বুধবার, ২০ আগস্ট, ২০১৪

ধর্ম যার যার কিন্তু রাষ্ট্র কি সবার?

ধর্ম যার যার কিন্তু রাষ্ট্র কি সবার?

সিদ্ধার্থ ॥ বরাবরই জন্মাষ্টমী উপলক্ষে সমাবেশে বক্তারা বলে থাকেন - 'ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার'। এবারও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ কথাটি উঠে এসেছে। গত রোববার সকালে সিরাজগঞ্জে আয়োজিত এক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও বলেছেন - 'ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার'। নাসিম বলেন, 'জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মহানায়ক। '৭৫-এ ওরা জাতির জনক ও তার পরিবারকে হত্যা করে দেশটাকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করেছিল। কিন্তু জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবারো বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে পরিণত করা হয়েছে। ধর্ম যার যার এবং রাষ্ট্র সবার  এ দীক্ষায় আমরা সবাই এদেশে বসবাস করবো'। 'এদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে দাঁড় করানোই বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লক্ষ্য' - একথা উল্লেখ করে নাসিম বলেন, 'এ অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাতে দলমত ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে সহযোগিতা করতে হবে।'
ধর্ম সম্বন্ধে রাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব বন্ধ করাটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ন্যূনতম দাবি। '৭১-এ সাধারণ মানুষের আকাঙ্খা ছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে সকল ধর্ম ও ধর্মপালনকারীদের প্রতি সম-আচরণ করা হবে। রাষ্ট্রে ধর্ম থাকবে তবে রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকবে না। অর্থাৎ, রাষ্ট্র কোন ধর্মের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না, রাষ্ট্র তার ধর্ম সম্বন্ধে নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে, মানুষের কর্মকাণ্ড এবং সিদ্ধান্তগুলো বিশেষত রাজনীতিক সিদ্ধান্তগুলো, তথ্য এবং প্রমাণের উপর নির্ভর করবে, কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নয়। বলাই বাহুল্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে মানুষের সে আশা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশের রাজনীতিকরা ধর্মকে ব্যবহার করেন হাতিয়ার হিসেবে। ধর্ম যখন রাজনীতিকদের হাতিয়ার হয়ে যায় তখন ধর্মের ভয়াবহ রূপ ধরা পড়ে মানবসমাজে উগ্র ধর্মান্ধতা হয়ে। রাজনীতিকরা সর্বদাই ধর্মকে ছলে-বলে-কলে কৌশলে এমনভাবে মোড়ক দিয়ে রেখে আসছে যাতে সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মের আসল রূপ 'শান্তি' ও 'সত্য' না বেরিয়ে পড়ে। তাই ধর্মের প্রগতিশীলতা মেহনতী মানুষের হাতিয়ার হতে পারেনি, এখনও পারছে না। বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৌদি ইসলামের ধর্ম-ব্যবসায়ী, ধর্মবেত্তারা এমনভাবে ঢুকে পড়ে মিথ্যাচারের প্রভাব বিস্তার করে বসে আছে যাতে মনে হয় রাজনীতিকরা আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। রাজনীতিকরা শ্রমজীবী মানুষকে ধর্মের দোহাই দিয়ে, মিথ্যাচারের মাধ্যমে ধর্মের নামে ব্যবসার জাল বিছিয়ে শোষণ এবং শাসন করে যাচ্ছে। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে উঠতি রাজনীতিক লুটেরা শ্রেণী। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ আজ বাংলাদেশের রাজনীতিকদের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে এমন এক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে, যে কোন সময় বিস্ফোরণ হতে পারে।
রাজনীতির মূল বিষয়টি হচ্ছে ক্ষমতা। যখন ক্ষমতার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয় তখন উদ্ভব ঘটে সাম্প্রদায়িকতার। সাম্প্রদায়িকতায় ধর্ম চলে যায় রাজনীতির অধীনে, তখন হানাহানি অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমাদের এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার অনাচার আমরা অতীতে দেখেছি, এখনো দেখছি। কেবল উপমহাদেশে কেন, বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই তো এখন সাম্প্রদায়িকতার তাণ্ডব চলছে। ক্রুসেড ও জিহাদের ঘটনা অতীতের  মতো একালেও বিদ্যমান। ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে ফিলিস্তিনবাসীকে উচ্ছেদ করে ধর্মরাজ্য কায়েম করার প্রচেষ্টা এখনও চলছে।
রাজনীতিতে ধর্ম আসে, ধর্মের স্বার্থে নয়, রাজনীতিকদের বস্তুগত স্বার্থে। ক্ষমতায় যাবার জন্য এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা ধর্মকে ব্যবহার করে। সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বিরোধের মূল কারণটি রাজনৈতিক, যার সঙ্গে রাষ্ট্র জড়িত থাকে। সে জন্যই রাষ্ট্রের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া আবশ্যক। রাষ্ট্র হচ্ছে নাগরিকদের স্বার্থরক্ষার প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র সব নাগরিককে সমান চোখে দেখবে - এটিই প্রত্যাশিত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব নাগরিকের ভেতর অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করবে - এমন অঙ্গীকার বেশ জোর গলায় ব্যক্ত করা হয়ে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্র তা মান্য করে না। রাষ্ট্রমাত্রেই রাষ্ট্রশাসকদের স্বার্থ দেখে।
আমরা স্বীকার করি বা না করি এ নিয়ে কোন বিতর্কের অবকাশই নেই যে ধর্ম যার যার। 'যত কেল্লা তত আল্লাহ'। সৃষ্টিকর্তা এক এবং অদ্ধিতীয় কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সমন্ধে প্রত্যেক মানুষের ধারণা এক নয়। জগতের প্রত্যেক মানুষ যেমন অনন্য তেমনি প্রত্যেক মানুষের ধর্মবোধও অনন্য। প্রত্যেকেই নিজের ধর্ম নিজে ধারণ, পালন করে। সুতরাং ধর্ম অবশ্যই যার যার। কিন্তু রাষ্ট্র কি সবার? বর্তমানে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি কার?
সত্য হলো - বাংলাদেশ সবার নয়। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দলের। রাষ্ট্রে যতক্ষণ শ্রেণীবিভক্তি থাকে ততক্ষণ রাষ্ট্র সবার হতে পারে না, তা নির্দিষ্ট শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার কাজেই ব্যস্ত থাকে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে ধনিক শ্রেণী রাষ্ট্রের সমস্ত হাতিয়ার - যেমন, আমলাতন্ত্র, বিচার ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রচার মাধ্যমসহ সমস্ত কিছু নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহার করে থাকে। ধনিক শ্রেণী ছলে ও বলে নিজেদের মুনাফা আহরণের পথকে কণ্টকমুক্ত রাখতে শ্রমজীবী মানুষসহ যে কোনো নিপীড়িত শ্রেণীর প্রতিরোধকে দমন ও দিক্‌ভ্রান্ত করে।
বাস্তবতা হলো এই যে, আধুনিক বিশ্বে পুঁজির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, ইউএনডিপি, ডিএফআইডি, ইউএসএইড থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এই বিশ্বব্যবস্থার ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করছে। আধিপত্যশীল শক্তি হিসেবে এখন ধর্মের ভূমিকা প্রান্তিক। বস্তুত ধর্মকে কেবল শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক ব্যবহার করা হয় ক্ষমতার ভীতকে পাকাপোক্ত করার জন্য। সেটা যেমন মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতার চেহারায় হতে পারে তেমনি তা ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা - এমনকি উগ্র ধর্মবিরোধিতার রূপ নিয়েও আসতে পারে। পুঁজির সার্বভৌমত্বে অবস্থান করে রাষ্ট্র ও ধর্ম নিয়ে কথাবার্তা কোন রাজনৈতিক কিংবা ধর্মতাত্ত্বিক তাৎপর্য বহন করে না।  রাজনীতিকরা ধর্মকথা বলেন কেবল নিজেদের স্বার্থে।

রাজনীতিকদের দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রকে সবার করা। রাষ্ট্রে সকল মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। এখনও সময় আছে - মিথ্যাচার ছেড়ে দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য রাজনীতিকরা রাজনীতি করুন। ধর্ম যার যার আছেই এ নিয়ে আপনাদের না ভাবলেও চলবে, রাষ্ট্রটাকে সবার করুন। নচেৎ শ্রমজীবী মানুষের বিস্ফোরণ অনিবার্য হয়ে উঠবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন