সময়ের
সাফ কথা ....
কাউকে কাফির বলা সন্ত্রাসের প্রথম পদক্ষেপ
আরিফিন হক ॥ ইসলামের নামে
সন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড রোধ করতে সন্ত্রাসীদের বিভ্রান্তির স্বরূপ
উদ্ঘাটন অতীব জরুরি। যে কোনো যুগে ও সমাজে ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ
প্রচার করতে প্রায় একই প্রকার কৌশল অবলম্বন করা হয়। ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাস পূরণের
জন্যই হোক কিংবা ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই হোক কিংবা ইসলাম
প্রতিষ্ঠার আবেগ ও উন্মাদনার কারণেই হোক - ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড
পরিচালনার প্রথম পদক্ষেপ হলো - কাউকে কাফির বা মুরতাদ আখ্যা দেয়া। কাফির বা
মুরতাদকে হত্যা করা বা শাস্তি দেয়ার বৈধতা দাবি করা সন্ত্রাসের পথে চূড়ান্ত
পদক্ষেপ।
ইসলামের
নামে কাউকে হত্যা করতে হলে তাকে ‘কাফির’ ও ইসলামের শত্রু প্রমাণ করা খুবই জরুরি।
অন্যথায়, এই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ বা সমর্থন পাওয়া যায় না। এজন্য কাউকে কাফির বলা
সন্ত্রাসের পথে প্রধান পদক্ষেপ। সব দেশেই জঙ্গীরা এই পথ অবলম্বন করে। তাদের মতের
পক্ষে তারা হাদিস থেকে অনেক উদ্ধৃতি দিয়ে যে কোন নিরাপরাধ ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিকে
কাফির বলে। ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যখন রাজনৈতিক কারণে প্রতিপক্ষকের সমর্থক
ও কর্মীদের কাফির বলা হয়েছে, কবি-সাহিত্যিক, লেখক ও সূফী সাধকদের কাফির বলা হয়েছে।
কুরআনে
কাউকে কাফির বলা কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। পাশাপাশি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে
সকল মানুষের প্রাণ, সম্পদ ও মর্যাদার ক্ষতি করাকে হারাম বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বিচারের
মাধ্যমে অপরাধীকে এবং যুদ্ধের ময়দানে যোদ্ধা ব্যতীত কোন মানুষকে হত্যা করাও কুরআনে
কঠিনভাবে নিষিদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধ ও বিচারক একান্তভাবেই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। কোন
ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা দল কখনো ব্যক্তিগত বা দলগত মতামতের ভিত্তিতে কাউকে কাফির
বলতে, শাস্তি দিতে বা হত্যা করতে পারে না।
ইসলাম
মানুষকে সততা ও পাপমুক্ত জীবন যাপনে উৎসাহ দিয়েছে, কিন্তু মুসলিম বলে গণ্য হওয়ার
জন্য পরিপূর্ণ পাপমুক্ত হওয়ার শর্তারোপ করেনি। আল্লাহর বিধান অনুসারে ফয়সালা না
করাকে কুরআনে কুফরি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া কুরআনে অনেক পাপকেও কুফরি বলা
হয়েছে। কুরআনে যেমন বিভিন্ন পাপকে কুফরি বলা হয়েছে, তেমনি কঠিন পাপে লিপ্ত
ব্যক্তিকেও মুমিন বলা হয়েছে। আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা ফয়সালা করে
না তাদেরকে কাফির বলা হয়েছে আবার মুমিনের সাথে যুদ্ধ করাকেও স্পষ্টতই কুফরি বলা
হয়েছে এবং পাপীদেরকেও মুমিন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে ব্যবহৃত কুফর, নিফাক ও
জুলুম দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে - কখনো তা অবিশ্বাস, ঈমানের অনুপস্থিতি, কখনো তা
আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা, মুনাফিকের গুণ ও সাধারণ পাপ অর্থে ব্যবহার করা
হয়েছে।
তাই কুরআনের
কোন আয়াতের ভিত্তিতে কোন পাপীকেই কাফির বলা যায় না। ইসলামের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত
হলো - ‘যদি কোনো ব্যক্তি তার ভাইকে কাফির বলে, তবে এ কথা দু’জনের একজনের উপর
প্রযোজ্য হবে। যদি তার ভাই সত্যিই কাফির হয় তবে ভাল, নইলে যে তাকে কাফির বলল তার
উপরেই কুফরী প্রযোজ্য হবে।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন - ‘যদি কেউ কোনো মুমিনকে
কুফরীতে অভিযুক্ত করে তবে তা তাকে হত্যা করার মতই অপরাধ হবে।’ কুরআনের মুলনীতি এই
যে, মুমিন নিজের ঈমানের বিষয়ে সতর্ক থাকবেন এবং সকল কুফর, শিরক, পাপ, অন্যায়,
অবাধ্যতা ও ইসলামী মূল্যবোধ বিরোধী চিন্তাচেতনা থেকে সতর্কতার সাথে আত্মরক্ষা করবেন
এবং একই সাথে অন্য ব্যক্তির ঈমানের দাবিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখবেন। ভুল করে কোনো
মুমিনকে কাফির বলার চেয়ে ভুল করে কোনো কাফির, মুশরিক বা মুনাফিককে মুসলিম বলা অনেক
ভাল ও নিরাপদ। কারণ, প্রথম ক্ষেত্রে কঠিন পাপ ও নিজের ঈমান নষ্ট হওয়ার ভয়
রয়েছে।পক্ষান্তরে, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কোনোরূপ পাপ বা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
যে ব্যক্তি
নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করেন, তাকে কোনো কারণে ‘অমুসলিম’, কাফির বা ধর্মত্যাগী বলা
যাবে না। ইসলামী আইন লঙ্ঘনকারী বা আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারী মুসলিম পাপী মুসলিম
বটে কিন' কাফির নয়। পাপের কারণে কোন ব্যাক্তিকে অমুসলিম বা ধর্মত্যাগী গণ্য করা
যাবে না। মূলধারার মুসলিম উম্মাহর দৃষ্টিতে এ ইসলামের অন্যতম মূলনীতি। এই মূলনীতির
প্রতি সাহাবীগণের বিশ্বাস এত দৃঢ় ছিল যে, তাঁরা কখনো খারিজীদেরকে কাফির বলেন নি।
খারিজীগণ তাঁদেরকে কাফির বলেছে, নির্বিচারে মুসলিমদেরকে হত্যা করেছে, সাহাবীগণ
তাদের বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন, কিন' কখনো আলী (রা.) বা অন্য কোনো
সাহাবী তাদেরকে কাফির বলে ফতোয়া দেন নি। বরং তাঁরা এদের সাথে মুসলিম হিসেবেই
মিশেছেন, কথাবার্তা বলেছেন, আলোচনা করেছেন এমনকি তাদের ইমামতিতে সালাত আদায়
করেছেন।
কাউকে কাফির
আখ্যা দেয়ার মূল উদ্দেশ্য সর্বদাই রাজনৈতিক ছিল। এখনো সুস্পষ্ট পাপে নিজের দলভুক্ত
ব্যক্তিদেরকে মুমিন বলে গ্রহণ করা হয় পক্ষান্তরে রাজনৈতিক বিরোধীদেরকে কল্পিত পাপ
বা ‘আল্লাহর আইন অমান্য’ করার অপরাধে সুযোগ বুঝে কাফির বলা হয়। আলী (রা.) ও তাঁর
অনুসারীদেরকেও খারিজীরা কল্পিত পাপের অপরাধে কাফির বলেছিল।
সাফ কথা -
কাউকেই কাফির বলা যাবে না। ইহুদি, খৃষ্টান এমনকি মূর্তি পুজারী বা ছাবেঈনগণও কাফির
নয়। প্রমাণ সুরা বাকারার ৬২ ও ১৭৭ নং আয়াত। যেখানে বলা হয়েছে - “ভক্তগণ
(মুসলিমগণ), ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ছাবেঈনগণ যারাই আল্লাহ ও ভবিষ্যতে (পরকাল)
বিশ্বাসী এবং সৎ পরিশ্রমী, তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে তাদের প্রতিপালকের কাছে।
তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা আজাবপ্রাপ্ত হবে না।” (সুরা বাকারা : ৬২, ১৭৭) এবং
“যারা ইমান এনেছে (মুসলিম) এবং যারা ইহুদি, সাবেইন, খ্রিষ্টান ও অগ্নিপূজক এবং
যারা মুশরিক অবস্থায় আছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের বিচার-মীমাংসা করবেন। আল্লাহ
সমস্ত কিছুর সাক্ষী।” (২২ সুরা হাজ্জঃ ১৭)।
কুরআন মতে
পৃথিবীতে এমন কোন ধর্ম নেই যে ধর্ম সত্যের একচেটিয়া দাবিদার। ধর্ম অনেক কিন্তু
আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়। কোন একটা নিদিষ্ট ধর্মমতের অনুসারী না হলেও যদি কেউ সৎকাজ
করে এবং এক ও অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস ও নির্ভর করে তবে সে আল্লাহর কৃপা
থেকে বঞ্চিত হবে না। বিষয়টি আরও পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে সুরা হাজ্জের ৬৭, ৬৮ ও ৬৯
নং আয়াতে - “আমি প্রত্যেক সমপ্রদায়ের জন্য নিয়মকানুন নির্ধারণ করে দিয়েছি যা ওরা
পালন করে। সুতরাং ওরা যেন তোমার সঙ্গে এ ব্যাপারে বিতর্ক না করে। তুমি ওদেরকে
তোমার প্রতিপালকের দিকে ডাক দাও। তুমি তো সরল পথেই আছ। ওরা যদি তোমার সঙ্গে তর্ক
করে তবে বলো, ‘তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আল্লাহ ভালো করেই জানেন। তোমরা যে বিষয়ে
মতভেদ করছ আল্লাহ কিয়ামতের দিন সে বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবেন।”
একইভাবে সুরা
মায়েদার ৬৯ নয় আয়াতে দৃঢ়তার সাথে বলা হয়েছে - “নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাসী, ইহুদি, সাবেয়ি
ও খৃষ্টান তাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করবে ও সৎকাজ করবে তাদের কোন
ভয় নেই আর সে দুঃখিতও হবে না।”
যারা ইসলামের
পতাকাতলে আসেনি তাদের সবাইকে কাফির বলার বিরুদ্ধে কুরআনের নির্দেশ হচ্ছে - “তারা সকলে
একরকম নয়। আহলে কিতাবের মধ্যে একদল আছে অবিচলিত। তারা রাত্রিতে সিজদারত অবস্থায় আল্লাহর
আয়াত আবৃত্তি করে। তারা আল্লাহ ও শেষদিনে বিশ্বাস করে, সৎকর্মের নির্দেশ দেয়, অসৎকর্ম
নিষেধ করে এবং তারা সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করে। বস্তু তারাই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত
এবং তারা যে কোন সৎকাজই করুক না কেন তাদেরকে প্রতিদানে কখনও অস্বীকার করা হবে না। বস'তঃ
আল্লাহ মুত্তাকীদের সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত।” (সুরা আল ই ইমরান : ১৩-১৫)। “এবং মুসার
জাতির মধ্যে এমন এক সম্প্রদায় আছে যারা সত্যের সাহায্যে হেদায়াত পাচ্ছে এবং তার সাহায্যে
ন্যায় বিচার করছে।” (৭ সুরা আরাফ : ১৫৯)। সুতরাং, কুরআনসূত্রে এটি প্রমাণিত যে, যে
ব্যক্তি তার প্রতিপালকের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং সৎ পরিশ্রমী হয় তার ফল তার প্রতিপালকের
কাছে রয়েছে এবং তাদের কোনো ভয় নেই ও তারা দুঃখিত হবে না। আল্লাহ তায়ালা সমগ্র মানব
জাতির, তিনি কোন সমপ্রদায়ের নন। আল্লাহর বিধান এই যে, যে কোন ব্যক্তি তাঁর উপর নির্ভর
করলে, তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করলে এবং কর্মের মাধ্যমে তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলে
প্রতিদান অবশ্যই পাবে।
উল্লেখ্য, যে
ব্যক্তি প্রকাশ্যে নিজেকে কাফির কিংবা অবিশ্বাসী আখ্যা দেয় তাকেও অবিশ্বাসী হিসেবে
গ্রহণ করা সঠিক নয়। বরং তাকে বুঝাতে হবে যে, বিশ্বাস একটি শ্বসন ক্রিয়া। শ্বসন ব্যতীত
মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। অর্থাৎ, কোন জীবিত
সত্তাই কাফির হতে পারে না। যে যতক্ষণ বেঁচে আছে সে ততক্ষণ আল্লাহর ইচ্ছাতেই বেঁচে আছে
এবং আল্লাহ তাকে ভালোবেসে লালন-পালনও করছেন। আল্লাহ যাকে লালন-পালন করা এখনও অব্যাহত
রেখেছেন তাকে কাফির বা মুরতাদ আখ্যা দেয়া অবশ্যই আল্লাহদ্রোহীতা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন