্তি আসে এবং ভক্তি বহমান হয়ে বিরাজমান থাকে প্রেম রাজত্বে। জ্ঞান অর্জনের পথে তৃপ্তিরও সূত্রপাত। তৃপ্তিতে ভাবের বিকাশ এবং ভাবের বিকাশের জন্য দর্শনের আবশ্যক, দর্শনেই ভাবের উদয় হয় এবং তার জন্য সাধনা আবশ্যক।
সিঁড়ি অবলম্বন করে ছাদে উঠতে পারলে ওই সিঁড়ির প্রয়োজন যেমন আর থাকে না, তেমনি কর্ম্ম ও জ্ঞান অর্জনের পথ অবলম্বন করে প্রাপ্তি হলে প্রাপ্তির সৌন্দর্য সদা ও সর্বত্র বর্ত্তমান থাকে। শিষ্যের আপন গুরুই একমাত্র পথ। যে শব্দ গুরুর মুখ হতে শিষ্যের কানে ঢোকে, গুরুর কৃপায় সেই শব্দই চিন্ময় রূপে প্রকাশমান হয়। আত্মভাবে নিষ্ঠা জন্মিলে শিষ্যের সকল চেষ্টা অর্চনাতে পরিণত হয় এবং সকল বাক্যই জপের তুল্যতা লাভ করে। এই বর্ত্তমান রূপই অভিন্নভাবে স্থিত হয়। এই রূপের উদয় হলেই জগৎ আলোকিত হয়। এই রূপটি অতি গুপ্ত এবং সর্ব্বদা সর্ব্বত্রই পূর্ণরূরূপে প্রকাশমান থাকে, তথাপি আবরণে আবৃত বলে সকলের চোখে ধরা পড়ে না। বস্তুর স্বরূপেও স্ব-কল্পিত আবরণ আছে। অখন্ড সত্তার প্রকাশ না হওয়া পর্য্যন্ত আবরণ থাকে। আত্মদর্শনের পর দৃষ্টিগোচরীভূত আত্মস্বরূপকে লালন করা আবশ্যক। এতে দেশ ও কালের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এতে দশাগত, বর্ণগত, পরিমাণগত এবং লিঙ্গগত কোন ভেদ নাই। এটাই চিন্ময়, সর্ব্বরূপ ও সর্ব্বাকার।
কর্মযোগ একটা পথ। সেই পথ ধরে লক্ষ্যের দিকে চলতে হয় জ্ঞান অর্জনের জন্য। ভক্তিতে কোনো সাধনা-বিধি নেই। সাধনার পথের যাত্রীর যতো প্রকারের আধ্যাত্মিক অনুভূতি হয়, সেই অনুভূতিগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের, সর্বোচ্চ মানের অনুভূতিটাই হলো ভক্তি। জ্ঞান-কর্মের মাঝে নিরলস সেবায় নিমগ্নতা এবং অভ্যন্তরীণ শুদ্ধিকরণে সাধনার পথের যাত্রী ভক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হন। ভক্তিতে যখন তিনি প্রতিষ্ঠিত হন তখন তার আর কিছু বাকী থাকে না – ভাবেরও উদয় হয়।
শিষ্য গুরুকে অর্থাৎ পরমপুরুষ সত্যমানুষের সাথে একাত্ম হওয়ার জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে পথ চলেন যেহেতু তার চেতনার দিগ্বলয় থেকে গুরু দূরে রয়েছেন। পাবার চেষ্টা করছেন, তার সাথে চলবারও চেষ্টা করছেন। এখানেই গুরু সেবা সম্বল। সেবা করতে দূরে যেতে হয় না। শুরু হয়ে যায় ভক্তি – ভক্তির মান ও ভক্তির স্থান অনেক উচ্চে।
সাধক সংসারেই থাকুন, আর বনেই থাকুন, তাতে তাঁর দোষস্পর্শ হয় না। যেমন লোহার তলোয়ার স্পর্শমণি ছোঁয়ালে সোনার তলোয়ার হয়, আকার-প্রকার সেই রকমই থাকে, কিন্তু তাতে আর হিংসার কাজ চলে না; সেই রকম গুরুর চরণ লাভ করলে ভক্তের দ্বারা আর কোন সীমা অতিক্রমের কাজ হয় না। তারা কর্ম করতে গেলেই গুরুরভাবে বিভোর হয়ে যান। গুরু-সংসারে শিষ্য পানকৌড়ির মতো। পানকৌড়ি পানিতে থাকে, কিন্তু তাদের গায়ে পানি লাগে না; যদিও গায়ে একটু পানি লাগে, তা হলে একবার গা ঝেড়ে ফেললে তখনই সব চলে যায়। জাহাজ যেদিকে যাক না কেন কম্পাসের কাঁটা উত্তর দিকেই থাকে, তাই জাহাজের দিক ভুল হয় না; শিষ্যের চেতনা গুরুর দিকে থাকলে, তার কোন ভয় থাকে না। চকমকি পাথর শত বৎসর জলের ভেতর পড়ে থাকলেও তার আগুন নষ্ট হয় না, তুলে লোহাতে ঘসলেই আগুন বেরোয়। স্বীকৃত শিষ্য হাজার হাজার কু সঙ্গের মধ্যে পড়ে থাকলেও তার বিশ্বাস-ভক্তি কিছুই নষ্ট হয় না, গুরুর স্মরণে সে গুরু-প্রেমে উন্মত্ত থাকে। যে যেরূপ ভাবনা ক’রে ভাবে থাকে, তার সিদ্ধিও সেইরকম হয়ে থাকে। যে গুরুকে ভাবনা করে, সে গুরু-আনন্দময় হয়ে যায়।
বোধের উপর আস্থা রাখা শ্রেয়। বোধ হতে চৈতন্য বা আত্মজ্যোতি বা গুরু। বুদ্ধিকে অস্বীকার নয়, কিন্তু বুদ্ধির ক্ষমতা যে নিতান্তই সীমিত সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ না রাখাই ভালো। বোধ বর্জিত বুদ্ধিশাণিত কর্মসমূহের অসার নিদারুণ পরিণাম ব্যক্তিগত ও সমষ্টি জীবনে অহরহ দেখা যায়। বোধের আলো আনন্দ সমগ্র সত্তাকে প্লাবিত করে দেয়। বাইরের আকাশে যেমন সূর্যের আলো, অন্তরে তেমনই আলোর প্রতীক এই বোধই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি । গুরু বোধ চৈতন্যের আধার। তাঁর একটু ছোঁয়াতেই ব্যক্তি-সত্তা জ্ঞান, প্রেম ও আনন্দে বহমান দেহতরঙ্গ উথাল-পাথাল হতে থাকে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, সূর্য এক সেকেন্ডে যে তেজ তাপ আলো মহাকাশে ছড়িয়ে দেয়, পৃথিবী নিজের ২০০ কোটি বৎসরের জীবৎকালেও ততটুকু সূর্য্যকিরণের সদ্ব্যবহার নাকি করতে পারেনি। চৈতন্যসূর্যের ক্ষেত্রেও অনুরূপ অকল্পনীয় মহিমা ও বদান্যতা যা বুদ্ধি দিয়ে পরিমাপ অসম্ভব। বোধ প্রাপ্তির কোনোও ধরাবাঁধা পথ নেই। গুরু স্বীকৃত শিষ্যের হৃদয়াসনে জ্ঞান, প্রেম, আলো ও আনন্দের ঢেউ তুলে দিয়ে চলে যান, যে ঢেউ-র প্রভাব সেই বিশেষ শিষ্য-আধার বাহিত হয়ে যুগযুগ ধরে মানবজাতিকেও তার প্রসাদ বিতরণ করে চলে। সাধারণ মানুষও বোধের সাধনা করলে বোধিলাভ করতে পারে। যে কোনও সার্থক সৃষ্টি বা প্রাপ্তি অধ্যাত্ম জীবন, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, কাব্য, সাহিত্য, রজনীতি ইত্যদি যে কোন ক্ষেত্রেই হোক না কেন বোধের আবেশেই ঘটে, যুক্তিবুদ্ধির মাধ্যমে নয়। ঘটনার আগে-পরে যুক্তি-বুদ্ধি তদারকি বিচার বিশ্লে­ষণ ব্যাখ্যা করে মাত্র। বোধ ও বুদ্ধির এই পারস্পরিক সম্পর্কটি হলো বুদ্ধির কসরতের মূলে বোধির আলো। বুদ্ধির ক্রিয়া যান্ত্রিক, যে কোনও-কিছুর উপর ভিত্তি করে যা-কিছু একটা সিদ্ধান্ত দাঁড় করিয়ে দিতে পারা যায়। তাই বুদ্ধি কোন্ চিন্তা স্তরে উপর দাঁড়িয়ে বিচার করছে, সেটা আগে অনুভব করা দরকার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন