সুশাসন প্রতিষ্ঠা
করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে
শেখ উল্লাস ॥ দেশে বর্তমানে সুশাসন নেই- এভাবে বললে কথাটা
ঢালাওভাবে বলা হবে, সত্য হবে না। আবার, দেশে
সুশাসন নিশ্চিত হয়ে গেছে-এভাবে বললেও মিথ্যাচার হবে। সুশাসন তথা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার
অভাব দেশে সব সময়ই ছিল। দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম সাধারণ মানুষের জীবনকে বিষিয়ে রেখেছে
সব সময়ই। এদের অনাচারের কারণেই দেশে তৈরি হয় ধর্মান্ধ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী। দেশ স্বাধীনের
পর সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর মুখনিঃসৃত অনেক কথাই এখন সর্বজনীন বাণীতে পরিণত
হয়েছে। বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, 'আমি ভিক্ষা
করে নিয়ে আসি, চ্যাটার দল সব খেয়ে ফেলে'। এই চ্যাটার দল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তাঁর দলে,
আমলাতন্ত্রে, ব্যবসায়ী মহলে। এই চ্যাটার দল ১৯৭৫-এর ১৫ই আগষ্টে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের
সদস্যদেরকে নির্মমভাবে হত্যার পর কোনো প্রতিবাদ
করতে এগিয়ে আসেনি। বরং তাদের অনেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার সুফল ভোগ করেছে এবং দীর্ঘ সময়
এদেশে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের লোকদেরকে পুনর্বাসনে সহায়তা করেছে। তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায়
এদেশে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র সরকারি-চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সর্বক্ষেত্রে অঢেল
আর্থিক সম্পদের মালিক হয়েছে। বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে
নিবেদিতপ্রাণ মানুষেরা বঞ্চিত হতে হতে সমাজের সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। দীর্ঘ ২১
বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ই জুনের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশের
মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির নতুন করে জাগরণ সৃষ্টি হলেও তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে সেই
চ্যাটার দলের কারণেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে যে নতুন বাস্তবতা তৈরি
হয়েছে তার সুফল সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে আজ সবচেয়ে প্রয়োজন সর্বস্তরে সুশাসন
নিশ্চিত করা। এই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক রাজনীতি, ব্যবসায়ী ও আমলাতন্ত্রের
মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা দুর্নীতিবাজ চক্র। একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, ষোলো
কোটিরও বেশি মানুষের এই দেশে জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশই কেবল বিরাট আর্থিক ও সামাজিক
প্রতিপত্তির মালিক। অধিকাংশ রাজনীতিক ও আমলারা যদি শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই
রাজনীতি করেন, নিজেদের সুযোগ-সুবিধা ও আরাম আয়েশের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য চাকুরি করেন, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন নিজেদের অর্থ-সম্পদের
পরিমাণ আরও বাড়ানোর জন্য তবে তার চাইতে দুঃখজনক আর কী'বা হতে পারে? আর বর্তমানে যে
জিনিষটি অতীতের মতোই উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে তা হলো - নেতা ও আমলাকে হাত করে, ঘুষ
দিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে পদোন্নতি, বদলী ও পদায়ণ নিচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী
চক্রের এজেন্টরা। যে কারণে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ বিঘ্ন ও বিলম্বিত হচ্ছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ
জায়গায় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের লোকেরা যেভাবে জায়গা করে নিয়েছে তাতে মনে হয় যে, স্বাধীনতাবিরোধী
চক্রই ক্ষমতায় আছে। আর এরাই সরকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। পদলেহী
এ গোষ্ঠী সুযোগ পেলেই সরকারের বিরুদ্ধে তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে তাদের মতলব হাসিলের
জন্য। দেশে সুশাসন নিশ্চিত না হওয়ার যত ফায়দা এ গোষ্ঠী ভোগ করছে, আর্থিক ও সামাজিকভাবে
লাভবান হয়ে এরাই ফুলে ফেঁপে উঠছে। এক রাজাকারের ফাঁসি কার্যকর হলেও তাদের হাজারো অনুসারী
ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দেশের আনাচে কানাচে। বর্তমানের এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকদের গভীর পর্যবেক্ষণ
করে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার দাবি বিশ্লেষকদের। অপার সম্ভাবনার এই দেশটিকে কোনোভাবেই
দুর্নীতিবাজ ও স্বাধীনতার আদর্শের বিরোধীদের অভয়ারণ্য হতে দেয়া যায় না। এদেশের মানুষ অনেক ত্যাগ স্বীকার করে স্বাধীনতা
এনেছে। কিন্তু এর সুফল আরও ঘরে তুলতে পারেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলই
যেখানে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত, সেখানে দেশের এই বাস্তবতা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা
দরকার। নতুবা ইতিহাসের কাঠগড়ায় জাতিকে এ ব্যর্থতার
জন্য বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। পদলেহীদের হটিয়ে সমাজের সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠায়
অগ্রাধিকার দিতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন