বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই, ২০১৪

কেন আমরা সৎকাজ করবো?



কেন আমরা সৎকাজ করবো?

ইমরান ॥ এ প্রশ্নের উত্তরে কুরআনে বারবার বলা হয়েছে - প্রত্যেক মানুষকেই ভোগ করতে হবে তার কৃতকর্মের ফল। শেষ বিচারের দিন পাপী নিক্ষিপ্ত হবে জাহান্নামে এবং ভোগ করবে পাপের শাস্তি। আর পুণ্যবানকে অভ্যর্থনা জানানো হবে জান্নাতে। পুণ্যবান লাভ করবে আল্লাহ্‌ তায়ালার নৈকট্য আর পাপী থাকবে আল্লাহ্‌ তায়ালা থেকে দূরবর্তী।
তবে পাপের শাস্তি এবং পুণ্যের পুরস্কার শুধু আখেরাতের ব্যাপার নয়। ইসলাম শুধু আখেরাত কেন্দ্রিক ধর্ম নয়। কুরআন ইহকালেই চারটি গুরুতর পাপের শাস্তি সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। অতএব, পাপ-পুণ্যের ইহজাগতিক প্রভাবকে কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না। বস্তুত, প্রতিটি মানুষ তার জীবনেই অনুভব করতে পারে স্বর্গ-নরকের স্বাদ। জীবনে যে প্রশান্তি উপলব্ধি করেনি মরণের পরও সে তা উপলব্ধি করতে পারবে না। জীবন যার শান্তিময় নয় মরণ তাকে কি শান্তি দেবে? পুণ্যের ফলে মানুষের মধ্যে যে শান্ত এবং প্রীতির ভাব জাগ্রত হয় তা-ই প্রশান্তি বা জান্নাতের উপলব্ধি, আর পাপের ফলে যে অনুশোচনার আগুন বিবেকে জ্বলে উঠে, কেবল জাহান্নামের আগুনের সাথেই তার তুলনা চলে। আল্লাহ্‌ বলেন, “আর যে কেউ পাপ কাজ করে সে তা দিয়ে নিজেরই ক্ষতি করে।” (সুরা আন নিসা : ১১১)। এ ক্ষতি শুধু পরকালের নয়, ইহকালেরও। পাপ যত বেড়ে যায় হৃদয়ের কালিমাও তত বেড়ে যায়। মহানবী (সা.) বলেন, “নিশ্চয়ই মুমিন ব্যক্তি যখন পাপ করে তখন তার হৃদয়ে একটা কালো বিন্দু অঙ্কিত হয়। যদি সে তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে তবে তার হৃদয় পরিষ্কার হয়। আর যদি অধিক গুনাহ্‌ করতে থাকে তবে ঐ কালো বিন্দু বিস্তৃত হয়ে পড়ে। এমনকি তা তার হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলে” (তিরমিযী)।
পাপ মানুষকে অস্থির করে তুলে। পাপীর মনের শান্তি দূর হয়ে যায়। তার মনে সদা জাগ্রত থাকে ধরা পড়ার ভয়। ফলে সে আক্রান্ত হয় বিভিন্ন মনো-দৈহিক রোগে। আর পূণ্য মানুষকে করে তুলে ধীর-স্থির। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, ‘পূণ্য কাজ করলে মুখম-লে উজ্জ্বলতা, অন্তরে আলো, রিজিকে সচ্ছলতা, শরীরে শক্তি আর মনে প্রেমের সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে, পাপের কাজ করলে মুখমন্ডলে মলিনতা, অন্তরে অন্ধকার, শরীরে আলসেমী, রিজিকে অস্বচ্ছলতা ও মানুষের অন্তরে ঘৃণা সৃষ্টি হয়’।
পাপের কারণে দেহ ও মনে দুর্বলতা আসে। মনের দুর্বলতার কারণে ভাল কাজের আগ্রহ কমতে কমতে একেবারেই তা শেষ হয়ে যায়। মনের দুর্বলতা ধীরে ধীরে শরীরকেও দুর্বল করে তোলে। পক্ষান্তরে, সততা মানুষকে সাহসী করে। যে ব্যক্তি প্রকৃতই সৎ সে আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কোন কিছুকেই ভয় পায় না। সততা মানুষকে এমন সাহসী করে যে, সে মৃত্যুকেও পরোয়া করে না।
পাপের কারণে মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনা লোপ পায়। পক্ষান্তরে, পুণ্যের কারণে মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনা বৃদ্ধি পায়। পাপের ফলে পাপীর লজ্জা ও আত্মমর্যাদা-বোধ চলে চায় এবং এক সময় নিজেই নিজেকে ঘৃণা করতে থাকে। এইভাবে ধীরে ধীরে মানুষের কাছেও সে একটি ঘৃণ্য জীবে পরিণত হয়। একটি মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যেমন মিথ্যাবাদীকে আরো হাজারটা মিথ্যা বলতে হয় তেমনি একটা পাপ আরো হাজারটা পাপের কারণ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে, ভাল কাজ নিজেই আপন মহিমায় উজ্জ্বল, একটি ভাল কাজ  মানুষকে আরো একটি ভাল কাজে উৎসাহিত করে। কোন পাপী জ্ঞানের স্বাদ পেতে পারে না। কারণ, জ্ঞান হলো আলো আর পাপ হলো অন্ধকার। আলো আর অন্ধকার একই সাথে থাকতে পারে না। তাই প্রকৃত জ্ঞান মানুষকে পাপের অন্ধকার হতে বিরত রাখে এবং একই ভাবে পাপের অন্ধকারে নিমজ্জিত ব্যক্তির হৃদয়ে জ্ঞানের আলো পৌঁছতে পারে না। পাপী এক সময় পাপের কাজ করতে করতে পাপ সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যায়। সে তখন অভ্যস্তভাবেই পাপ করতে থাকে। তাই একদিন ধরা পড়ে যায় এবং পাপীর মুখোশ উন্মোচিত হয়। ফলে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই তার প্রাপ্য থাকে না। পক্ষান্তরে, ভাল কাজ করতে করতেও একদিন সে ভাল কাজের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে এবং ভাল কাজ ছাড়া আর অন্য কিছুই সে করতে পারে না। তাই ইহকালেই সে সম্মান লাভ করে।
পাপীর ইহজাগতিক সফলতা দেখে সমাজের অন্যান্য মানুষও পাপের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং এক সময় গোটা সমাজই পাপের দিকে ধাবিত হয়। ফলে গোটা সমাজই পাপে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে এবং পাপীরাই তখন পাপীদের সাজা দিতে শুরু করে। যেমন, প্রায়শই দেখা যায় যে, সন্ত্রাসীদের হাতেই সন্ত্রাসীদের মৃত্যু হয়। পক্ষান্তরে, একজন সৎ মানুষের আর্থিক সফলতা না থাকলেও অন্তরের সৌন্দর্যের কাছে ভাল-মন্দ সকল মানুষকেই এক সময় শ্রদ্ধায় মাথা নত করতে হয়।  পাপীর শরীর যতই স্ফীত হোক না কেন অন্তরটি থাকে চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো। পাপী জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে। আর পূণ্যবান সব সময়ই জীবনকে দেখে অসীম সম্ভাবনাময় এক ক্ষেত্র হিসেবে। পূণ্যবান ব্যক্তির শরীর-মন সুস্থ থাকে ফলে তাঁর আয়ু বৃদ্ধি পায়।
আপাত দৃষ্টিতে যদিও পাপীদের সাহসী বলে মনে হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, পাপ মানুষকে ভীতু প্রকৃতির করে তোলে। কারণ, তার মনে সর্বদাই জাগ্রত থাকে ধরা পড়ার ভয়। তাই কোন পাপী সহজে মানুষের সাথে বিশেষ করে পূণ্যবান মানুষের সাথে মিশতে পারে না। পাপ করতে করতে এক পর্যায়ে জগৎ সংসারে সে একাকী হয়ে পড়ে।
মানুষ যা দেয়, তা-ই পায়। যে যা বিকিরণ করে তার দিকে তা-ই বিকিরিত হয়। পাপী যে পাপ বিকিরণ করে তা অনেকগুণে বর্ধিত হয়ে ফিরে আসে তার-ই কাছে। যারা সৎকাজ করে তারা সততাই প্রাপ্ত হয়। যে যে নিক্তিতে পরিমাপ করে তাকেও সেই নিক্তিতেই পরিমাপ করা হয়। এটাই জগতের অলঙ্ঘনীয় বিধান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন