‘মানুষের চেয়ে বড়
কিছু নাহি
নহে কিছু মহীয়ান'
সংলাপ ॥ ২৭ আগস্ট - প্রেমের কবি, সাম্যের
কবি, মানবতার কবি, সাধক কবি নজরুলের মহাপ্রয়াণ দিবস। ১৯৭৬ সালের এই দিনে (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের
১২ ভাদ্র) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৭৬ থেকে ২০১৪ কালিক যাত্রায় কত কিছুই না হারিয়ে গেছে কিন্তু নজরুল
এমন এক নাম, এমন এক জীবন ও আদর্শ যা অম্লান ও জীবন্ত। শাশ্বত চেতনার ধারক হয়ে নজরুল
তাঁর অস্তিত্বকে রেখেছেন চিরঞ্জীব করে। নজরুল ছিলেন, আছেন, থাকবেন।
সাধক নজরুল কাব্যের উর্বর মাটিতে চালিয়েছেন চেতনার দুর্বার
লাঙল, ফলিয়েছেন'কালের ফসল'। সে ফসলে নিজের ভোগাকাঙ্খা মেটাতে উদগ্রীব হননি কখনো। বিলিয়েছেন
দু'হাতে, অকৃপণভাবে। কাব্যের রস আস্বাদন করে তিনি কাব্য-রসিকের হাতে তুলে দিয়েছেন অমৃতের
সুধা। শিল্প-স্রষ্টা নজরুলকে সেই সব রসিকেরাই রেখেছে স্মরণে, প্রাত্যহিকতায়। কেবল 'জাতীয়
কবি' বলে নয়, তাঁকে স্মরণ করতে হয় কালের প্রয়োজনে, আত্ম-অনুসন্ধানে, চেতনার উদ্বোধনে।
জীবন এবং বাস্তবতার ঝড়ো হাওয়ায় তিনি 'সত্যের
পাঞ্জেরী' হয়ে ধেয়ে চলেছেন গন্তব্যে। পথ হারাননি। বরং পথ-হারাদের দেখিয়েছেন পথের দিশা।
জাগরণের উদ্বোধনী সঙ্গীত বারবার বেজে উঠেছে তাঁর কন্ঠে। তিনি মুক্তি চেয়েছেন - নিজের
এবং মানুষের। বিশ্ব মানবতার জয়গানে তিনি আত্মনিবেদিত।
আয়ুষ্কাল বিচারে নজরুলের জীবন যতখানি বিস্তৃত, সৃষ্টিশীলতার
বিচারে তা আরো বহুগুণ সুদূর প্রসারী এবং যথার্থ মূল্যায়নের দাবিদার। সময়ের হিসেবে তাঁর
সৃষ্টি-কর্মের দৈর্ঘ্য যাই হোক না কেন, সেই সময়েই তিনি পেয়েছেন এবং দিয়েছেন বৃহতের
সন্ধান। সাহিত্যের সকল শাখায় শিল্প-সাধনার স্বাক্ষর রেখে তিনি আস্বাদন এবং প্রস্বেদন
করেছেন মানবতা। নিছক শিল্পের জন্য শিল্পের পূজারী ছিলেন না তিনি। তিনি গগণচারী শিল্পকে
টেনে নামিয়েছেন মাটিতে, গণমানুষের পায়ের কাছে। নতুন এক জয়ডঙ্কা বাজিয়েছেন তিনি বিপ্লবী চেতনায়। নিভৃতে
শিল্প সাধনার একাকীত্বকে এড়িয়ে তিনি গণ-মানুষের মাঝে একক হয়ে সাহিত্য-সেবায় নিজেকে
চিরভাস্বর করেছেন। এখানেই তিনি ব্যতিক্রম। তিনি নতুন পথের স্রষ্টা।
স্বতন্ত্র সাত্ত্বিকতায় তিনি জীবনের যে আদর্শ বিশ্ব মানবতার
জন্য তুলে ধরেছেন তা অনুসরণীয় অবশ্যই। সংগ্রামে এবং প্রেমে তিনি যে সুকঠিন ও সুকোমল
বৃত্তের পরিধি রচেছেন সেখানে আছে জীবনের স্পন্দন এবং মুক্তির বারতা। ভাঙা এবং গড়ার
মাঝে বার বার তিনি নতুনের সন্ধান দিয়েছেন। দু'হাতে ত্যাগের নিশান উড়িয়ে তিনি নিজেকে
করে গেছেন চিরন্তন। চির নতুনের মাঝে তাই তিনি চির বরণীয় হয়েই থাকবেন।
ভেতরে ও বাহিরে যার সমান বিস্তৃতি তিনিই পূর্ণাঙ্গ সত্তা।
নজরুলও তেমনই এক সত্তা। অর্থের বন্ধনী ভেঙে তিনি নিজেকে বিস্তৃত করেছেন 'অর্থপূর্ণ
এক জীবন্ত সত্তা' রূপে। সে সত্তায় যেমন আছে জাতীয়তাবাদ, তেমন আছে মানবতাবাদ। অসামপ্রদায়িক
এই সত্তার জীবন-দর্শন বর্তমানের জন্য একান্ত জরুরি। বিভেদের এই বিচূর্ণ সময়ের ধোঁয়াটে
মেঘ সরাতে সাম্যের নজরুলী আহ্বান এখন অতি আবশ্যক। বাংলার বুকে কার কন্ঠে ধ্বনিত হবে
সেই আহ্বান? এ প্রতীক্ষায় আছে বর্তমানের অস্থির সময়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন