শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৩

সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন শাহ্‌ কলন্দর গউস পাক



সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন শাহ্‌ কলন্দর গউস পাক

বৃহত্তর ময়মনসিংহে আজকের কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর থানার কোল ঘেঁষে বহমান নদী ব্রহ্মপুত্র। এ নদীর পাড়ে নির্জন এক গ্রাম ফরিদপুরে সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন শাহ্‌ কলন্দর গউস পাক-এঁর আবির্ভাব ১৮৭২ সন হতে ১৮৭৫ সনের মধ্যে। অগ্রহায়ণ মাসের ২৩ তারিখে সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন এঁর জন্মদিন পালন করা হয়। তাঁর পিতা ছিলেন মরহুম মোজাফ্‌ফর সরকার। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন ছিলেন সবার বড়। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন সত্যবাদী ও ভাবুক প্রকৃতির।
গ্রামে তাঁর সমবয়সীদের সাথে বেশি মেলামেশা না করে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে তিনি পছন্দ করতেন। তাঁর পিতা, সন্তানের উদাসীনভাব দেখে নরসিংদী জেলার গকুলনগর গ্রামে ভূঁইয়া বাড়িতে জনাব আলী ভূঁইয়ার মেয়ের সাথে তাঁর বিবাহ দেন। সংসার জীবনে তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু শৈশবেই এক মেয়ে ও এক ছেলে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এবং এক মেয়ে তাঁর ওফাতের প্রায় দুই বছর আগে বিদায় নেন। সন্তান জন্মের পর সাধারণত মানুষ বেশি উৎসাহ নিয়ে ধন-সম্পদের মালিক হতে চেষ্টা করে কিন্তু সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন ছিলেন ঠিক তার উল্টো। সাংসারিক জীবন তাঁর কাছে অর্থহীন ও উদ্দেশ্যহীন বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
শৈশবে কুলিয়ারচর থানার ওসমানপুর নামক গ্রামে ওসমানপুর মক্তবে (বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়) তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর তৎকালীন আসাম প্রদেশের (বর্তমান সিলেট জেলা) কোন এক মাদ্রাসায় কিছুদিন শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায়। এনট্রান্স পাশ করার পর তিনি সাব রেজিষ্টার পদে চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু চাকরি ও দুনিয়াদারীর মোহ তাঁকে আকৃষ্ট করতে না পারায় চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে মুসাফির জীবন বেছে নেন এবং বিভিন্ন দরবার, মাজার ও আস্তানা শরীফে ঘুরে বেড়ান। তিনি মিরপুর শাহ্‌ আলী বোগদাদী (র.) - এঁর মাজার শরীফে বেশ কিছুদিন কাটান তবে উল্লেখযোগ্য সময় কাটান নারিন্দার শাহ্‌ আহসান উল্লাহ্‌ (র.) -এঁর দরবারে। এখানে তিনি ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে কিছুদিন শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু শিক্ষকতাও তাঁকে বেঁধে রাখতে পারেনি। আবার ফিরে গেলেন মুসাফিরের জীবনে। ঘুরতে ঘুরতে তিনি উপমহাদেশের সূফী সাধনার মহীরূহ হযরত আজানগাছী (রঃ) এঁর দর্শন পেলেন। হযরত আজানগাছী তাঁর ভাবজগতে টেনে নিলেন হযরত আবু আলী আক্তার উদ্দীনকে। হযরত আজানগাছীর হাক্কানী তত্ত্বকে আঁকড়ে ধরে শুরু হয় তাঁর সাধনার জীবন। অতঃপর ১৮৯৫ সনের দিকে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। গভীরভাবে নিমগ্ন হলেন সাধনায়। বেশির ভাগ সময় তাঁকে একাকী অথবা কবরস্থানে পাওয়া যেত। ঐ সময় তিনি নারায়ণপুর গ্রামে ৫/৬ বছর অবস্থান করেন। তাঁর বয়স যখন ৩৫-৩৬ বছর তখন তাঁর স্ত্রী বিয়োগ হয়। তিনি সংসারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হলেন। পেশা জীবন, সংসার জীবন, আত্মীয়-পরিজন - কোনো কিছুই তাঁকে মোহাবিষ্ট করেনি। সংসারের চাকায় পিষ্ট হয়নি তাঁর জ্ঞানক্ষুধা। কারণ, তিনি জেনেছিলেন জ্ঞানই সত্য বাকি সবই মোহ-মায়া।
কোন কিছুই তাঁকে আকৃষ্ট করে দুনিয়াদারির মধ্যে নিমজ্জিত করে রাখতে পারেনি। ভাবের সাগরে ডুব দিলেন তিনি। সত্যের সন্ধানে তিনি মুসাফির হয়ে গৃহত্যাগ করেন। তিনি কঠোর সাধনা ও রিয়াজতপূর্ণ জীবনযাপন করে সমাজে আদর্শ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। নদীর কিনার ধরে হাঁটা, কবরস্থানে অবস্থান, সারা রাত্রি দু-পায়ের উপর ভর করে বসে থাকা অবস্থায় কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের সমসাময়িক বিশ্লেষণ তাঁর সাধনা জীবনের অন্যতম দিক। সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন যখন অবস্থান নিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার  কুলিয়াচর থানার কান্দুলিয়া নামক গ্রামে তখন তাঁকে ঘিরে জমায়েত হতে থাকে অসংখ্য সাধারণ মানুষ। আম গাছের নিচে কুঁড়েঘরে বাঁশের মাচার উপর ছিল তাঁর অবস্থান। দিনে-রাতে হাজার মানুষের আনাগোনা হতো সেখানে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তাঁর কামালিয়াত। কান্দুলিয়া গ্রামের নামে তিনি খ্যাত হন কান্দুলিয়ার মৌলভীনামে। এভাবেই চলে যায় দীর্ঘ ১২ বছর। যে-ই তার দরবারে যায় খালি হাতে ফিরে না। ত্যাগের আদর্শে চলতে থাকে ইসলাম প্রচার, মানবতার কল্যাণে।
সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন এঁর সাধনার বয়সকাল ছিল প্রায় ৮৫ বছর। তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে ত্যাগের মাধ্যমে সত্যের পথ চলার বাস্তব দিকগুলো তোলে ধরেছিলেন। সৎস্বভাব আর ত্যাগের মাধ্যমে তিনি মানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁর মনোনীত অনুসারীদের মাঝেও, যাতে পরবর্তীতে তাঁরাও সমাজে একই আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
ধর্ম মানবতার জন্য এ আদর্শ তাঁর কর্ম ও আচরণে প্রকাশ হয়ে ঝড়ের বেগে প্রবাহিত হতে থাকে বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে। তাঁর চাঁদোয়ার নিচে জড়ো হতে থাকে মুক্তি পাগল কিছু যুবক যাঁরা আজও সাধনার জগতে অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরই আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে। তন্মধ্যে সুলতানুল আউলিয়া আলহাজ্ব হযরত শাহ্‌ কলন্দর সূফী খাজা আনোয়ারুল হক্‌ ছিলেন অন্যতম, যিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন চাঁন্দপুর শরীফে। সূফী সাধক শাহ্‌ আবদুর রহমান সব সময় সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন এঁর সঙ্গে সঙ্গেই থাকতেন।
সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন প্রতিদিন ফরিদপুর গ্রাম থেকে হেঁটে বাজিতপুর থানার সরারচর বাজারে যেতেন। নিঃশব্দে সামনের দিকে হাঁটতেন তিনি। তাঁর পিছনে হাঁটতো ভক্তরা। কোনো শব্দ নেই, কারো দিকে ভ্রুক্ষেপ করবার সময় তাঁর নেই। রাস্তার বাইরে কিছুই দেখতেন না তিনি।  ফসলের ক্ষেত, চাষীদের আনাগোনা, ঘর-গৃহস্থীর নিত্য জীবন কোনও দিকে তার নজর থাকতো না। তিনি পথ চলতেন আপন মনে। প্রতিদিন ছাব্বিশ মাইল পথ হাঁটতেন তিনি। তাঁর এই ক্লান্তিহীন হাঁটার দৃশ্য রাস্তার দুপাশের মানুষ দাঁড়িয়ে দেখতো। কারণ, তাঁর এই হাঁটা হঠাৎ একদিনের প্রয়োজন মেটাতে ছিলো না। এ ছিলো তাঁর জীবনকর্ম, সাধনার কর্ম। ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের ফরিদপুর গ্রামের নিভৃত পল্লীর অফুরন্ত সবুজের মেলায় তিনি নিজেকে খুঁজে ফিরছিলেন। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-হেমন্তের প্রতিটি প্রভাতেই তিনি পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেছেন ছাব্বিশ মাইল পথ। সাধনার এ কঠিন পথ তিনি ধরে রেখেছিলেন মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত।
দীর্ঘ ছাব্বিশ মাইল হাঁটার পথে তিনি ক্ষুধার্ত হয়েছেন কিংবা কোথাও বিশ্রাম নিয়ে খাদ্যগ্রহণ করেছেন এমনটা প্রত্যক্ষদর্শীদের নজরে নেই। তবে সরারচর পোষ্ট অফিসের সামনে একটি কাঁঠাল গাছের নিচে তিনি বসতেন। চা খেতেন। পোষ্ট অফিসের কর্মচারীদের প্রতিদিন তারিখ ও সময় জিজ্ঞাসা করতেন। সরারচর পোষ্ট অফিসের সকল কর্মচারীরা তাঁর সান্নিধ্যে আসেন। উপস্থিত জনসাধারণ, ভক্ত, আশেকানদের কথা শুনতেন, তারপর এক সময় উঠে আবার যাত্রা করতেন ফরিদপুর গ্রাম অভিমুখে। দিনের হাঁটা শেষ করতেন তাঁর আস্তানায় এসে। সামান্য টিনের চালাঘর তারই বারান্দায় দুপায়ের উপর বসে রাত পার করতেন। উঠানে, আঙ্গিনায় শত শত মানুষ বসে থাকতো। তিনি বসে থাকতেন দুই হাঁটুর মাঝে নমিত মাথায়। কথা বলতেন আপন মনে, কার সাথে কেউ জানে না।
সূফী সাধাক আবু আলী আক্তার উদ্দীন দেহত্যাগ করার ৩/৪ বছর আগে যখন ফরিদপুর হতে সরারচর বাজার পর্যন্ত তিনি হাঁটতেন, তখন তাঁর বয়স ছিল প্রায় ১০৭।  তাঁর বয়সের কথা চিন্তা করে ভক্তরা একটা রিক্সা আনেন এবং তাঁর সমীপে আর্জি পেশ করেন রিক্সায় উঠে যাতায়াত করার জন্য। সূফী সাধক এ আর্জি গ্রহণ করেন। অতঃপর প্রতিদিন তিনি রিক্সায় উঠে বসলে ভক্তরা রিক্সা টেনে টেনে নিয়ে যেতেন। বেশিরভাগ সময়ে পথিমধ্যে ডুমরাকান্দার বাজারে চা খেতেন এবং কিছু সময় ব্যয় করতেন এ বাজারের আশেপাশে।
সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যার আগে যখন তাঁর ভক্তদের নিয়ে ফরিদপুর গ্রামে পৌঁছাতেন তখন আরম্ভ হতো আর এক মহোৎসব। সরকার বাড়ির বৈঠকখানা ঘরটিই ছিল তাঁর দরবার। বারান্দায় তিনি বসতেন। টিনের ঘর। ভিতরে ছিল একটা চৌকি পাতা। কোন সময় বিশ্রাম নেয়ার প্রয়োজন মনে করলে অথবা ভক্তদের কাছ থেকে দূরে থাকার প্রয়োজন মনে করলে তিনি ঐ চৌকিতে শুয়ে বিশ্রাম নিতেন। অবশ্য এক সঙ্গে ৪ ঘন্টার বেশি কোনদিনই তিনি বিশ্রাম নেননি তাঁর সাধনা জীবনে। এছাড়াও কোনো কোনো সময় বারান্দায়, যেখানে তিনি বসতেন সেখানেই, মাতৃগর্ভে শিশুরা যেভাবে থাকে সেভাবে শুয়ে তিনি বিশ্রাম নিতেন। তাঁর বসার জায়গায় বিছানো থাকতো কাঁথা, যা ছিল তার আসন। বারান্দা ছিল উঠান হতে খুব বেশি হলে ছয় ইঞ্চি উঁচু। আসনের সামনের উঠানে দুটা ইট একত্রে রাখা থাকত। প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে পৌঁছে তিনি ইটের উপর দাঁড়াতেন আর ভক্তরা তাঁর পায়ে পানি ঢালা আরম্ভ করত। ওই পানি ভক্ত ও মকসুদিরা হুড়াহুড়ি করে পান করত আর কেউবা গায়ে মাখত, যার যার নিয়ত করে এবং অপার মহিমা এই যে, বেশির ভাগ লোকের সৎ নিয়তগুলো পূরণ হতো। তাই প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া অনুধাবন করা খুব কঠিন যে, সূর্যাস্তের সময় এ দরবারে প্রতিদিন কী দৃশ্যের অবতারণা হতো।
অতঃপর পা ধুয়ে বারান্দায় তাঁর আসনে উঠার সময় ভক্তদের মাঝে প্রতিযোগিতা শুরু হতো কে গামছা দিয়ে তাঁর পা-মুছে দেবে। এ সময় তাঁকে শিশুর মত মনে হতো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন নির্বিকার। আসনে দু-পায়ের উপর উবু হয়ে বসতেন। তখন চতুর্দিকে আগরবাতি ও মোমবাতি জ্বালিয়ে পরিবেশটাকে ভাবগম্ভীর করে তুলতো ভক্তরা। সবাই উঠানে বসে পড়ত। তখন আরম্ভ হতো তাঁর তাত্ত্বিক আলোচনা। কার সঙ্গে তিনি আলোচনা করতেন একমাত্র তিনিই জানেন। তবে ভক্তদের মধ্যে যারা একনিষ্ঠভাবে শুনতেন, তারা জ্ঞানের সন্ধান পেয়েছেন। যখন কোন ভক্ত বা মকসুদি কোন জিনিস তাঁর সামনে নজরানা হিসেবে দিতেন, তখনই তিনি উপস্থিত সবার মধ্যে তা বিলি করে দিতেন। যদি কারো আনা খাবার পছন্দ হতো তাহলে অনেক সময় তিনি তিন আঙ্গুলের সাহায্যে তিনবার কিংবা সাতবার মুখে তুলে খেতেন এবং বাকীটা ভক্তদের দিতেন। সারারাত্রি একইভাবে কাটাতেন। মাঝে মাঝে সারারাত্রির মধ্যে ১/২ কাপ চা খেতেন। ফজর পর্যন্ত চলতো এভাবে। অতঃপর আবার হাঁটা শুরু হতো।
এক সময় ভক্ত ও আশেকানদের সাথে আয়েন-বয়েন-যায়েনএই ছিল তাঁর কথোপকথন। একজন মানুষ জ্ঞানজগতের কোন্‌ স্তরে অবস্থান করলে মাত্র তিনটি শব্দের মধ্যে বেঁধে দিতে পারেন তাঁর ভাষা ব্যবহার শক্তিকে। আয়েন-বয়েন-যায়েন’ - এর বাইরে কথা বলাকেও তিনি হয়তো শক্তির অপচয় বলেই মনে করতেন। তিনি জ্ঞানজগতের অসীমতায় এতই নিমগ্ন ছিলেন যে, জ্ঞানহীন জগতে অনর্থক বাক্য ব্যয়ের অপচয় থেকে নিজেকে রক্ষা করাই ছিল তাঁর বিধান।
প্রতি ওয়াক্তে আজান হতো। সবাইকে পাশের ঘরে উঠানে সালাত করার তাগিদ দিতেন। কিন্তু কেউ তাঁকে স্বশরীরে সালাতে দাঁড়াতে দেখেননি। তাই কিছু তথাকথিত শরীয়তি মানুষ তাঁকে সন্দেহ করতে থাকে। তারা সূফী সাধকের বিরুদ্ধে চক্রান্তে মেতে ওঠে, নানা ফতোয়া দিতে থাকে এমনকি কাফেরআখ্যা দিতেও  তারা দ্বিধাবোধ  করেনি। কিন্তু তিনি ছিলেন নিশ্চুপ।
তাঁর ইসলাম ধর্মের মর্মের প্রতি আহ্বান এতে বাধাগ্রস্থ হয়েছে কিন্তু থেমে থাকেনি। শরীয়ত চর্চায় যে বিদ্যা লাভ করা যায় তা ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধিজাত, গ্রন্থাদিতে লিপিবদ্ধ বিদ্যা। কিন্তু মারিফাত স্তরে সাধক যে জ্ঞান লাভ করেন তা অতীন্দ্রিয় প্রজ্ঞাজাত দিব্যজ্ঞান। মারিফাতের এই জ্ঞানের স্তরে অবস্থান করলে সাধারণের ধারণা হতে পারে যে, সাধক শরীয়ত উপেক্ষা করছেন। সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন এঁর ক্ষেত্রেও ঘটেছিল ঠিক তাই।
তথাকথিত শরীয়তি আলেম সম্প্রদায় জনসাধারণের কাছে এমনকি তাঁর ভক্তদের মধ্যে ফ্যাসাদ সৃষ্টির জন্য উঠে পড়ে লাগেন। এক শুক্রবার সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন তাঁর দরবারে বসে আছেন এমন সময় কতিপয় তথাকথিত আলেম দুপুর ১২টার দিকে তাঁর কাছে আসেন এবং তাঁর সাথে অবস্থান করতে থাকেন। জুম্মার নামাজের সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তারা সাধককে প্রশ্ন করলেন - হুজুর আপনি জুম্মার নামাজ পড়লেন না। আমরা তো আপনাকে পরীক্ষা করার জন্য এসেছি। তাহলে আপনি কি শরীয়ত মানেন না? সাধক নিশ্চুপ। ভক্তদের মাঝে গুঞ্জন। দরবারে আনুমানিক ৩/৪ শত ভক্ত-মকসুদির উপস্থিতি ছিল। সবাই পরিস্থিতি দেখছে। এভাবে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় কেটে গেল। দেখা গেল দুজন ভক্ত মুসুল্লি গ্রামের মসজিদে নামাজ পড়ে দরবারের দিকে আসছেন একজনের মাথায় ধামাতে ভাত ও অন্যজনের মাথায় হাঁড়িতে তরকারি। তারা দরবারে এসে প্রথমেই সাধকের কাছে ক্ষমা চাইলেন দেরি হওয়ার জন্য। ভক্তদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার   কি? তাদের মধ্যে একজন বললেন - হুজুর আমাদের সাথে নামাজ আদায় করার পর হুকুম দিলেন - দরবারে মেহমান আছে কিছু খাবার আনলে’ -এ কথা বলে তিনি চলে আসেন। মেহমানদের জন্যে আমাদের খাবার আনতে গিয়ে একটু বেশি দেরি হয়ে গেছেএ কথা শুনে তথাকথিত আলেমরা হতবাক। সাধক তাদেরকে আপ্পায়ন করে বিদায় দিলেন। এরপরও তাঁকে সরারচর যাওয়ার পথে বহুবার বাধা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে।
সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন তাঁর ৮৫ বছরের সুদীর্ঘ সাধনা জীবনে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন ব্যক্তি জীবনে সত্য বলা ও সত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ধর্ম মানবতার জন্য, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের জন্য নয়’ - এই মন্ত্র ধারণ করেই তিনি হয়েছিলেন ধার্মিক। মহানবী (স.)-এঁর জীবন দর্শনই মূর্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর গোটা জীবনে।
১৯৮৩ সালের ৪ জ্যৈষ্ঠ তিনি দেহত্যাগ করেন। এ পৃথিবীতে যে সমস্ত সাধক সত্য ও মানবতার জন্য নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন এবং আল্লাহ্‌র রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদেরকে মৃত মনে করা উচিত নয়। কেননা তাঁরা একমাত্র আল্লাহ্‌রই উদ্দেশে তাঁদের নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। তাই তাঁরা শারীরিকভাবে পর্দার অন্তরালে গেলেও আধ্যাত্মিকভাবে চিরঞ্জীব থাকেন। দুনিয়ায় অধিষ্ঠিত মানুষ ধন-দৌলতকে প্রাণের মতই ভালবাসে এবং সে কারণে মৃত্যুকে অত্যন্ত ভয় করে, অপর পক্ষে সাধকগণ আল্লাহ্‌র পথে যাত্রা করে এমন এক অফুরন্ত জ্ঞানভান্ডারের অধিকারী হন যার সমকক্ষ কিছুই হতে পারে না। সেরূপ অফুরন্ত  জ্ঞানভান্ডারের অধিকারী সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন কালোত্তীর্ণ এক মহাপ্রাণ।
সূফী সাধক হযরত আবু আলী আক্তার উদ্দীন -এঁর আদর্শকে বহন করে তাঁর প্রধান খলিফা সূফী সাধক আনোয়ারুল হক হাক্কানী মিশন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর ও গ্রামে হাক্কানী খান্‌কা শরীফ ও আস্তানা শরীফ প্রতিষ্ঠিত করেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন