মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৪

সময়ের সাফ কথা .... উপদেশে কোন কাজ হয় না

সময়ের সাফ কথা ....
উপদেশে কোন কাজ হয় না

আরিফিন হক ॥ আমরা সর্বত্রই দেখতে পাই, একে অন্যকে উপদেশ দিচ্ছে -'সৎ হও, ভাল হও'। সম্ভবত পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ নেই যাকে উপদেশ দেয়া হয়নি -'সদা সত্য কথা বলিবে','মিথ্যা কহিও না','চুরি করিও না' ইত্যাদি। কারণে-অকারণে উপদেশ শুনতে শুনতে উপদেশ গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। এখন গুরুত্বপূর্ণ উপদেশও কেউ আর শুনতে চায় না, মানা তো দূরের কথা। শুধু তা-ই নয়, উপদেশ শুনলে অনেকেই চটে যায়, বিরক্ত হয়। তারপরও অবশ্য উপদেশদাতার কোনো ঘাটতি নেই।
কোনো প্রেমিক প্রেমাস্পদের কাছ থেকে উপদেশ চায় না, চায় ভালোবাসা। কোনো ভিক্ষুকও উপদেশ শুনতে পছন্দ করে না, সেও ভিক্ষা চায়। শুধু প্রেমিক বা ভিক্ষুকই নয়, উপদেশ কেউই পছন্দ করে না। কিন্তু ট্র্যাজেডি হলো, আমাদের সমাজে সবাই শুধু উপদেশ দিতে চায়। উপদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে ধর্মবেত্তা, রাজনৈতিক নেতা, ফতোয়াবাজ, অভিভাবক, বুদ্ধিজীবী, বন্ধু, এমনকি বয়সে যারা ছোট তারাও কম যায় না। আমাদের সমাজ জুড়ে কেবলই উপদেশ-দাতা, জীবনের প্রতি পদে পদে কেবল উপদেশ আর উপদেশ। এটা করো না, ওটা করো, ওভাবে করো না, এভাবে করো না। উপদেশ কেউ মানে না তবু আমরা একে-অপরকে উপদেশ দিয়েই যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। উপদেশ কোনো কাজে আসে না, তারপরও মানুষ কেন যে সুযোগ পেলেই উপদেশ দেয়, এ বিষয়ে গবেষণা হতে পারে। মানুষের জীবনের অসংখ্য রহস্যের মধ্যে উপদেশ দেয়ার বাতিকটাও একটা বড় রহস্য বটে। মানুষ কেন উপদেশ দেয় আবার কেনই বা কেউ কারো উপদেশ মানতে চায় না, এসব রহস্য ভেদ করা জটিল। সম্ভবত উপদেশ দানের মূল কারণটি হলো - প্রত্যেক মানুষই নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। সে যা জানে-বোঝে, অন্য কেউ তার ধারে কাছেও নেই - এমন একটা ভাব বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই কাজ করে।
সূফী সাধক আনোয়ারুল হক বলতেন -'যে উপদেশ চায় তাকে পারলে কিছু টাকা দিয়ে দিবেন আর যে টাকা চায় তাকে কিছু উপদেশ দিয়ে দিবেন।' আমরা না বুঝলেও, আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী এ বাণীর তাৎপর্য বুঝে ফেলেছে। তাই এখন দাতারা টাকার চেয়ে বেশি দেয় উপদেশ। আমরা দাতাদের কাছ থেকে টাকা চাই, ঋণ-অনুদান-সাহায্য চাই কিন্তু আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা এখন আমাদের দেশে এসে দিয়ে যায় কেবল উপদেশ। তাদেরকে জানিয়ে দেয়া উচিত যে,  আমাদের দেশে মন্ত্রী থেকে যন্ত্রী, বুদ্ধিজীবী থেকে পকেটমার, রিক্সাওয়ালা থেকে সচিব সবাই উপদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে সমান দক্ষ। আমাদের আর যা কিছুরই অভাব থাকুক না কেনো, উপদেশের কোনো অভাব নেই। কাজেই আমাদের ও জিনিসের কোনো দরকার নেই। আমাদের টাকার অভাব। তাই টাকা চাই, উপদেশ চাই না।
অনেকেই আমাদের কাছে উপদেশ চায়, কেবল কানচুলকানির বিকল্প হিসেবে। কাউকে উপদেশ দেওয়ার আগে উপদেশ দাতার প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে সে প্রকৃতই উপদেশ চায় কি-না তা উপলব্ধি করা। যদি প্রকৃতই কেউ উপদেশ চায় তবে তাকে তাড়াহুড়ো করে  উপদেশ না দেয়া ভালো। আমরা হয়তো ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই দ্রুত উত্তর দিতে পারি। কিন্তু, সেটা কি আসলে বিজ্ঞতার কাজ হবে, বিশেষভাবে যদি আমরা এমন একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করি, যে-বিষয়ে আমরা খুব ভালোভাবে গবেষণা করিনি?
প্রেমময় ও যুক্তিযুক্ত উপদেশ মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। উত্তম উপদেশ দেয়া হলে তা স্থায়ী ফল উৎপন্ন করতে পারে। উত্তম উপদেশ দেয়ার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই যিনি উপদেশ চাচ্ছেন, তার পরিস্থিতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে হবে। পরিস্থিতি সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান না থাকলে আমরা হয়তো এমন উপদেশও দিতে পারি, যা একজন ব্যক্তিকে আরও বিভ্রান্ত করে দিতে পারে। সুতরাং যে কোন বিষয়ে উপদেশ কিংবা কোন প্রস্তাব উপস্থাপন করার আগে তা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সময় নেয়া দরকার। শুধুমাত্র ভালো উদ্দেশ্য থাকাই যথেষ্ট নয়।

অন্যদের হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা না করাই উত্তম। কোন ব্যক্তির উপর কখনও এমন ভার অর্পিত হয় না যা বহন করার যোগ্যতা সে রাখে না। যে ব্যক্তি উপদেশের প্রয়োজন অনুভব করে শেষ পর্যন্ত তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় উপদেশ সে গ্রহণ করবে কি না। জ্ঞানবানদের বাক্য মালবাহী পশুকে চালিয়ে নেয়ার জন্য ব্যবহৃত সূচালো লাঠির মতো। সূচালো লাঠির আঘাতে কষ্ট ও ক্ষতি স্বীকার করে যে যতদূর পথ অতিক্রম করেছে তার কাছে ততটুকু পথের খবরই আছে। উপদেশের সীমাও ঐ টুকুই। সীমালঙ্ঘন না করাই শ্রেয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন