বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৪

প্রেম থেকেই আসে একত্বের অনুভূতি



প্রেম থেকেই আসে একত্বের অনুভূতি

সিদ্ধার্থ ॥ আধ্যাত্মিকতা মানে জীবন সম্বন্ধে সচেতনতা - সত্য, সুন্দর, আনন্দ ও প্রেমের উপলব্ধি। আধ্যাত্মিক সাধক শাস্ত্রীয় বিধি বিধান নয় বরং নিজের সুক্ষ্ম-চেতনা দ্বারা জীবনের যাবতীয় কর্ম নির্বাহ করেন। সাধকদের উপর বাহ্যজগতের রীতি-নীতি কিংবা প্রথা আরোপ করতে গেলে নিজেকে আবিষ্কার করার প্রচেষ্টা ব্যাহত হয়। বাহির থেকে আরোপিত চাপে সূক্ষ্ম-চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আত্মা সূক্ষ্ম-চেতনারই অপর নাম।
আত্মাকে জানার মাধ্যমে নিজের মধ্যে স্রষ্টার প্রকাশ ঘটে। পক্ষান্তরে আনুষ্ঠানিক ধর্মের আচার অনুষ্ঠান ও শাস্ত্র চর্চা নিয়ে যারা ব্যস্ত থাকে তারা স্রষ্টাকে জীবন যাপনের প্রেরণা হিসেবে উপলব্ধি করে না। তাদের স্রষ্টা থাকেন কোটি কোটি মাইল দূরে কল্পিত কোন স্থানে। যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে তথা সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টাকে উপলব্ধি করে না, শাস্ত্র তাকে পথ দেখাতে পারে না। ধর্মের নামে যতটুকু আনুষ্ঠানিকতা তারা করে তার উদ্দেশ্য নরকের ভয় আর স্বর্গের লোভ। ভয় এবং লোভ তা পার্থিব হোক কিংবা অপার্থিব, উভয়ই আত্মবিকাশের পথে বাধা।
যে চর্চা করতে চায় সে এটা ওটা জানতে চাইবে। কিছু একটা পেতে চাইবে। সে আলোচনা করবে এবং শুনবে। লিখবে, পড়বে কিন্তু নিজ জীবনে তা বাস্তবায়িত করবে না। ফলে তাদের কোন উপলব্ধিই হবে না। তারা কেবল খুঁজতে থাকবে কিন্তু পাবে না কিছুই। সত্য খুঁজলে কোথাও পাওয়া যাবে না। সত্য হতে হবে। জ্ঞান অনুশীলনের মাধ্যমে, চর্যার মাধ্যমে অর্জিত হয়।
যে চর্চা করে সে কেবল পানির কথা চিন্তা করে, তৃষ্ণা অনুভব করে কিন্তু নিবারণ করে না। যে চর্যা করে সে জল সন্ধান করে নিয়ে আসে পান করে এবং তৃষ্ণা নিবারণ করে। সত্য সম্পর্কে কেবল চিন্তা করলে, সত্য চাইলে কিংবা পড়লে, শুনলে পাওয়া যায় না। সত্য পাওয়ার জিনিস নয়। সত্যের কেনা বেচা হয় না। সত্য হওয়ার জিনিস।
সাধকের জীবনে ভয় ও লোভের কোন স্থান নেই। সাধক সত্য, সুন্দর, আনন্দ ও প্রেমের অনুভূতিতে সিক্ত। তার জীবনের সকল কর্ম সম্মাদিত হয় প্রেমের পরশে। প্রেম এবং সত্য কোন তথ্য নয় যে শাস্ত্র চর্চার মাধ্যমে জানা যাবে। প্রেম এবং সত্য হলো আত্মজ্ঞান। ভয় এবং লোভের প্রকার ও প্রকৃতির শাস্ত্রীয় বর্ণনা কেবল অজ্ঞতাই বৃদ্ধি করে। আমরা যতই সত্য নিয়ে ভাবতে থাকি ততই সত্য থেকে বিচ্যুত হই। সত্য খোঁজার কোন প্রয়োজন নেই। সত্য হলো এখন। যা এখন এবং এখানে আছে একমাত্র তা-ই হলো সত্য। সত্যের খোঁজে আমরা এখন এবং এখান থেকে চলে যাই তখন এবং ওখানে। এখন যা আমাদের সামনে আছে, যেমনভাবে আছে কেবল তাই সত্য। যা কিছু আমাদেরক এখন ও এখান থেকে দূরে নিয়ে যায় তা সত্যকে উপলব্ধি করার প্রতিবন্ধক।
সবকিছুর মতো সত্যের অন্বেষণকেও মানুষ সস্তা বিনোদনে পরিণত করেছে। বেশিরভাগ মানুষই প্রেম ও সত্য চায় না। মানুষ স্ফূর্তি চায়, বিনোদন চায়, উত্তেজনা চায়, তথ্য চায় এবং এসবেই তুষ্ট হয়। তাই মানুষ পত্রিকা পড়ে, সিনেমা দেখে, টিভি দেখে, বিতর্ক করে। ধর্মের নামে জলসা, গান-বাজনা, কিংবা সভা-সমাবেশ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমরা সবাই এসব করে থাকি কিন্তু যখন এসবকেই জীবনের কেন্দ্র বানিয়ে ফেলি তখন নিজেই নিজের মধ্যে সংকোচিত হতে থাকি, মরতে থাকি।
আনুষ্ঠানিকতা ধর্ম নয়। ধর্ম হলো সত্যকে ভালোবাসা, সুন্দরকে ভালোবাসা, ভালোবাসাকে ভালোবাসা, প্রত্যাশাহীন ভালোবাসা। যে সত্য ও সুন্দরকে ভালোবাসে সে ভালোবাসার আনন্দ সাথে সাথেই পেয়ে যায় এজন্য মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। সত্যকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই সাধক ভালোবাসেন তাঁর স্রষ্টাকে আর স্রষ্টাকে ভালোবাসার মাধ্যমে জীবনকে। জীবনকে ভালোবাসার জন্যই আমরা জীবন প্রাপ্ত হয়েছি। আর জীবনকে ভালোবাসি বলেই আমরা বেঁচে আছি।
প্রকৃত অর্থে প্রেম কোন ভালোলাগা, আরাম লাগা নয়। ভালোলাগা, আরাম লাগা ইত্যাদি কামেরই নানা প্রকার মাত্র। যা মানুষকে ক্রমে হতাশার দিকে নিয়ে যায়। যেখানে প্রেম আছে সেখানে কাম চরিতার্থতা অনিবার্য নয়। প্রেমের উপস্থিতিই সন্তুষ্টি লাভের জন্য যথেষ্ট। একমাত্র সেই ব্যক্তিই প্রেম করতে পারে যে আবেগ, ভাবাবেগ, উদ্বেগ, উত্তেজনা, সন্দেহ ও ভয় থেকে মুক্ত। একমাত্র সেই প্রেম বুঝে যে প্রেমাস্পদের কাছে সমর্পিত। সত্য জানার কোন প্রয়োজন নেই। কাকে ভালোবাসি তা না জেনেও প্রেমভাবে থাকা যায়। এ প্রকার প্রেম থেকেই আসে একত্বের অনুভূতি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন