মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৪

নবাব খেতাব ফিরে পেলো মীরজাফরের বংশধর

নবাব খেতাব ফিরে পেলো মীরজাফরের বংশধর

সংলাপ ॥ ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পর ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে ধিক্কৃত চরিত্র মীরজাফরকে মুর্শিদাবাদের মস্‌‌নদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন লর্ড ক্লাইভ। সেদিন বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই পরাধীন ভারতের গ্লানির দীর্ঘ অধ্যায়ের শুরু। ২৫৭ বছর পর এবার সেই মীরজাফরের বংশধরকেই মুর্শিদাবাদের নবাবের স্বীকৃতি ফিরিয়ে দিল স্বাধীন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর মুর্শিদাবাদের নবাবের স্বীকৃতি পেলেন আব্বাস আলি মির্জা।
গত বুধবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এবং বিচারপতি আর কে আগরওয়ালের ডিভিশন বেঞ্চের এই রায়ে আপাতত কিনারা হলো দীর্ঘদিন ধরে চলা এক আইনি ধাঁধার। ১৯৬৯ সালে কলকাতায় মারা যান মুর্শিদাবাদের শেষ নবাব ওয়ারিশ আলি শাহ। কিন্তু তার মৃত্যুর পর নবাবি খেতাব কে পাবেন তা নিয়ে আইনি লড়াই বাধে তার পরিবারে।
ওয়ারিশের এক ছেলে ইহুদি মহিলাকে বিয়ে করায় তিনি গোড়াতেই সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। এর পর মামলায় জড়িয়ে যান ওয়ারিশের দুই ভাই ফতেয়াব আলি মির্জা এবং কাজিম আলি মির্জা। নবাবের খেতাব দাবি করে মামলা চালাচ্ছিলেন ফতেয়াবের ভাগনে আব্বাস আলি মির্জা। 'মুর্শিদাবাদের নবাব' হওয়ার খবর পেয়ে তার প্রতিক্রিয়া, 'এই স্বীকৃতিটুকু আদায়ের জন্য বহু লড়াই করেছি। এই স্বীকৃতি আমার পূর্বপুরুষের আত্মাকে শান্তি দেবে'।
তবে আব্বাস আলির পূর্বপুরুষের ইতিবৃত্তকে বরাবর ঘৃণার চোখেই দেখেছে আপামর ভারতবাসী। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার হিসেবেই মীরজাফর নবাবি পেয়েছিলেন বলে মনে করেন দেশের অধিকাংশ মানুষ। তার পরিবারের এই আইনি লড়াই তাই গোড়া থেকেই ছিল নিঃসঙ্গ। সেই কথাই শোনা গেল আব্বাসের আত্মীয় রেজা আলি খানের গলায়। তার আক্ষেপ, হাজারদুয়ারির প্রাসাদের পাশে যে ওয়াসিম মঞ্জিলে বেড়ে উঠেছেন তিনি, সরকার সম্পত্তি দখলের পর সেই বাড়িতেই অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হয়েছে তাদের। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর হাজারদুয়ারির বিরাট প্রাসাদ, সংলগ্ন ইমামবাড়া, মতিঝিল, ওয়াসিম মঞ্জিলের মতো ঐতিহাসিক সৌধগুলোর দখল আদৌ তারা ফিরে পাবেন কিনা তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়।
বস্তুত এই মামলাকে ঘিরে একটা সময় কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতও চরমে উঠেছিল। সত্তরের দশকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মুর্শিদাবাদের নবাবের উত্তরাধিকারী কে তা জানতে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনসুর হবিবুল্লাহের উদ্যোগে রাজ্য সরকার এই মামলায় জড়িয়ে পড়ে। জ্যোতি বসুর বাম সরকার হাজারদুয়ারি-সহ মুর্শিদাবাদের নবাবের বিপুল সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে নেয়। সেই তালিকায় ঢুকে যায় কলকাতার চৌরঙ্গি এলাকার একটি বিশাল প্রাসাদ। জটিলতা রয়েছে ৮৫ পার্ক স্ট্রিটের কয়েক একরের বিশাল বাড়িটি নিয়েও। ইংরেজ শাসনে কলকাতা যখন ভারতের রাজধানী, তখন দেশের শাসকদের সঙ্গে দরবার করার জন্য ওই বাড়িটি তৈরি করেছিল নবাবের পরিবার। কিন্তু আটের দশকের গোড়ায় মামলার নিষ্পত্তি চেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারস্থ হন মীরজাফরের উত্তরসূরিরা। কেন্দ্রের রাজীব গান্ধীর সরকার তলে তলে তাদের নবাবি খেতাব ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে জেনে নিজের ক্ষোভ গোপন করেননি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে এর প্রতিবাদে কড়া চিঠিও লেখেন তিনি। তাতেও হাল ছাড়েননি মীরজাফরের পরিবারের সদস্যরা। একদিকে, নবাবির স্বীকৃতি অন্যদিকে মাথার উপর ছাদ থাকার অধিকারের দাবি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন তারা। রাজ্য সরকারের অধিগৃহীত সম্পত্তির সেই মামলার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বৃটিশ পার্লামেন্ট মীরজাফরের পরিবারকেই মুর্শিদাবাদের নবাবের স্বীকৃতি দেয়। সেই আইন বলে বছরে এক লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা ভাতা বরাবরের জন্য পাওয়ার দাবিদার হন তারা। কিন্তু সেই স্বীকৃতিও মুছে যায় ১৯৬৯-এর পরে। এতদিন পরে নবাবের আইনি স্বীকৃতি ফিরে পেলেন আব্বাস আলি মির্জা। কিন্তু পরিবারের কলঙ্কিত ইতিহাস কি আদৌ মুছতে পারবেন মুর্শিদাবাদের নবাব?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন