জাতীয়তা : বাঙালি
নাগরিকত্ব : বাংলাদেশী
॥ আল্লামা মোহাম্মদ সাদেক নূরী ॥
১৫ আগষ্ট ’৭৫ হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন,
তাদের দ্বারা রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চালু এবং ধর্মের রাষ্ট্রীয় ব্যবহারের দরুণ জনগণের ঐক্যের ভিতটাই আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং বিনষ্ট হয় জনগণের ইস্পাতকঠিন ঐক্য, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চব্বিশ বছরের পাকি শোষণ বিরোধী আন্দোলন এবং ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণ জাতীয়তার প্রশ্নে রাজনৈতিকভাবে দু’টি প্রধান ধারায় বিভক্ত - বাঙালি এবং বাংলাদেশী। এ দ্বিতীয় ধারার স্রষ্টা, ধারক এবং বাহক নির্মম পরিণতির শিকার জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা। অথচ এ দু’য়ের মধ্যে মূলতঃ কোন বিরোধ নেই। আমার মাতৃভাষা বাংলা। অতএব জাতিসত্তায় আমি বাঙালি। যেমন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর মাতৃভাষা আরবী হওয়ার কারণে তিনি গর্ববোধ করতেন, ‘আরবী’ বলে। আর যেহেতু আমি বাংলাদেশের নাগরিকও বটে; সেহেতু আমার নাগরিকত্ব বাংলাদেশী। যেমন, মিশরের প্রেসিডেন্ট হুসনী মোবারক জাতিসত্তায় আরবী এবং নাগরিকত্বে মিশরীও বটে। খৃষ্টান মার্গারেট থ্যাচার বৃটিশ নাগরিক হয়েও ইংরেজ হওয়াতে যখন কোন বাধা নেই,
মুসলমান প্রেসিডেন্ট হুসনী মোবারকের নাগরিকত্বে মিশরী হয়েও জাতীয়তায় আরব হওয়াতে তার ধর্ম নষ্ট হয় না, তখন মরহুম জিয়া এবং বেগম খালেদা জিয়া সাহেবদের জাতীয়তায় বাঙালি থেকেও বাংলাদেশী নাগরিক হওয়াতে বাধা কোথায়? দেশের নামকরণ তো হয়েছে স্বাধীনতার পর। এর নিকট অতীত নামতো ছিল, পূর্ব পাকিস্তান। সুদূর অতীতে এর ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল। দেশের নাম অনেকবার বদল হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বদল হয়েছে দেশবাসীর নাগরিকত্ব। যথাঃ বঙ্গবাসী, পাকিস্তানী ইত্যাদি। কিন্তু তাদের জাতীয়তা বদলায়নি। চিরদিনই তারা বাঙালি থেকেছে। বস্তুতঃ জাতীয়তা বদলায়ই না এবং বদলানো যায়ই না।
সিরাজি, ড.
মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মাওলানা ভাসানী প্রমুখ পথিকৃত বাঙালির জাতিসত্তাকে সজাগ ও সংগ্রামী করে তোলার যে ধারাবাহিক প্রচেষ্টা, তা-ই সফল পরিণতি প্রাপ্ত হয় ১৯৭১ এ,
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রাম ও তিতীক্ষার ফলশ্রুতি হিসেবে। তাই তো বাঙালি গর্জে ওঠে একটি শ্লোগানে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো; জয় বাংলা।’ কই সেদিন তো ‘বাংলাদেশী অস্ত্র ধরো,
বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ বলে কেউ শ্লোগান দেয়নি। এটা কি বলার অপেক্ষা রাখে যে, এটা বাঙালির হাজার হাজার বছরের দমিত জাত্যাভিমান ও জাতীয় চেতনা এবং বাঙালি জাতিসত্তারও অদম্য বহিঃপ্রকাশ। আর এরই অর্জন বাঙালির ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
বলাবাহুল্য যে, এ স্বাধীন বাঙালিরা নিজেদের এ স্বাধীন দেশটির নাম অন্য কিছুও রাখতে পারতো এবং এখনো পারে। বোম্বাই তার রাজ্যের নাম বদল করেছে। বার্মাও নিজের নাম বদল করে মায়ানমার করেছে। দেশের নাম বদলের সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট জনগণের নাগরিকত্বও বদল হতো, হয়েছে। কিন্তু তাতে জাতীয়তার কোন পরিবর্তন হয় না। কারণ জাতীয়তা শাশ্বতঃ স্থায়ী, অপরিবর্তনীয়, অবিচ্ছেদ্য এবং মাতৃভাষার সাথে চিরায়তভাবে যুক্ত। আর নাগরিকত্ব অস্থায়ী এবং পরিবর্তনীয়। এমতাবস্থায়, জাতীয়তা ও নাগরিকত্বের এ মৌলিক পার্থক্যটা উপেক্ষা করে অথবা এ পার্থক্যবোধের অভাবে অথবা বাঙালির স্বাধীনতার দেশী-বিদেশী শত্রুদের স্বার্থে নাগরিকত্বকে জাতীয়তার অর্থে ব্যবহার করার আত্মঘাতী ও অপমানজনক অপচেষ্টা চলছে আজ স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পরও।
জাতীয়তার ক্ষেত্রে ‘বাঙালি’র স্থলে ‘বাংলাদেশী’ ব্যবহারের প্রচেষ্টাকে আত্মঘাতী বললাম এ জন্য যে, নাগরিকত্ব, যা পরিবর্তনীয় তাকে জাতীয়তা বলে মেনে নিলে সে জাতি শিকড়হীন বৃক্ষে পরিণত হয় এবং জাতির ভিত্টা দুর্বল হয়ে যায়। সে অবস্থায়, যে কেউ যে কোন সময়ে সামান্য প্রচেষ্টাতেই তা উপড়ে ফেলতে পারে। অপরদিকে, জাতীয়তার ভিত্ মজবুত ও স্থায়ী এবং প্রতিষ্ঠিত হলে শ্বাশ্বত স্থায়ী অবিচ্ছেদ্য সত্তার উপর,
সে জাতিকে কোন বড় শক্তিও চিরদিন অধীন করে রাখতে পারে না। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ এর প্রমাণ। হাজার বছর পর সাগর সাগর রক্ত দিয়ে হলেও বাঙালি স্বাধীন হয়েছে - মানুষ হয়েছে।
‘বাঙালি স্বাধীন হয়ে মানুষ হয়েছে’ বললাম এ জন্য যে, ভাষায়-সাহিত্যে, শিল্পে-সংস্কৃতিতে, আহারে-আচরণে, চলনে-বলনে, বেশভুষায়, আচার-অনুষ্ঠানে, ইতিহাস-ঐতিহ্যে, চিন্তা-চেতনায়, ধ্যান-ধারণায় এবং মন-মানসিকতা ও আবেগ-অনুভূতিতে আবহমান থেকে বাঙালি একটি স্বতন্ত্র জাতি হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক স্বাধীনতা না থাকার কারণে এর কোন বিশ্বস্বীকৃতি ছিল না। এজন্য স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত করার জন্য বাঙালি পথিকৃত কবি-সাহিত্যিকগণ নানাভাবে জাতিকে আঘাত করেন। কবি বজলুর রশীদ স্বাধীনতা বিহনে জাতিকে মেষের সাথে তুলনা করেন। মোহাম্মদ আলী নিজের পরাধীন দেশের বদলে স্বাধীন দেশে মৃত্যুও শ্রেয় মনে করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তো পরাধীন বাঙালিকে মানুষ বলেই স্বীকার করেন নি। তাই তো বঙ্গবন্ধু পাকি জিন্দানখানা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে এসে বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষ লক্ষ বাঙালির সমাবেশে কবিকে উদ্দেশ্য করে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন
- ‘কবি গুরু!
আপনি এসে দেখে যান, এবার বাঙালিরা মানুষ হয়েছে।’ বস্তুতঃই বাঙালিরা মানুষ হয়েছে - স্বীকৃতি পেয়েছে শতাধিক জাতি রাষ্ট্রের।
এমতাবস্থায়, বাঙালির স্থায়ী শ্বাশ্বত জাতিত্বকে অস্থায়ী ও পরিবর্তনীয় নাগরিকত্বের সাথে মিশিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা আত্মঘাতী তো বটেই। বলা বাহুল্য যে, নাগরিকত্বের নামান্তর বা বদল সর্বজন গ্রহণীয় - যেমন বঙ্গবাসী থেকে পাকিস্তানী এবং তা থেকে বাংলাদেশী অথবা পশ্চিমবঙ্গবাসী থেকে ভারতীয়। এমতাবস্থায়, কোন সম্প্রসারণ বা উপনিবেশবাদী শক্তি বাংলাদেশীকে অন্য কোন নাম দেয়ার চেষ্টা করলে জাতীয়তার স্বতন্ত্র মজবুত ভিত্ না থাকলে, তা ঠেকাবেন কি দিয়ে অথবা তা ঠেকাবার প্রয়োজনবোধ বা প্রেরণাটাই আসবে কোত্থেকে?
অপরদিকে, জাতীয়তার ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশী’ শব্দের প্রয়োগকে অপমানজনক বলার কারণ এই যে, ‘বাংলাদেশী’ শব্দটি বাংলাদেশের নাগরিকসহ সমস্ত জীব ও পণ্যের দেশীয় পরিচয় বহন করে। ‘বাংলাদেশী’ বললে দেশের জনগণের কেবল জাতীয় পরিচয় তো বহন করেই না; এমনকি এককভাবে নাগরিক পরিচয়ও বহন করে না, যতক্ষণ না ‘বাংলাদেশী’ শব্দের সাথে
‘নাগরিক’ শব্দ যুক্ত হয়। এভাবে, জাতীয়তার ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশী’ শব্দের ব্যবহার দেশের জনগণকে অন্যান্য জীব-পণ্যের পর্যায়ে নিয়ে যায়। এটা যেমন আত্মঘাতী, তেমনই অপমানজনকও বটে।
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশী প্রত্যেকটি জীব-পণ্যই আমার প্রিয় শুধু নয়,
আমার অহংকার। বাংলাদেশী নাগরিক পরিচয়ে আমি সর্বাধিক গর্বিত। এ জন্য আমি আমার জতীয়তাকে অন্যান্য জীব পণ্যের দেশীয় পরিচয়ের সাথে মিশিয়ে দিতে রাজি নই। আমার জাতীয় পরিচয় অবশ্যই স্বদেশী অন্যান্য জীব-পণ্যের দেশীয় পরিচয়ের থেকে স্বতন্ত্র হতে হবে। আমি সৃষ্টির সেরা মানুষ। মানব জাতির মধ্যে বর্তমানে প্রায় ছ’ হাজার ভাষাভিত্তিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মতো আমারও জাতিসত্তা, আমার মাতৃভাষা-বাংলা। সুতরাং মানব জাতির অংশ হিসেবে আমার জাতীয় পরিচয়, প্রথমে আমি বাঙালি, তারপর আমি বাংলাদেশী নাগরিক।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে,
বাংলাদেশে সেনা শাসনের প্রবর্তক জেনারেল জিয়া কর্তৃক অগণতান্ত্রিক উপায়ে বেয়নটের জোরে চাপিয়ে দেয়া বাংলাদেশী জাতীয়তা সরকারি দলিলপত্রে আজও বহাল আছে। লজ্জানক হলেও বলতে হয় যে,
স্বাধীনতার পক্ষবদল দাবিদারগণ স্বয়ং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে দেশের সরকারি ক্ষমতায় বহাল থাকার পরও এক্ষেত্রে ত্রিশ লক্ষ বাঙালির রক্তে লেখা এবং বঙ্গবন্ধুর সরকারের স্বীকৃত বাঙালি জাতীয়তায় প্রত্যাবর্তনে গৃহীত উদ্যোগ এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, আমার মনে হয়,
জাতীয়তার ব্যাপারে সাংবিধানিক অস্পষ্টতা চলমান ‘বাঙালি’ বনাম ‘বাংলাদেশী’ বিতর্ক সৃষ্টির জন্য সম্পূর্ণ দায়ী না হলেও সহায়ক হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। ৭২ এর সংবিধানের প্রস্তাবনায় যেখানে বলা হয়েছে, ‘যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল’ সেখানে অন্যতম মূলনীতি হিসাবে কেবল
‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এটা বাঙালি জাতীয়তাবাদ, না বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, তার সুস্পষ্ট উল্লেখ সংবিধানের কোথাও নজরে পড়েনি।
শোনা যায়,
‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এ দিল্লির আপত্তি ছিল এবং আছে। কারণ, ‘বাঙালি’ শব্দটি তাদের পছন্দ নয়। তা হলেও, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ‘আকাশবাণী’তে ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ জোরেসোরে চালিয়েছে তারা। বাঙালি ঐক্যের শিকড় খুঁজে বেড়িয়েছেন, তাদের পন্ডিতগণ। অতপর আমরা যখন বাঙালি হলাম,
যুদ্ধ করে,
পশ্চিম বাংলার নাম বদল হয়ে হলো পশ্চিম বঙ্গ এবং পশ্চিম বাংলার জনগণকে চেষ্টা করা হচ্ছে হিন্দি শিখিয়ে ভারতীয় বানাবার। আর তারা তাই হয়ে যাচ্ছেন।
এমতাবস্থায়, বাংলাদেশে যদি ‘বাঙালি’ শব্দ উচ্চারিত হতে থাকে অথবা বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সত্যি সত্যি যদি শক্ত শিকড় গেড়ে বসে,
আর ধীরে ধীরে তা পল্লবিত হয়ে ডালপালা বিস্তার করতে থাকে, তাহলে, এর ছায়া কোথায় পতিত হয়ে কি প্রভাব ফেলে,
তা কে জানে। তখন পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে ভারতীয় বানাবার বেলায় একই বাধার সম্মুখীন হতে পারে দিল্লি, যে বাধার সম্মুখীন হয় পিন্ডি, পূর্ববাংলার জনগণকে উর্দু শিখিয়ে পাকিস্তানী বানাতে গিয়ে। শোনা যায়, অনুরূপ আশংকার বসে সাধু সাবধানী ও দূরদর্শিতা থেকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে ‘বাঙালি’ ব্যবহার না করার অনুরোধ করেছিলেন। জানি না,
সে কারণে কিনা, সংবিধানে ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি নিরাভরণ রাখা হয়। তবে, সংবিধানে যা-ই থাক, বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়ে,
ঐতিহাসিক কারণেই পাসপোর্টসহ সব সরকারি দলিলপত্রে জাতীয়তার ক্ষেত্রে ‘বাঙালি’ লেখা হতো। এটা আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান মিত্র দিল্লি কতটা সহজভাবে মেনে নিয়েছিলেন অথবা মোটেই মেনে নিয়েছিলেন কিনা কে জানে!
এমতাবস্থায় পরবর্তীতে সেনাশাসক দ্বারা ‘বাঙালি’ স্থলে বাংলাদেশী চালু করার পিছনে দিল্লির মনোরঞ্জনের ইপ্সা থাকার বিষয়টি চিন্তক মনে আসতেই পারে।
সে যা হোক, বঙ্গবন্ধু শহীদ হলেন। জিয়া সাহেবরা ক্ষমতায় এলেন। সরকারি দলিলপত্রে জাতীয়তার কলামে ‘বাঙালি’র স্থলে ‘বাংলাদেশী’ প্রতিস্থাপিত হয়। এ বিশেষ কলামটাকে জাতীয়তার পরিবর্তে নাগরিকত্বের কলাম বানিয়ে ‘বাংলাদেশী’ লেখা বাধ্যতামূলক করা হলে, আমার মনে হয়, তাতে কারোই কোন আপত্তির কারণ থাকে না এবং বিনষ্ট হয় না জাতীয় ঐক্য।
প্রসঙ্গক্রমে জয় বাংলা ও জিন্দাবাদ সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন মনে করছি। কারণ, ‘বাঙালি’ আর ‘বাংলাদেশী’ বিতর্কের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভক্তরা ‘জয়বাংলা’ পছন্দ করে না। সে সঙ্গে দেশের বামগোষ্ঠীও অধুনা ‘জয়বাংলা’ বলতে শরমবোধ করেন। অপরদিকে ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদের প্রবক্তাগণের দ্বিতীয়, তৃতীয় স্তর থেকে নিচের দিকে ক্রমবর্ধমান জোরেশোরে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি শোনা যায়। দ্বিতীয় পক্ষের সর্বোচ্চ পর্যায়েও এ ধ্বনী ক্রমান্বয়ে শিথিল হয়ে আসছে। কারণ, হয়ত তাই, যে কারণে ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি সংবিধানে নিরাভরণ রাখা হয়।
স্মর্তব্য, ’৭১ এর গণঅভ্যুত্থানে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি ছিল জনগণের মুখে মুখে। ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি শক্তির উৎস হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই দেখেছেন, উঁচুতে আরোহনের সময়ে রিক্সাচালক উচ্চকণ্ঠে ‘জয়বাংলা’ বলে রিক্সার প্যাডেল চাপছে এবং কুলিরা কোন ভারী জিনিস তুলতে এ ধ্বনি ব্যবহার করছে। পরবর্তীতে তা মুক্তিযোদ্ধাদের ‘রণধ্বনি’তে পরিণত হয়। পাকি হায়নারা ‘পাকিস্তান-জিন্দাবাদ’ বলে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর হামলা চালাতো, আর মুক্তিযোদ্ধারা জয়বাংলা বলে তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়তো। বাংলার জয় হয়, মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ী হন এবং
‘জয়বাংলা’ জাতীয় শ্লোগানে পরিণত হয়। ’৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পর বেতারের বদলে রেডিও, বাঙালির বদলে বাংলাদেশী’র মত ‘জয়বাংলা’র বদলে চালু হয় ‘জিন্দাবাদ’। সঙ্গে সঙ্গে তথাকথিত বামরাও জিন্দাবাদ গ্রহণ না করলেও ‘জয়বাংলা’ সযত্নে পরিহার করে।
‘জিন্দাবাদ’ ফার্সী শব্দ। অর্থ ‘অমর বা দীর্ঘজীবী হোক’। ফার্সী আমার প্রিয় ভাষা। ব্যাকরণের দিক থেকে খুব সহজ। ফাজিল শ্রেণীতে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে আমি বাংলার সাথে ফার্সী পড়েছি। এখনও ফার্সী শিখতে চেষ্টা করছি। কারণ, ফার্সীতে জ্ঞানের এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যা অন্য ভাষায় নেই। বিশেষ করে, সূফী দর্শন। সুতরাং ভাষা হিসেবে ‘জিন্দাবাদ’ এর প্রতি আমার কোন অনীহা নেই।
কিন্তু ‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনিটি পাকি হায়না, আলবদর, রাজাকার, আলশামস দ্বারা বাঙালি নিধন, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং নারী নির্যাতনে ’৭১ এ ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হওয়াতে এটির প্রতি ঘৃণা জন্মে গেছে। তখন পাকি হায়নাদের দোসর, আলবদর ও রাজাকাররা আল্লাহু আকবর ও জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে এলাকায় ঢুকতো, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা ও লুটপাট চালাতো। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, এ সব ধ্বনি শুনলেই জনগণ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো এবং মহিলাদের ঘরের বাইরে বাগান-ঝোপে-ঝাড়ে লুকিয়ে রাখা হতো। এ ধ্বনির আতংকে মহিলারা রাতের অন্ধকারে সাপ-বিচ্ছুর ভয় পর্যন্ত ভুলে যেতো। ফলে মনে হয় যেন, এ ধ্বনির মধ্যে গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং নারী নির্যাতনের মতো ধর্মের দৃষ্টিতে মহাপাপ কার্যাদির উৎস নিহিত রয়েছে, যেমনই রয়েছে ‘জয়বাংলা’র মধ্যে বীরত্বের প্রেরণা।
কোন শব্দের অপব্যবহার কিভাবে শব্দটিকে ঘৃণিত করে তোলে,
এটাই তার প্রমাণ। এভাবে তথাকথিত ইসলামপন্থীরা জিন্দাবাদসহ আলবদর, রাজাকার (আসলে রেজাকার) এর মত ঐতিহাসিক এবং সুন্দর কতিপয় শব্দকে অপব্যবহার করে সাধারণ্যে এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করে ফেলেছে। মীর জাফর শব্দের অর্থ - যাই থাক, এখন এর অর্থ দাঁড়িয়েছে বিশ্বাসঘাতক। কেউই এখন নিজের ছেলের নাম মীরজাফর রাখে না। তেমনই আলবদর এবং রাজাকার অর্থ এখন রাষ্ট্রদ্রোহী আর ‘জিন্দাবাদ’ অর্থ পাকিস্তান অমর হোক। এ ‘জিন্দাবাদ’ রক্ষার নামে, এ দেশের জনগণের সাগর সাগর রক্ত ঝরানো হয়েছে, লুন্ঠন করা হয়েছে অমূল্য সম্পদ, নির্যাতন করা হয়েছে মা-বোনেদের। এমতাবস্থায়, উক্ত দুষ্টকর্মের দোসররা ছাড়া
’৭১ এর জনগণের মনে জিন্দাবাদের প্রতি ঘৃণা থাকাই স্বাভাবিক এবং তারা তা শুনলে আঁতকে উঠবেন। কারণ, এ ধ্বনির সাথে সাথে পাকি হায়না ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বিভীষিকাময় চেহারা তাদের সামনে ভেসে আসে। সুতরাং ওদের কাছে তা যে কারণে মধুর লাগে,
যারা এর নির্মম শিকার হয়েছেন, তাদের কাছে সে কারণেই তা ততোধিক বিষময় লাগে। তা ছাড়া এটাই এখন স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিরূপণের মানযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। যারা জিন্দাবাদ ব্যবহারে কোন দোষ দেখেন না, আমি তাদের কোন ছেলের নাম মীরজাফর রাখতে অনুরোধ করবো। তা রাখতে রাজি না হলে,
উক্ত কারণে জিন্দাবাদপন্থীদের ঘৃণার সাথে বর্জন করা এবং সমধিক ব্যাপকভাবে ‘জয়বাংলা’ উচ্চারণ করা সকল সুস্থ ও সচেতন নাগরিকের জাতীয় কর্তব্য হওয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবী বলে স্বাধীনতার পক্ষশক্তি মনে করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন