মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৩

অবৈধ হলো জামাতের নিবন্ধন



অবৈধ হলো জামাতের নিবন্ধন

সংলাপ ॥ রাজনৈতিক দল হিসেবে জামাতে ইসলামীকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল উল্লেখ করে হাইকোর্টের ঘোষণা করা পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। আদালত বলেন, 'নিবন্ধনের সময় দাখিলকৃত জামাতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য ধারা বা বিধান সাংঘর্ষিক ছিল সংবিধানের সঙ্গে। একই সঙ্গে সাময়িকভাবে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন দেয়ার এখতিয়ার ইসির নেই।' পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ মন্তব্য করেছেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতি। জামাতে ইসলামীর নিবন্ধন নিয়ে চলমান ইস্যুটি ইসিতে নিষ্পত্তির মত দিয়েছেন বেঞ্চের সর্বজ্যেষ্ঠ বিচারপতি। তবে বেঞ্চের সিনিয়র এই সদস্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে অপর দুই বিচারপতি বলেছেন, 'নিবন্ধনটিকে সাময়িক বলে জামাতে ইসলামী এবং নির্বাচন কমিশন যুক্তি দিলেও এ ধরনের নিবন্ধন দেয়ার বিধান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) কোথাও নেই। এ ছাড়া সাময়িক নিবন্ধন বলে কোনো বিষয় পাওয়া যায়নি নিবন্ধন সনদেও।' এদিকে জামাতে ইসলামীর আইনজীবী ব্যারিস্টার বেলায়েত হোসেন জানিয়েছেন, 'এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।' একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুল অ্যাবসল্যুট করে নির্বাচন কমিশনে জামাতে ইসলামীর নিবন্ধন ১ আগস্ট অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। বেঞ্চের তিন সদস্য স্বাক্ষরের পর এ রায় প্রকাশ করে সুপ্রিমকোর্টের সংশ্লিষ্ট দফতর।
জামাতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের পক্ষে মূল রায়টি লেখেন বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক। তিনি বলেন, 'সংশ্লিষ্ট বিধিতে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে এটা বলা হয়েছে, শর্ত পূরণ না করে দেওয়া গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে এ ধরনের কোনো নিবন্ধন দেয়ার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের নেই। অথবা নির্বাচন কমিশন ওই গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে শর্ত পূরণে জামাতকে অনুরোধ করতে পারে না। কারণ ওই নিবন্ধন প্রথম আইনি কর্তৃত্ব বহির্ভূতভাবে করা হয়েছে।' আদালত বলেন, 'এটা বলা যায়, এ বিষয়ে জারি করা রুলের গুরুত্ব রয়েছে। রুলকে চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামাতে ইসলামীকে দেয়া নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন কর্তৃত্ববহির্ভূত এবং ফলহীন বলে ঘোষণা করা হচ্ছে।' বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এই বিচারপতির সঙ্গে একমত পোষণ করে একটি সংযুক্তি দেন। নির্বাচন কমিশনে জামাতে ইসলামীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস প্রসঙ্গে এই বিচারপতি বলেন, 'আমি নিঃসংকোচ ও দ্ব্যর্থহীনভাবে এ কথা বলতে পারি যে, নিবন্ধন  নেয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনে আলোচ্য দলটির ওই ধরনের মৌখিক প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস ছিল ইসিকে বিভ্রান্ত করে কৌশল ও শঠতার আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে তর্কিত নিবন্ধনটি আদায় করা; এবং অবশেষে তা করতে সক্ষমও হয়েছে দলটি। অতএব ওই নিবন্ধনটি ছিল অশুদ্ধ ও অকার্যকর।' এই দুই বিচারপতির দেয়া রায়ে বলা হয়, 'আরপিওর ৯০সি অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ছয় মাসের মধ্যে আইনগত শর্তপূরণ করতে হবে। পরবর্তীতে এই মেয়াদ বাড়িয়ে ১২ মাস করা হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শর্ত পূরণ হয়নি। এ কারণে জামাতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না মর্মে জারি করা রুল মঞ্জুর করা হলো।' তবে বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন বেঞ্চের অপর দুই সদস্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে রায়ে বলেন, 'জামাতে ইসলামীর নিবন্ধন নিয়ে করা রিট গ্রহণযোগ্য নয়।' এই বিচারপতি বলেন, 'আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, নির্বাচন কমিশনকে বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীর নিবন্ধন ইস্যু নিষ্পত্তির নির্দেশনা দিয়ে রুল নিষ্পত্তি করলে ন্যায়বিচার হবে। এ কারণে যুক্তিসঙ্গত দ্রুত সময়ে আইন অনুসারে জামাতে ইসলামীর নিবন্ধন ইস্যু নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা দিচ্ছি।' রাজনৈতিক দল হিসেবে জামাতে ইসলামীর নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে এই রিট আবেদনটি দায়ের করেন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব ও বর্তমান প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি। আবেদনে বলা হয়, চারটি কারণে জামাতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে পারে না। প্রথমত, জনগণকে সব ক্ষমতার উৎস বলে নীতিগতভাবে মনে করে না জামাত। একই সঙ্গে আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকেও স্বীকার করে না দলটি। দ্বিতীয়ত, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে কোনো সামপ্রদায়িক দল নিবন্ধন পেতে পারে না। অথচ কার্যক্রম ও বিশ্বাসে দলটি সামপ্রদায়িক। তৃতীয়ত, নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের  কোনো বৈষম্য করতে পারে না। কিন্তু এই দলের শীর্ষপদে কখনো কোনো নারী বা অমুসলিম যেতে পারবে না। চতুর্থত, বিদেশের কোনো সংগঠনের শাখা হিসেবে এ দেশে কোনো রাজনৈতিক দল পরিচালিত হতে পারবে না।
অথচ জামাত বিদেশের একটি সংগঠনের শাখা। সদস্যরাও স্বীকার করেন দলটির জন্ম ভারতে। দলটির শাখা রয়েছে বিশ্বজুড়ে। রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে ওই বছরের ২৭ জানুয়ারি বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি হয়ে ইতোমধ্যে অবসরে) এবং বিচারপতি আবদুল হাইয়ের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। নির্বাচন কমিশনসহ জামাতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। পরে রুলটি উত্থাপন করা হয় বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে। সেখানে আংশিক শুনানির পরই পরিবর্তন হয় ওই বেঞ্চের এখতিয়ার। এর পর আর রুলের শুনানি করার উদ্যোগ নেয়নি কোনো পক্ষই। ফলে এটি আদালতের কার্যতালিকায়ও আসেনি। সমপ্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও জামাতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের জোর দাবি ওঠায় ওই রুলের শুনানি শুরুর জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করে রিটকারী পক্ষ। পরে প্রধান বিচারপতি ওই বিষয়টি শুনানির জন্য বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন এবং বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ নির্ধারণ করেন। এই বেঞ্চ বিষয়টি শুনানির জন্য বৃহত্তর বেঞ্চ গঠনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করলে বিচারপতি এম  মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের সমন্বয়ে বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করেন প্রধান বিচারপতি। গত ১২ জুন রুলের ওপরে শুনানি শেষ হয় এই বেঞ্চে। এর আগে ১১ এপ্রিল রুলের চূড়ান্ত শুনানি শুরু হয়। ওই দিন আদালতে হলফনামা আকারে ইসির জবাব দাখিল করা হয়। ১৮ এপ্রিল রিটের পক্ষে শুনানি শেষ করেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। আর ২৫ এপ্রিল শুনানি শেষ করেন ইসির আইনজীবী মহসীন রশীদ। এর পর ২২ মে থেকে জামাতে ইসলামীর পক্ষে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, ব্যারিস্টার  বেলায়েত হোসেন এবং অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার শুনানি করেন। ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর ৩৮টি দলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায় জামাতে ইসলামী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন