নিয়ন্ত্রণ বিজ্ঞান
সিদ্ধার্থ ॥
তমঃ, রজঃ, সত্ত্ব এই তিন গুণের সমন্বয়ে মানুষ। তমঃ গুণের আধিক্য কর্ম-বিমুখতা, জড়ত্ব,
ভয়, তন্দ্রা, নিদ্রা ও আলস্যের কারণ। তমঃ অর্থ অন্ধকার। তমঃ গুণের আধিক্য মানুষকে অন্ধকার
পথে নিয়ে যায়, সৃষ্টি শক্তিকে নিস্তেজ, মৃতপ্রায় করে রাখে। ফলে মানুষ ঋণে, ব্যাধিতে,
অভাবে, দৈন্যে, দুর্দশায় পতিত হয়। রজঃ গুণ হলো তেজ। সত্ত্ব গুণ সর্ব অসৎ শক্তিকে পরাজিত
করে মানুষকে পূর্ণতার পথে নিয়ে যায়। সত্ত্ব গুণের প্রভাবে আলস্য, কর্ম বিমুখতা, নৈরাশ্য,
অবিশ্বাস ইত্যাদি দূর হয়।
স্বল্প মাত্রায়
তমঃ গুণ জীবনের জন্য প্রয়োজনও বটে। তমঃ গুণ বিলুপ্ত হলে ঘুম হবে না। কিন্তু মানুষ যখন
ঘুমোতে চায় না তখনও যদি ঘুম-ঘুম ভাব তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে তাহলে বিপত্তি ঘটে। তমঃগুণ
নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে প্রথমে আলস্য আসে, কোন কিছু করতে ভালো লাগে না। এটা যদি
সপ্তাহে দুই একবার কিংবা মাসে পাঁচ সাতবার ঘটে তাহলে চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু প্রতিদিনই
যদি তা হয় তাহলে দীর্ঘসূত্রিতার উৎপত্তি ঘটে। যে কোন কাজ উপস্থিত হলেই ভাবনা আসে -
‘এখন না, পরে করবো; আজ নয়, কাল করবো’। এই অবস্থা চলতে থাকলে অবসাদ আসে। অবসাদ থেকে
আসে বিষণ্নতা। বিষণ্নতা থেকে আসে আত্মহত্যার ইচ্ছা।
রজঃ গুণ কর্মোদ্যম
সৃষ্টি করে। এক কথায় রজঃ কাজ করার সামর্থ্য। রজঃ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে প্রথম
স্তরে চঞ্চলতার সৃষ্টি হয়। চঞ্চল মানুষ এক স্থানে স্থির থাকতে পারে না। এক স্থানে বসে
থাকলেও তারা হাত-পা নাড়ায়, মাথা চুলকায় কিংবা এটা-সেটা নাড়াচাড়া করে। দ্বিতীয় স্তরে,
অসংখ্য চিন্তা মস্তিষ্কে কলহের সৃষ্টি করে। এটা করবো নাকি ওটা করবো, খাব না কি খাব
না, ঘুমাবো না কি ঘুমাবো না - ইত্যাদি নানা প্রকার দ্বৈত চিন্তা আসে। ফলে অস্থিরতা
ও সিদ্ধান্তহীনতার সৃষ্টি হয়। রজঃ গুণের আধিক্য এই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে চলনসই। কিন্তু
রজঃ গুণ আরো বাড়তে থাকলে রাগ ও হিংসার সৃষ্টি হয়। মানুষ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ফলে সৃষ্টি
হয় সংঘর্ষের। রজঃ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে চিৎকার, চেঁচামেচি, গালাগালি, মারামারি
সবকিছুই হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত তমঃ নিজের ক্ষতি করে কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত রজঃ কেবল নিজেরই
ক্ষতি করে না অন্যকেও আঘাত করে।
তমঃ এবং রজঃ
কোনটিরই বিনাশ কাম্য নয়। কারণ তমঃ বিনাশিত হলে মানুষ ঘুমোতে পারবে না, বিশ্রাম নিতে
পারবে না, আবার রজঃ বিনাশিত হলে মানুষ কাজ করতে পারবে না। সুতরাং কোনটিরই বিনাশ নয়
বরং সামঞ্জস্যই কাম্য। তমঃ ও রজঃ গুণের সামঞ্জস্য বিধানে ভূমিকা রাখে সত্ত্ব গুণ। সত্ত্ব
মানে সৎ, শুদ্ধতা, পবিত্রতা। গোধূলি লগ্নে দিবাচর পাখিগুলো কিচির মিচির শব্দ করে ঘরে
ফিরছে, পশ্চিম দিগন্তে রক্তিম সূর্য ঠিক এমন একটি মুহূর্তে প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুভূতিতে
নাড়া দিলে ‘আহ! কি সুন্দর’ এরকম যে ভাবের সৃষ্টি হয় - এর নাম সত্ত্ব। কখন আমরা বুঝবো
যে নিজের মধ্যে সত্ত্ব প্রবল হচ্ছে? সত্ত্ব যখন প্রবল হয় তখন অস্থিরতা থাকে না আবার
আলস্যও থাকে না। নিজের মধ্যে থাকে একটি শান্ত ভাব। অনেক পরস্পরবিরোধী চিন্তার আসা যাওয়া
থাকে না। যা ভাবছি তার মধ্যে একাগ্রতা থাকে। কর্ম এবং চিন্তার মধ্যে থাকে সমন্বয়। মানুষের
সাথে সংযোগ স্থাপন করতে ভালো লাগে, কথা বলতে ভালো লাগে, হাসতে ভালো লাগে, কাজ করতে
ভালো লাগে। জীবন ও জগতের প্রতি থাকে একটা ইতিবাচক
মনোভাব। অল্প পরিশ্রমে অনেক কাজ করা যায়। কাজের প্রতি মনোযোগ ও দরদ সৃষ্টি হয়। ফলে
মানুষ লক্ষ্যের নিকটবর্তী হয় এবং সফলতা লাভ করে। তমঃ ও রজঃ গুণের ভারসাম্য এবং সত্ত্বগুণের
প্রাবল্যই সফলতার কারণ।
আধ্যাত্মিক সাধনার
মূলে রয়েছে তমঃ ও রজঃ গুণের ভারসাম্য রক্ষার প্রচেষ্টা এবং সত্ত্ব গুণের বিকাশ সাধন।
সংসার ত্যাগ করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো কিংবা গৃহত্যাগী হয়ে তালিযুক্ত কাপড় পড়ে
গাছের নিচে বসে থাকার নাম আধ্যাত্মিকতা নয়। আধ্যাত্মিকতা মানে দরিদ্রতা নয় - অর্থ,
বিত্ত, প্রতিপত্তি না থাকলেই মানুষ আধ্যাত্মিক সাধক হয় না। বরং জ্ঞান এবং সম্পদ একসাথে
থাকে। যার জ্ঞান আছে সম্পদ অবশ্যই তার আয়ত্ত্বে থাকে।
তমঃ, রজঃ ও সত্ত্ব
গুণ খাদ্যের মাধ্যমেও দেহে উৎপন্ন হয়। অপরিষ্কার, বাসি, এঁটো খাদ্য, অতি শুষ্ক, পচে
যাওয়া খাদ্য তম গুণ প্রধান। রজ গুণ প্রধান খাদ্য হলো - অতি ঝাঁঝালো, অতিরিক্ত মশলাযুক্ত,
অতি লবণাক্ত, অতি তিক্ত, অতিরিক্ত গরম, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা খাদ্য এবং পিঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি।
সত্ত্ব গুণ প্রধান খাদ্য হলো - গরুর দুধ, ঘি,
মাখন, ফল, শুষ্ক ফল যেমন, কাজুবাদাম, কাঠবাদাম, আখরোট, এবং যে সকল খাদ্য সহজে পঁচে
না।
সৎ ভাবে উপার্জিত
অর্থে কেনা খাদ্য সাত্ত্বিক ভাবাপন্ন করে। অসৎভাবে উপার্জিত অর্থে কেনা খাদ্য রাজসিক
ভাবাপন্ন করে। চুরি/ঘুষ/প্রতারণা দ্বারা উপার্জিত অর্থে কেনা খাদ্য তামসিক ভাবাপন্ন
করে।
শুদ্ধ চিত্তে
প্রস্তুতকৃত ও পরিবেশিত খাদ্য সাত্ত্বিক। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লোক দেখানো সামাজিকতায়
প্রস্তুতকৃত ও পরিবেশিত খাদ্য রাজসিক। অসৎ ও ধূর্ত লোকের সাথে খাদ্য গ্রহণ কিংবা তাদের
দ্বারা পরিবেশিত খাদ্য তামসিক গুণ সম্পন্ন।
যে খাদ্য গুরুর
সাথে কিংবা গুরুর স্মরণে শুরু ও শেষ করা হয় তা সাত্ত্বিক ভোজন। গল্প, হাসি, ঠাট্টা,
তামাসার মাঝে যে খাদ্য খাওয়া হয় তা রাজসিক ভোজন। মদ, নেশা জাতীয় বস্তু আছে এমন ভোজন
তামসিক। তাজা ফল সাত্ত্বিক গুণ বৃদ্ধি করে,
আঁচার কৃত ফল রজঃ গুণ ও মদ্য তমঃ গুণ বৃদ্ধি করে।
মহিষের দুধ শারীরিক শক্তি বাড়ায় কিন্তু সাথে সাথে রজঃ গুণও বৃদ্ধি করে। গরুর
দুধ মানসিক শক্তি বাড়ায় এবং সত্ত্ব গুণ বৃদ্ধি করে।
লোভ, লালসা,
স্বার্থ সিদ্ধির চিন্তা রাজসিক ভাব বাড়ায়। অসৎ সঙ্গ, চুরি, ডাকাতি, অপরের ক্ষতি চিন্তা
তামসিক ভাব বৃদ্ধি করে। তাই খাদ্যের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ খুব কমই হয়। তমঃ ও রজঃ গুণের
ভারসাম্য এবং সত্ত্ব গুণের বৃদ্ধি সাধিত হয় মূলত সম্যক চিন্তা, সম্যক কর্ম, সম্যক সঙ্ঘ,
সম্যক বচন, গুরু সংযোগ এবং নিজেকে পাঠের মাধ্যমে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন