শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৩

রাজনীতিতে চলছে নীতি লালন-পালনের আকাল



রাজনীতিতে চলছে
নীতি লালন-পালনের আকাল

আরিফিন হক নির্বাচন এগিয়ে আসছে, অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজনীতি এর মূল কারণ বাংলাদেশে রাজনীতি নেহাতই ক্ষমতা-কেন্দ্রিক জনস্বার্থ সংরক্ষণ করা অর্থাৎ দরিদ্র্য নির্যাতিত মানুষের কল্যাণ করা, মানুষকে শিক্ষিত করা, সমাজের নানা স্তরে বিরাজমান পশ্চাৎপদতাকে দূরীভূত করা এখন রাজনীতির লক্ষ্য নয়  দেশ জনগণের স্বার্থ নয়, ব্যক্তি বা দলের স্বার্থই এখন রাজনীতির মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে তাই বাংলাদেশের সচেতন মানুষ এখন রাজনীতির প্রতি এক বিতৃষ্ণা মনোভাব পোষণ করতে শুরু করেছেন অথচ এদেশেই একটা সময় ছিল যখন গণমানুষের রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি একটা গভীর মমতা ছিল রাজনীতিবিদরা তখন ছিলেন নিঃস্বার্থ গণমুখী চরিত্রের মানুষ একসময় দেশের মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতিতে আগ্রহী ছিল আর আজ মেধাবীরা রাজনীতির ধারে কাছে ঘেষতে চায় না যে রাজনীতি সন্ত্রাসের জন্ম দেয়, জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে না, সে রাজনীতিতে মেধাবীদের আগ্রহ থাকার কথাও নয় বটে
রাজনীতি আজ যেন এক ব্যবসায়ী পণ্যে পরিণত রাজনীতি করলে বাড়ি হয়, গাড়ি হয়, বিস্তর সম্পদের মালিকানা অর্জন করা যায়, প্রয়োজনমতো লোককে খুন করিয়ে দেয়া যায়, থানা-পুলিশ এবং ক্ষেত্র-বিশেষে আইন-আদালতকেও কিনে নেয়া যায়, এমন আরো কতো কি? যেসব রাজনীতিক বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিকানা অর্জন করে চলেছেন তাদের প্রায় সকলেরই বৈধ উপার্জনের কোনো নিশানা নেই তারা দিব্যি ভোটে দাঁড়াচ্ছেন- আইনে কালো টাকার মালিকদের ভোটে দাঁড়ানো নিষিদ্ধ হলেও তাদের ক্ষেত্রে আইন কার্যকর হচ্ছে না তারা অবশ্য কোনো না কোনো ব্যবসায়ে জড়িত বলে কাগজপত্র দেখাচ্ছেন ভোটে বিজয়ও তাদের সুনিশ্চিত কারণ তারা টাকা দিয়ে কিনে নেন জিতবার সুপরিচিত মার্কা মন্ত্রিত্বও যেন কিনে নেয়া, তাই দেশ-বিদেশ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হলেও তাদের মন্ত্রিত্ব যায় না দেশের  সাধারণ মানুষ এসব দেখে-শুনে সমগ্র রাজনীতির প্রতিই আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছে
আমাদের দেশে ক্ষমতার স্বার্থে উপেক্ষিত হয় জনস্বার্থ রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে তারপর আর জনস্বার্থের দিকে নজর দেয় না নেতারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় বেছে নেন দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন আর ষড়যন্ত্রের পথ জনস্বার্থের ওপরে ব্যক্তিস্বার্থকে স্থান দেয়ায় ধ্বস নামে জনসমর্থনে তাই পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভের জন্য ক্ষমতাসীনদের নিতে হয় কূটকৌশলের আশ্রয় কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, এসবে কোন কাজ হয় না জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করায় পরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে পারে না কেউ অথচ কোন রাজনৈতিক দল যদি ক্ষমতায় এসে জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিত, তাহলে জনগণ নিশ্চয়ই এর মূল্যায়ন করত কূটকৌশলের প্রয়োজন হতো না আমাদের নেতারা যদি অতীত থেকে কিছু শিখতেন!
আমাদের দেশে রাজনীতিকরা ভোটের আগে জনগণের কাছে আবেদন জানান যেন তাকে ভোট দিয়ে দেশ দশের সেবা করার সুযোগ দেয়া হয় যে রাজনীতিক ভোটে প্রার্থী হয়েছেন তার আসল উদ্দেশ্যটা কি? সেটা কি দেশ দশের সেবা না-কি ক্ষমতা? দেশ দশের সেবা করার জন্য কি ক্ষমতা অপরিহার্য? ক্ষমতায় না গেলে কি মানুষের সেবা করা যায় না? ক্ষমতা কি মানুষকে সেবাপরায়ণ করে? ক্ষমতার সাথে সেবার সম্পর্ক কি? ‘ক্ষম তাড়িত যাহাতেসে ক্ষমতাবান যার ক্ষমতা আছে সে ইচ্ছে করলে ক্ষমা করতে পারে আবার ইচ্ছে করলে শাস্তিও দিতে পারে ক্ষমা করার যোগ্যতা যার নেই সে অক্ষম অন্যদিকে, আমি থেকেসে’-কে যে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তিনি সেবক সুতরাং সেবার সাথে ক্ষমতার কোন সম্পর্ক নাই সে = অস্তিত্ব দিশাগ্রস্ত থাকে যাহাতে যারা জনসেবার নাম করে জনগণের ভোট চায় আসলে তাদের উদ্দেশ্য জনসেবা নয় তাদের উদ্দেশ্য ক্ষমতা তুমি আমাকে ভোট দিয়ে এমন ক্ষমতা দাও যেন আমি তোমাকে শাস্তি দিতে পারি এটাই মূল কথা তোমার ভোটটা আমার প্রয়োজন দেশ দশের সেবা করার জন্য নয়, সেটা উপলক্ষ্য মাত্র; আসল লক্ষ্য হচ্ছে নিজের বিত্ত ক্ষমতা-প্রতিপত্তি বাড়ানো
সেবার জন্য ক্ষমতা নয় মমতার প্রয়োজন মম মানে আমার, মমতা হচ্ছে মম তারণের আধার মমতা হচ্ছে একটা বোধ বোধের প্রথম পর্যায় হচ্ছে অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট হিসেবে উপলব্ধি উপলব্ধি থেকে যখন কষ্টবোধটি আমিত্ববোধের অন্তর্গত হয় তখন তাকে মমতা বলে মমতার মধ্যেআমার আমারবোধ থাকে না থাকেআমি আমিবোধ কোন ব্যক্তি, জীব বা বস্তুর প্রতি আমার বোধ যখন প্রত্যাশাহীনভাবে প্রকাশিত হয় তখন তাকে বলে মমতা ক্ষমতা এবং মমতার অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে যার মধ্যে মমতাবোধ জাগ্রত হয়েছে সে ক্ষমতার দিকে যাবে না আর যার মধ্যে ক্ষমতার লোভ ক্রিয়ারত আছে তার মধ্যে মমতাবোধ থাকবে না
রাজনীতিকদের মমতা নেই  তারা শৃগালের মতো ধূর্ত এবং সিংহের মতো হিংস্র  সুতরাং, ‘দেশ দশের সেবা করার সুযোগ দিন’, ‘আমাকে ভোট দিয়ে জনসেবার সুযোগ দিন’ - বলে ভোটারদের হাত-পা ধরা, পা ছুঁইয়ে দোয়া নেয়া, বিনয়ে অবনত হওয়া ইত্যাদি ভোট আদায়ের কৌশল মাত্র দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ইত্যাদি অধিকাংশ রাজনীতিকদের বাহিরের আবরণ মাত্র আসলে এরা ভেতরে ভেতরে লালন করেন ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা, অধৈর্য, লোভ রাজনীতি এখন হয়ে উঠেছে ক্ষমতা বিত্তের আধার রাজনীতির আশ্রয়ে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিত্ত প্রতিপত্তির সম্প্রসারণ সহজ হচ্ছে, তাই সুযোগ সন্ধানীরা নামছে রাজনীতির মাঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ধনী ব্যবসায়ী, প্রাক্তন সেনাপতি, আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, উপাচার্য, ব্যাংকার সবাই এখন রাজনীতির মাঠে খেলোয়াড়
রাজনীতি এখন নীতি মূল্যবোধের সংকটে ফলে দেশ দশের মধ্যে বাড়ছে অসহিষ্ণুতা এবং অশ্রদ্ধার চর্চা দেশ পতিত হচ্ছে গভীর  থেকে গভীরতর সংকটে রাজনীতিতে চলছে নীতি লালন-পালনের আকাল
কে কিভাবে রাজা হবে বা রাজা হিসেবে টিকে থাকবে নিয়েই ব্যস্ততা রাজনীতিকদের রাজনীতিকদের সাথে পাল্লা দিয়ে একই ব্যাপারে ব্যস্ত আছে মিডিয়া তথাকথিত  বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সারা দেশের শক্তি মেধা ব্যয় হচ্ছে কে কিভাবে রাজা হবে নিয়ে তাই আগামী নির্বাচন কী ধরনের সরকারের অধীনে হবে নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে বিতর্ক বাক-বিতন্ডা ছড়িয়ে পড়ছে টিভি, পত্র-পত্রিকা থেকে গ্রামের চায়ের স্টলে ক্রমে এসব আলোচনা আরো ঘনীভূত হচ্ছে যদিও জনগণের সাথে বর্তমান রাজনীতির কোনো সম্পর্কই  নেই তবু কে রাজা হবে নিয়ে জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক উৎসাহ মানুষ ভুলে যাচ্ছে তাদের নিজেদের সমস্যা রাজনীতিক তাদের পোষা বুদ্ধিজীবীরা ঘুরিয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনা এদেশের সাধারণ মানুষ আর নিজেদের সমস্যা নিয়ে ভাবে না, ভাবে রাজাদের সমস্যা নিয়ে রাজনীতিকদের ষড়যন্ত্রে দেশে এখন আর রাজা-প্রজার দ্বন্দ্ব নেই, শাসক শাসিত শ্রেণীর মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই এখন চলছে - ‘আওয়ামী লীগ - বিএনপির দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের রাজনীতি এখনআওয়ামী লীগ - বিএনপির ক্ষমতার  দ্বন্দ্বে পতিত
অন্যদিকে রাজনীতি হয়েছে কিছু দুষ্টলোকদের আশ্রয়স্থল রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিছু অসৎ লোক আবৃত হয়েছে দেশপ্রেমের পোশাকে এখন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন ব্যবসায়ী টাকাওয়ালারা সারা জীবন যিনি সাধারণ মানুষের স্বার্থে আন্দোলন-সংগ্রাম করলেন, জীবন-যৌবন উৎসর্গ করলেন, তার কোন দাম নেই এখন দাম আছে টাকার, টাকা দিয়ে কেনা-বেচা হয় মনোনয়ন দেশের ত্যাগী রাজনীতিবিদরা আজ করুণা পরিহাসের পাত্র অন্যদিকে মূর্খ, বর্বর মতলববাজ কিছু লোক আজ রাজনীতিতে সমাদৃত তাই হাজার কোটি, লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেও সাধারণ মানুষের কোন সমস্যার সমাধান হয় না! মানুষের সামনে তৈরি হচ্ছে সমস্যার নতুন পাহাড়! কারণ যেসব মতলববাজরা রাজনীতিতে টাকা বিনিয়োগ করেন, তারা তো ব্যবসার উদ্দেশ্য নিয়েই তা করেন; জনসেবা তাদের উদ্দেশ্য নয় রাজনীতিকরা এখন আর জনগণের নেতা নন, জনগণের কাছে তাদের কোন দায়বদ্ধতাও নেই কেবল ভোটের মৌসুমে জনগণ এদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন ভোট শেষ হলে এরা জনগণের কথা ভুলে যান, মিশে যান রাজধানীর হাওয়ার সাথে জনগণের ভাত-কাপড়ের মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভাববার সময় তাদের কখনো হয় না
এসব মতলববাজ রাজনীতিকরা আজ দুর্বিষহ করে তুলেছে সাধারণ মানুষের জীবন একদিকে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার অভাব অন্যদিকে অপহরণ, গুম-খুন, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি, জমিজমা থেকে উচ্ছেদ, কাজের অভাব, ছাঁটাই, মূল্যবৃদ্ধি, ফসলের উপযুক্ত দাম না পাওয়া ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এসব নিয়ে দেশে কোন আন্দোলন নেই জনগণের কণ্ঠ আজ আবদ্ধ রাজার নীতিতে
বাংলাদেশে যে তথাকথিত সংসদীয় রাজনীতি চালু হয়েছে তাতে সংসদে বিরোধী দল থাকে না ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বিএনপির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই কিন্তু সংসদ সদস্য হিসেবে তারা ঠিকই বেতন ভাতা এবং অন্যান্য সুবিধা ভোগ করেন এরই ধারাবাহিকতায়, ২০০৮ থেকে বিএনপি অধিকাংশ সময় সংসদের বাইরে থেকেছে কোন জরুরি বিষয়ে আলোচনার জন্যই তারা সংসদে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি দেশে সংসদীয় রাজনীতি চলছে সংসদ উপেক্ষা করে কি তাজ্জব ব্যাপার!
সময়  এসেছে ভেবে দেখা দরকার কোথায় আছি আমরা? কোথায় যাচ্ছি? কি করছি? কার স্বার্থে মিছিল, হরতাল করছি? রাজপথে জীবন দিচ্ছি? কে রাজা হলো বা না হলো তার সাথে আমাদের সম্পর্ক কি? কে কিভাবে রাজা হবে, কিভাবে নির্বাচন হবে তা জনগণের সমস্যা নয় এটা রাজনীতিকদের সমস্যা রাজাদের সমস্যা রাজারাই সমাধান করুক নিয়ে সাধারণ মানুষের ভাববার কোন দরকার নেই যে রাজনীতি মানুষের কোন কল্যাণে আসে না, যে রাজনীতি জনগণের কথা বলে না, সে রাজনীতি আমরা আর চাই না বন্ধ হোক রাজাদের নীতি রাজনীতির খেলা, এবার থেকে শুরু হোক জননীতি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন